থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একাধিক গণকবরে
বাংলাদেশিদের লাশ থাকতে পারে—এমন খবরে
উদ্বিগ্ন সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ
ব্যক্তিদের স্বজনেরা। তার পরও কক্সবাজার উপকূল
দিয়ে মানব পাচার থামেনি। গত রোববার রাতেও মানব
পাচার হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতেও মানব
পাচারের পরিকল্পনা ছিল দালালদের।
গতকাল কক্সবাজার উপকূলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে
এমন তথ্য জানা গেছে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের
হিমছড়ি ও দরিয়ানগর এবং উখিয়া উপকূল ঘুরে দেখা
যায়, সেখানকার লোকজনের মুখে মুখে থাইল্যান্ডের
জঙ্গলে গণকবর নিয়ে আলোচনা।
কলাতলী ও হিমছড়ি এলাকার জেলে গিয়াস উদ্দিন ও
হামজা আলী বলেন, প্রায় প্রতি রাতে দরিয়ানগর
সৈকত দিয়ে মানব পাচার করা হয়। মানব পাচারে
নেতৃত্ব দেন কলাতলী গ্রামের একাধিক দালাল।
দরিয়ানগরের একটি নৌকার সারেং নুরুল ইসলাম
বলেন, তাঁরা প্রতি রাতে ৪০-৫০ জন যাত্রীকে
নৌকায় তুলে গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ থাইল্যান্ডের
জাহাজে তুলে দেন। বিনিময়ে জাহাজে থাকা দালালেরা
যাত্রীপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে দেন। পরে
দালালেরা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে যাত্রীদের জিম্মি
করে মাথাপিছু দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা করে
মুক্তিপণ আদায় করেন। মুক্তিপণ না দিলে যাত্রীদের
দুর্গম জঙ্গলে আটকে রাখা হয়। তিনি জানান, গত
রোববার রাতেও মানব পাচার করা হয়েছে। গতকাল
রাতেও পাচার করার কথা ছিল।
সুজনের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান
বলেন, রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল না
থাকায় উপকূল দিয়ে মানব পাচার বেড়ে গেছে।
মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)
মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, গভীর রাতে মানব
পাচার করা হয়। তাই পুলিশ ঝুঁকি নিয়ে সাগরে নামতে
পারে না। তা ছাড়া, মানব পাচার ঠেকানোর মতো
আধুনিক জলযান পুলিশের কাছে নেই।
কক্সবাজার ১৭ বার্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের
অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেন,
দরিয়ানগর, হিমছড়িসহ বিভিন্ন উপকূল দিয়ে রাতের
অন্ধকারে বিপুলসংখ্যক মানব পাচার হচ্ছে—এমন
খবর বিজিবির কাছে আছে। গত ২ এপ্রিল রাতে
দরিয়ানগর জঙ্গলে মানব পাচারকারীদের আস্তানায়
অভিযান চালাতে গিয়ে বন্য হাতির আক্রমণে
বিজিবির একজন সদস্য নিহত হন। মূলত এর পর
থেকে রাতে বিজিবির অভিযান বন্ধ আছে।
উদ্বিগ্ন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা: উখিয়ার
পাতাবাড়ি গ্রামের কৃষক নুরুল আমিন গতকাল দুপুরে
থানায় আসেন তাঁর নিখোঁজ ছেলের সন্ধানে। কিন্তু
পুলিশ তাঁকে কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
নুরুল আমিন বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে থাইল্যান্ডের
জঙ্গলে গণকবরের ছবি দেখে তিনি উদ্বিগ্ন। তাঁর
আশঙ্কা, ওই গণকবরে তাঁর ছেলের লাশও থাকতে
পারে। তাই ছেলের খবরের জন্য তিনি থানায় ছুটে
এসেছেন।
নুরুল আমিন জানান, গত ১৯ মার্চ দালাল চক্র
উপজেলার মরিচ্যা বাজার থেকে তাঁর ছেলে আক্তার
কামালসহ চার শিশুকে ফুসলিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে
টেকনাফ নিয়ে যায়। তারপর রাতে তাদের ইঞ্জিন
নৌকায় তুলে থাইল্যান্ডে পাচার করে।
উখিয়া থানার ওসি জহিরুল ইসলাম বলেন, দালালদের
ধরা গেলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া যেত।
মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে সবচেয়ে বেশি মানুষ
নিখোঁজ হয়েছে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের
শাহপরীর দ্বীপের। সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি)
চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান জানান, গত দুই বছরে
সাতটির বেশি ট্রলারডুবির ঘটনায় এই ইউনিয়নের
১৩টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়েছে।
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ায়
ঘরে ঘরে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে তথ্য জানার
জন্য ইউনিয়ন পরিষদে আসছেন।
মানব পাচারে যুক্ত মিয়ানমারের নৌ ও কোস্টগার্ড:
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
পাঠানো পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়,
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের
২৪১ দালালের নিয়ন্ত্রণে চলছে কক্সবাজার সমুদ্র
উপকূল দিয়ে মানব পাচার। ২০১৪ সালে এই দালাল
চক্র দেশের ৪০ জেলার ৬০টি স্থান দিয়ে প্রায় ২০
হাজার মানুষকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচার
করেছে। মিয়ানমারের নৌ ও কোস্টগার্ড বাহিনীর
সদস্যরা মানব পাচারে সক্রিয় সহযোগিতা দিচ্ছে।
টেকনাফকেন্দ্রিক ২৬ জনের একটি হুন্ডি চক্র মানব
পাচার ও ইয়াবা চোরাচালানের টাকা লেনদেন করছে।
তদন্ত দলের প্রধান ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের
অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন) বনজ
কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তালিকাভুক্ত
দালাল ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের আটক করে মানব পাচার
ঠেকানোর কাজ করছে পুলিশ। গত ৯ মার্চ
আন্তর্জাতিক মানব পাচার দলের অন্যতম হোতা
হামিদ করিমসহ মিয়ানমারের কয়েকজন দালালকে
আটক করেছে পুলিশ। হুন্ডি ব্যবসায়ীদেরও ধরার
চেষ্টা চলছে।
সমুদ্র উপকূল দিয়ে মানব পাচার প্রতিরোধে আট দফা
সুপারিশ করেছিল তদন্ত দল।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন,
মানব পাচার সম্পর্কে জনমত সৃষ্টির জন্য পুলিশ
ইতিমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে ‘মানব পাচারবিরোধী কমিটি’
গঠন করে প্রচারণা চালাচ্ছে। তিনি বলেন,
কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানব পাচার অনেক কমেছে।
এখন চট্টগ্রাম বন্দরে মালামাল নিয়ে আসা বিদেশি
জাহাজে করে মানব পাচার হচ্ছে। মিয়ানমারের
নাগরিকদের পাশাপাশি রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী,
যশোর, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনাসহ দেশের ৪০
জেলার মানুষ পাচার করা হচ্ছে। ট্রলারডুবির ঘটনায়
অনেকে প্রাণ হারাচ্ছে। (প্রথম আলো)