আপনি কি জানেন সাভারের পাশে একটা পাহাড় আছে। জঙ্গল ঘেরা সেই পাহাড়ের ভেতর একটা সরোবর আছে। চারদিকে বাঁশঝাড় ঘেরা সেই সরোবরের চারদিকে হাজার হাজার বকপাখি উড়ে বেড়ায়। কি ভয়ানক ব্যাপার! আগে শুনিনি কেন? সাভার বাসস্ট্যান্ড থিকা রিকশা কইরা রাজাশন যাইতে হয়। রাজাশন থিকা নাইমা দশ কিলো পথ হাঁটতে হয়। দেন, একটা ঘন জঙ্গল পড়ে, সেই জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়। এখনও উপরে ওঠার সিঁড়ি বলতে কিছু তৈরী হয় নাই। তবে পাহাড়ে উঠতে পারলে নাকি বিশাল বিষ্ময়। পাহাড়ের চুড়ার ঠিক মাঝখানে একটা লেক। ঢাকার এত কাছে পাহাড়ের মাথায় একটা বড় লেক। চারদিকে বাঁশঝাড়ে হাজার হাজার বকপাখি। হাজার হাজার সাদা বকপাখি। আমি ভাবতেছি একদিন সাভার যাব। ট্রেকিংয়ে।
ফেস বাই ফেস উপন্যাসে এমন একটা জায়গার কথা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস করে ফেললাম। গভীর রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সেখানে হাজিরও হলাম। রওনক এর বদলে......অন্য কেউ সঙ্গে.....এবং তারপর দিনেও মোটামুটি পূর্ব-প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম, এই ভ্যালেন্টাইনে কোনো রওনকের সাথে...মোটামুটি এমনই চলছিলো সন্ধ্যা অবধি। বিশেষত উপন্যাসের লেখক মাহবুব মোর্শেদের সাথে দেখা হবার আগে পর্যন্ত। তারপরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, সাভারের পাশে যে পাহাড়ের কথা লিখেছেন, সেটা সত্য তো?
শাংরিলা আচ্ছন্ন একটা প্রজাতি আছে রাজপুত্র গৌতমের অনুসারীদের মধ্যে। চিরশান্তির এমন এক দেশের চিত্র - যা ইউরোপে ইউটোপিয়া নামে সমাধিক পরিচিত। সম্পর্ককরণ ও গড়নের মধ্যে যোগাযোগ দ্রুতলয়ে হচ্ছে বলে আমাদের শাংরিলা এখন আরাধ্য হয়ে পড়েছে ফেসবুকে। মাহবুব মোর্শেদের লেখার উপরে আমার আস্থা আছে। গদ্য পড়তে ভালো লাগে। মাহবুব মোর্শেদ কবি বলেই হয়তো তার গদ্যের মধ্যে গল্পচিত্র অনেক রূপকীয়।
ফেস বাই ফেস পড়তে শুরু করে এক প্রেমিক শুভ ও দুই প্রেমিকা তিন্নি ও সুপর্নার ট্রাঙ্গুলারাইজেশনের মুখোমুখি হলাম - যেটা তাড়িয়ে নিয়ে গেলো শেষ পরিনতি দেখতে। একটা সময় নিশ্চিত হলাম সুপর্না আউট হয়ে গেলো ফোকাস থেকে, তিন্নি-ই বরণ করে নিচ্ছে শুভর দীর্ঘ সময় যাবত ঝুলে থাকা প্রণয় নিবেদন। কিন্তু সকল হিসেব নিকেষ উল্টো করে দিয়ে টানটান উত্তেজনায় গল্প এগুলো। তিন্নি ও সুপর্না ভেতরে ভেতরে চিরায়ত যৌনতার অরিয়েন্টেশনে আবদ্ধ - একটা দুর্দান্ত চমকই বটে।
আবারও মনে করিয়ে দেই বইটির নাম ফেসবুক, উফ, ফেস বাই ফেস এবং উপন্যাসের সকল চরিত্র ফেসবুক সম্পর্কের আবাহনে সিক্ত, কেবলমাত্র ট্রাংগুলাভার ছাড়া। শুভ কেবল চমৎকার স্টাটাস লিখে ভক্ত জুটিয়ে ফেলেছে। ফেসবুকের স্ট্রেন্জার নাজিয়ার সাথে নৈর্ব্যাক্তিক সঙ্গপ্রদান, মধ্যবয়স্ক নওরোজের ফেসবুক কেন্দ্রিক জীবনের পুনরুত্থিত স্বাদ প্রাপ্তি, সাধারণ গৃহিনী সাবিনা মেহনাজ সুপ্তির মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ, সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ মুন্নার ফেসবুকে উত্তেজক ছবি ও গল্পের অন্বেষণ, সাহসী রিনা কাউসারীর নারীত্ব বিষয়ক সন্দেহ, কানাডার নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা শেরীর ফেসবুক নির্ভরতা যার সন্তানরা বাস করে হাজার হাজার মাইল দূরে, কৈশোরে ক্ষণিক পরিচিতা তমাকে ফেসবুকে আবিষ্কার, টিভির ব্রেকিং নিউজ-খবরের টিকআর প্রস্তুতকারী জীবন সাহার ফেসবুক স্টাটাস চেঞ্জ করে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবন্ধী মাধবীর সাথে বিয়ে - এসব এখন জীবনের রিয়েলিটি। যুক্তকরণের হাতিয়ার। সম্পর্কনাস্ত্র। উপন্যাসের প্রতিটা চাপ্টারে এসকল মানুষের প্রযুক্তি-নির্ভরতা আর একাকীত্বের মলিন চিত্র এত বর্ণিল বর্ণনায় উঠে এসেছে যে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বহুকাল এক বসায় (শোয়ায়) একটা আস্ত উপন্যাস পড়িনি।
কল্পনার উড়াল দিয়ে সুপর্নাকে নিয়ে শুভ জয়পুরে রুক্ষ্ম মরুভূমির বুকে প্রাচীন শহর দেখতে যায়। ভার্চুয়াল এই ট্যুরের বৃত্তান্ত ফেসবুকের অবশ্যম্ভাবী গনিত, কিন্তু মাহবুব মোর্শেদ পুরো উপন্যাসে এমন অজস্র কল্পনার উড়ালে বিষ্ময়করভাবে আপনাকে সংগী করে নেবে। যেমন সাভারের পাশে এক বকপুকুরের পাহাড়ে।
সভারের পাশে আদৌ কোনো পাহাড় আছে কিনা প্রবল আগ্রহে যখন মাহবুব মোর্শেদকে জিজ্ঞেস করলাম - সে আমার এডভেঞ্চারের সাধটাকে পুরো নস্যাত করে পুরোটাই তার নির্মিত জানালো। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে পাঠককে এভাবে নিবিষ্ট করার ক্ষমতা সমসমায়িক লেখকদের মধ্যে একমাত্র হুমায়ুন আহমেদেরই আছে বলে যাদের বিশ্বাস - সম্ভবত তারা এবার তার যোগ্য উত্তরসূরী পেয়ে গেছেন।
বিঃদ্রঃ যারা হুমায়ুন-যুগের সমাপ্তি চান, অনুগ্রহ করে মাইনাস প্রদান করে সমর্থন জানাবার নির্দেশ জারি করা হলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৪৪