আজ থেকে প্রায় আটশত বছর আগে ঠিক এই শব্দগুলি দিয়েই জালালুদ্দিন মোহাম্মাদ রুমি আমাদেরকে এক অসাম্প্রদায়িক ভালোবাসার জগতে ডেকে গেছেন। যা মানুষ নিরন্তর ভাবে খুঁজে বেরিয়েছে আনন্তকাল। তাইত ইউরোপ আমেরিকা সহ সারা পৃথিবীতে সেই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত কবি “জালালুদ্দিন মোহাম্মাদ রুমি”।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ভ্রমণে অংশ হিসেবে তার মাজার দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। সকাল দশটা নাগাদ আমাদের বহন করা দুটি বাস সেখানে গিয়ে পৌঁছল। সাথে একজন গাইড। প্রধান সড়কের পাশেই ঢোকার রাস্তা। একটু এগিয়ে গিয়েই সারি সারি কবর দেখতে পেলাম। গাইডকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, এই কবরগুলো রুমির অনুসারীদের। কবরগুলোতে গোলাপ সহ আরো কিছু অপরিচিত ফুলেরগাছ লাগান। কিছু লোক পরিচর্যার কাজ করছেন।
ভিতরে ঢুকতেই একটি পুরাতন ওজুর যায়গা। তার ডান দিকে ১৯ টি লাগোয়া ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলোর কোনটিতে সেই সময়ের ব্যবহ্রত কাপড়চোপড় আবার কোনটিতে সোনার মোহর, অলংকার। তবে শেষ দিকের ঘরগুলোতে মানুষ আকৃতির কিছু ডামি বসান আছে। ডামিগুলো দিয়ে সেই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক অবস্থার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
এর পাশেই রয়েছে রুমির মাজারটি। ওপরে নীল রঙের মারবেল পাথরের মিনার। উচ্চতায় সাভাবিক মিনারের চেয়ে কিছুটা ছোট। মিনারটি রুমির কবরের ঠিক ওপরে বাসানো। গাইড বললেন এই রকম মিনার পৃথিবীতে আর কোথাও দেখা যায়না। আমরা মাজারে ঢোকার জন্য এগিয়ে গেলাম। মাজারের পবিত্রতা রক্ষার্থে ঢোকার আগে “অন টাইম ইউস সু” পড়তে দেয়া হল। ঢুকেই হাতের ডান দিকে কবরের সারি। সবগুলোই তার অনুসারীদের। একেবারে শেষে উচু করে নীল রঙের গিলাফে মোড়ানো তার কবরটি। সেখানে দোয়া করার ব্যাবস্থা আছে। তবে ফ্লাস লাইটসহ ছবি তুলতে বারবার নিষেধ করছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সেখানেও ছোট আকারের একটা যাদুঘরের মত দেখা গেল। সেখানে রয়েছে রুমির ব্যবহ্রত কুরআন শরিফ, তসবিহ ও পোশাক। তবে সেখানকার বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে একটি ছোট বাক্সে নবীজির দাড়ি মোবারক রাখা হয়েছে। এর পাশেই নামাজ পরার জন্য একটি স্থানকে কাঠের দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। মহিলা পুরুষ সকেলেই নামাজ পরে দোয়া করছেন সেখানে।
রুমি, কবি হলেও তাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, কিরগিজিস্থান , তুরস্ক সহ অনেক দেশেই তাকে একজন ধর্মগুরু হিসেবে দেখা হয়। আমেরিকার বিখ্যাত কবি রবার্ট ব্লাই এর তত্ত্বাবধায়নে রুমির লেখাগুলি ১৯৭৬ সালে ২২ টি পৃথক খন্ডে আলাদা করে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। যা পরবর্তীতে আরো ২৩ টি ভাষায় অনূদিত হয় এবং পৃথিবীজুড়ে বইগুলোর ২০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে।
আমরা মাজার দেখে বের হলাম। বের হয়েই মাজারের ঠিক সাথেই দাঁড়িয়ে থাকা ওসমানীয় রীতিতে তৈরি করা মসজিদটি নজরে পরল। এটি কনিয়া শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ।
তবে আমাদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে তখন একটি জিনিস বাকি ছিল। রুমির “সেমা” নাচ। “সেমা” নাচের একটা আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে। আর এটাকে ধরে রাখতেই কনিয়া সিটি কর্পোরেশন সেমা নাচ নিয়ে গবেষণার জন্য বিশাল লাইব্রেরি ও এর প্রদর্শনীর জন্য একটি কমপ্লেক্স ভবন তৈরি করে দিয়েছেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে শুরু হল এই বিশেষ ধরণের নাচ। মুগ্ধ হতে হল তাদের দেখে।
আমাদের শিডিউল অনুযায়ী ভ্রমণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হল সোমা নাচের মাধ্যমেই। বাস আমাদের জন্য আপেক্ষা করছিল, কিন্তু রুমিযে সেই আট শত বছর আগে যে অসাম্প্রদায়িক একটা জগতের কথা জানিয়ে গিয়েছেন তা "আবার এস, কাফের, মাজুসি যা-ই হওনা কেনো, আবার এস" কবিতার লাইনের মাধ্যমে বার বার মনে পরছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৫