ডাক্তার আজ কদিন হল মানুষের সাথে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন। দেখতে আসাদের মাঝে অনেককেই পরিচিত মনে হয়, কিন্তু ঠিক খেয়াল করে উঠতে পারি না যে, আমরা কিভাবে পরিচিত। ডাক্তার বলেছেন আমি মস্তিষ্কের অটোমিউক কনডিশানে ভুগছি। যা ধীরে ধীরে সকল স্মৃতিকেই মুছে দেবে। আর এর প্রতিক্রিয়া শরীরের মাঝেও একই ভাবে দেখা দেবে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের সাথে সাথে শরীরটাও মৃত হয়ে যাবে আমার।
আজ দুই মাস তের দিন হল এই হসপিটালে আছি। জায়গাটি বেশ ভালোই। কেমন নিরিবিলি। সমস্যা একটাই, এখান থেকে আকাশ দেখা যায়না। আগে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কালো রঙের চেয়ারটি জানালার কাছে নিয়ে গিয়ে আকাশ দেখতাম। দেখতাম চাঁদ তার আলো দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে আকাশটাকে। আবার মাঝে মাঝে দেখতাম আকাশটি কেমন আধারে ভরে গিয়েছে। সেখানে চাঁদ-তারার কেউই নেই। অন্ধকার রাতের সে আকাশের নিচে নিজেকে বড় একা মনে হত।
আজকাল কেন জানি সবসময়ই জেগে থাকি। ডাক্তারের দেয়া মোটা মোটা এন্টিবায়োটিকগুলোও ঠিক পেরে উঠছেনা মনে হয়। তাই জেগে জেগে ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে আবার মনে কারার চেষ্টা করি। মনে করতে চাই আমার সেই আগলে রাখা কষ্টগুলোকে। কিন্তু আমি যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি কোন এক আলোআঁধারির ঘোড়ে।
আজ আমাকে দেখতে অনেক মানুষ এসেছে। এদের অধিকাংশই আমার কাছে অপরিচত। আমার ডান পাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা। হালকা পাতলা গড়ন। নীল রঙের শাড়ী পড়েছে সে। আমার দিকে কেমন করুনা ভাব করে তাকিয়ে আছে। অবশ্য সাদা রঙের এই বেডে শুয়ে থাকা যে কারোর প্রতিই করুণা হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অন্য দিকে মুখ ফেরালাম। চিনতে না পারার বেদনাটা তার চোখের পানি হয়েই ঝড়ে পড়ছিল মনে হয়। চোখ বেয়ে পড়া সেই পানির কয়েকটি ফোটা আমার হাতের তালুতে এসে পড়ল। আমি তার দিকে আবার তাকালাম। সে তার মাঝে লুকিয়ে থাকা সকল সঙ্কোচ আর ভয়কে তুচ্ছ করে আমার হাত জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলামনা কি করা উচিত এই সময়। হয়তো আগে জানতাম যা এখন আর ঠিক মনে করতে পারছিনা।
সে আমার হাত ধরেই শাড়ির আচোল দিয়ে চোখ দুটি মুছতে মুছতে বলল, আমি তোমার রেকো। এই নামে শুধু তুমিই আমাকে ডাকতে। আমাদের দেখা করার কথা ছিল গত মেয়ে মাসের ১৭ তারিখে। আমার পারিবারিক সমস্যার কারণে তোমাকে না করে দিয়েছিলাম সেদিন। তুমি খুব অভিমান করেছিলে। তোমার বন্ধু হাসানের কাছ থেকে শুনেছি, তুমি ছোট বাচ্চার মত কেঁদেছিলে। আজ দেখ আমি এসেছি। আর তোমার পছন্দের সেই নীল শাড়িটিই পড়েছি।
আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি, আর তাকে স্মরণ করার আপ্রাণ চেষ্ঠা করে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই তাকে মনে করতে পারছি না। তাকে কিছুক্ষন পর বাহিরে নিয়ে যাওয়া হল। আমাকে যে রুমে রাখা হয়েছে সেখান থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে। সে তখন কাঁদছে।
আজ আমার অনেক ঘুম পাচ্ছিল কেন জানি। মেয়েটির চলে যাওয়ার পর থেকেই কেমন চোখ দুটি নিজ থেকেই বন্ধ হয়ে আসছিল। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে যেন চোখের পাতা দুটোয়। আমার এমন অবস্থা বাকিরাও মনে হয় খেয়াল করছিলেন। ডাক্তার সবাইকে বের করে দিলেন। সেই মেয়েটি কাচের দেয়ালের ওপার থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে গভির ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে শেষ চেষ্টাটা করলাম তাকে চিনতে পারার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৭ ভোর ৬:৪৪