somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবলা নারী সবলা হলো না

১৩ ই জুলাই, ২০১১ সকাল ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গত বছরের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের এক কলেজে নারী শিক্ষার্থীদের কারাতে অনুশীলনের ছবি দেখেছিলাম পত্রিকায়। ছবিটিকে দুর্লভ মনে করি। এমন খবরচিত্র হরেদরে তো নয়ই, দু’তিনটিও চোখে পড়ছে না ২০১১-এর মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে। বরং অপ্রত্যাশিতভাবে নজরে আসছে স্কুলছাত্রীর শ্লীলতাহানি, তরুণী হত্যা, গৃহবধূর আত্মহত্যার খবর। গাইবান্ধা, কালীগঞ্জ, মাগুরা, বরগুনা, দিনাজপুর, চাঁদপুর- দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথার নারীরা খবরের শিরোনামে জানাচ্ছে, তারা মারা যাচ্ছে। সবাই মৃত নয়, কিন্তু প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন বেঁচে থাকাও কি কোনো জীবন! নারী অবরোধবাসিনী হয়ে মরছে। চৌকাঠ ডিঙিয়েও মরছে। সমাজ নারীর জন্য নিষ্ঠুর। আবার সমাজই সমব্যথী হয়ে নারীর প্রতি ন্যায়ে উদ্যোগী। সমাজে বহুকালের চর্চিত পুরুষতন্ত্র রুখতে নারীবাদের জন্ম। যেহেতু সমাজ নারী ও পুরুষ মিলেই, তাই পুরুষতন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণে যেমন নারীকে পাওয়া গেল, তেমনি নারীবাদের জাগরণেও পাওয়া গেল পুরুষকে। নারী-পুরুষের এই পাশাপাশি ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান তাদের কতটা এগিয়েছে? কতটা পিছিয়েছে? এই অসমতা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কতটা? উত্তর যদি হতাশাব্যঞ্জক হয়, তবে এর দ্বায়ভার পুরোটাই সমাজের। ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ – এই দীক্ষা পালনে সমাজের ব্যর্থতা পদে পদে প্রমাণিত। অধুনা নারী-পুরুষ পোশাকে, ইংরেজিতে, ঠাটবাটে এগোলেও প্রাপ্তমনস্কতায় এগোয়নি একরত্তি। নয়তো একের সঙ্গে অন্যের অধিকারের, দায়িত্বের, কর্তব্যের, কর্তৃত্বের ফারাক বহাল থাকে কি?

প্রত্যেকের নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় সমতা রক্ষার দায়িত্ব সমাজের। রাষ্ট্র সেই নিরাপত্তা প্রদানে আইন প্রণয়ন করে। আইন অন্যায়কারীকে শাস্তি দেবে, ভুক্তভোগীকে ন্যায়বিচার। অন্যায়কারী পুরুষও হতে পারে, হতে পারে নারীও। ভুক্তভোগী পুরুষও হতে পারে, নারীও। যদি সমাজ প্রকৃত অর্থে সাম্যের গান গাইত, তবে নারীর জন্য বিশেষ নারী নীতিমালা তৈরি হতো না। অথবা সমাজ যদি নারীর প্রতি প্রকৃত অর্থে শ্রদ্ধাশীল হতো তবে নারী নীতিমালা প্রণয়নে বিতর্ক হতো না। সমাজ নারীকে দেবীর মর্যাদা দিয়ে বেদিতে তুলে দিয়েছে। সঙ্গে শর্ত, মর্যাদা ততক্ষণই যতক্ষণ বেদিতে থাকা। বেদি-স্খলন হলেই নারীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত। বিষয়টি নারীর জন্য দ্বিধাকর। অকর্মণ্য দেবী হয়ে শ্রদ্ধার আরশে কাঁহাতক বসে থাকা যায়? আবার মানুষরূপে ধরণীতে বিচরণ করলে অপবাদের ঝক্কি! সমাজ নারীর জন্য যেন শাঁখের করাত। আসতে কাটে, যেতেও কাটে। নির্যাতিত রুমানা মঞ্জুরের কথাই ধরা যাক। স্বামী হাসান সাইদ বহুল চর্চিত চালে রুমানার চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেছে, তাতে সে সাড়াও পেয়েছে। সমাজ রাতারাতি ‘অসচ্চরিত্র’ রুমানার নাক কামড়ে দেওয়া, চোখ খুবলে নেওয়াকে হালাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। রুমানাকে অসচ্চরিত্র বলেছে মাত্র একজন ব্যক্তি – হাসান সাইদ। বিপরীতে দশ জন রুমানাকে সচ্চরিত্র বললেও লাভ হচ্ছে না। দেশে ফিরেই অন্ধ রুমানাকে প্রেস কনফারেন্সে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে। কী অমানবিক আমরা! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যদি ঘুণাক্ষরেও প্রমাণিত হয় রুমানা দুশ্চরিত্রা, তবে সমাজ সাইদের কৃতকর্মকে যথার্থ মেনে নিয়ে রুমানাকে সমাজ পরিত্যক্ত করতে দেরি করবে না!

অন্যদিকে বিবেকসম্পন্ন অনেকে বলেছেন, শিক্ষিত নারী হয়েও সাইদের মতো ব্যক্তির সঙ্গে কেন সংসার করে যাচ্ছিলেন রুমানা? কেন রুমানা আরও আগে সাইদের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করলেন না? যারা এমন বলেন, তারা কি জানেন না, দেশের অসংখ্য শিক্ষিত, স্বনির্ভর মেয়ে সামাজিক, পারিবারিক রীতি রক্ষার চাপে এভাবেই সংসার করে যাচ্ছে? নারী এমন সম্পর্ক থেকে মুক্তির ইচ্ছা মনে-মুখে পোষণ করলেও সমাজ ও পরিবার নারীকে ধৈর্যশীলা হওয়ার সবক দিয়ে বরাবর নির্যাতন সহ্য করা শিখিয়ে যায়। এরপর হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে থাকা স্বামী দ্বারা নির্যাতিত নারীকে ধৈর্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ঘোষণা করে সমাজ। এরও ব্যতিক্রম আছে। সবাই মেনে নেয় না। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে; জগদ্দল পাথরটাকে নামিয়ে দেয় ঠেলে। এদের নারীবাদী বলে সমাজে; আধুনিকা বলে। কেউ কেউ বলে স্বেচ্ছাচারী। তবে সমাজ শক্তের ভক্ত। নারী দৃঢ়চেতা হলে সমাজের উদ্ধত আঙুল মিইয়ে যায় ক্রমশ। কিন্তু ব্যতিক্রম তো দৃষ্টান্ত নয়। গড়ে নারীরা এভাবে শৃঙ্খল ভাঙতে পারে না। শৃঙ্খল ভাঙার জন্য গড়ে তোলা হয় না নারীদের।

হাসান সাইদের নির্যাতনের বর্ণনাকালে রুমানা বলছিলেন, ‘আমি তো শক্তিতে পারি না!’ রুমানা শারীরিকভাবে দুর্বল কেউ ছিলেন না। দু’জন পূর্ণবয়স্ক, সমর্থ মানুষের মধ্যে ধস্তাধস্তিতে কেবল এক পক্ষই আক্রান্ত হলে আর অন্য পক্ষ আক্রমণ করে গেলে, আক্রান্ত ব্যক্তির যে আত্মরক্ষার নূন্যতম কৌশল জানা নেই তা বুঝতে হবে। পেশিই তো জয় নিশ্চিত করে না লড়াইয়ে; কৌশল আনে বিজয়। নারী অবশ্য কৌশলী হবে তখনই, যখন তার মনোবল গড়ে উঠবে। নিরাপত্তার কথা বলে পরিবার নারীকে আগলে রাখে বিধিনিষেধে; একা চলা নিষেধ, পুরুষ ছাড়া নড়া নিষেধ। রাষ্ট্রও নারীকে নিরাপত্তা দিতে আগ্রহী। তাই নারীর জন্য আইন। অথচ নারীর প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন ঠেকাতে পারেনি পরিবার; পারেনি রাষ্ট্রও। বস্তুত এক ব্যক্তি নিজে যদি মানসিক ও শারীরিক দিক দিয়ে প্রতিরোধে সমর্থ না হয়, তবে কতক্ষণ আর কীভাবে তাকে বিপদমুক্ত রাখবে সমাজ ও রাষ্ট্র? দুঃখজনক হলো, নারীকে আত্মরক্ষায় স্বাবলম্বী হতে বলে না কেউ। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মনোবল জাগানো হয় না নারীতে। মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ নারী এভাবেই শারীরিকভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন দুর্বল থেকে যায়। সহমর্মিতা দিয়ে নারীকে বাঁচানো যাবে না, আইন দিয়েও রক্ষা করা যাবে না নারীকে। পরিবার যদি মনে করে বাহির নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তবে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখায় না কেন? পরিসংখ্যানে নারী নির্যাতনের অসংখ্য চিত্র থাকার পরও নারীকে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে টাঙ্গাইলের ওই কলেজের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার প্রজ্ঞা দেখায়নি কেন রাষ্ট্র?

বাংলা সিনেমায় ভিলেন যদি নায়িকার গলা চেপে ধরে, তবে নায়িকা শ্বাসরোধ না হওয়া অবধি দু’হাত দিয়ে কেবল ভিলেনের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যায়। প্যাঁচ কষে উল্টো ভিলেনকেও যে আক্রমণ করা যায়, সে দৃশ্য সিনেমায় দেখানো হয় না। নারীকে এভাবে অবলা বানিয়ে রাখা দৃশ্যের পরিবর্তন চাই আশু। আত্মরক্ষায় নারীকে চাই সবলারূপে।

***
ছবি সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ০৮-১১-২০১০

***
লেখাটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে: দৈনিক সমকাল, ২৬ জুন ২০১১

_______________________________________
সাম্প্রতিক খবর:
১. মৃত্যুকেই বরণ করলো লাকী, জুন ২৫ ২০১১
২. ৩য় শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা, জুন ২৬ ২০১১
৩. স্কুলছাত্রীকে অপহরণের পর গণধর্ষণের অভিযোগ, জুন ২৭ ২০১১
৪. সুনামগঞ্জে স্ত্রীকে হত্যা, জুন ২৭ ২০১১
৫. আমি বাঁচতে চাই…, গৃহবধূ তানজিনা আক্তার রেখা (২২) -কে নিয়ে ম, সাহিদ এর ব্লগ পোস্ট
________________________________________
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×