নয়.
একুশ বছর আগে আমি যখন দেশ ছাড়ি তখন ফার্মগেইট থেকে শাহাবাগ যেতে বাস ভাড়া লাগত তিরিশ পয়সা। কত দিন আমি হেটে হেটে পার হয়েছি সোনার গাও, বাংলা মটর, ইস্কাটন! শাহাবাগে গেলেই কেউ একজন হয়ত বলত কিরে বেটা তোরে দেখলামত এগারনম্বরে কইরা আইতাছস। সময়টা তখন আসলেই খারাপ ছিল। সেদিন মিল্টন ভাই'র সাথে কথা হলো প্রায় সে কতো বছর পর! উনি জিজ্ঞেস করলেন, হেলাল মনে আছে তোর বাড়ী যাবার জন্য তিরিশ পয়শা খুজতি? মনে না থাকার ত কিছু নাই। এখনকার ডি জুস, নন ডি জুস ছেলেমেয়েরা এসব শুনলে টাশকি খাবে জানি! তখন সময়টা আসলেই অন্যরকম ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়ে মত জীবন তখন আমাদের এতো কিছু মোটেই অফার করেনি কোন দিন।
ঢাকা শহরে আমি তেমন বের হই না প্রয়োজন ছাড়া। যে দিন ই একা একা এদিকওদিক যাই কেবল চারপাশের পাল্টে যাওয়া দেখি। অবাক হবো কিনা বুঝতে পারি না, শুধু চেয়ে থাকি। আনু মুহাম্মদ স্যারের সাক্ষাৎকার নিতে জাবিতে যেতে হয়ে ছিল কিছু দিন আগে কখন যে সাভার পার হয়ে গেল গাড়ী টের পেয়েছিলাম পার হয়ে যাবার পর। এ শহর যেনো মানুষের বোঝা নিয়ে নিজে নিজেই হাটা শুরু করেছে এক দিকে!
গুলশান বনানী'র দোকানপাট রেস্তোরায় ঢুকলে মনে হয় না এ শহরে মানুষ রোড ডিভাইডারেও রাত্রী যাপন করে। কফি শপ গুলোতে ঢুকলে মনে হয় সেন্ট ক্যাথরীন, ডানফোর্থ কিম্বা জ্যাকসনহাইট্সের কোন স্টারবাক্স কিম্বা ডাংকিন ডোনাটে ঢুকে পড়লাম বুঝি। পিজা দোনিনি, কে এফ সি, পিজা হাট এ পোলাপাইনের ভীড় দেখলে আমার এখনো আউলা লেগে যায়; কেবল আমার বাস ভাড়া তিরিশ পয়সার কথা মনে পড়ে!
বেনু সাহেবের ছেলে আরকিটেক্ট আশিক ইমরান আমাদের নিয়ে ঢুকলেন বনানীর এক কফি শপে। টেলিফোনে ওই দিন যেমন প্রশ্ন করছিলেন আমার এই প্রজেক্টের ফাইনান্স করছে কে, কোন বিদেশী ফান্ডটান্ড আছে নাকি এই ধরনের জেরা টাইপ কথা আর তিনি করলেন না। বরং ব্যাবহারে তিনি আন্তরিক হলেন। বয়সে তরুন আশিক, অফিস থেকে বের হয়ে হেটে আসতে আসতে আশপাশের বেশ কটি নাম করা স্থাপনা দেখাতে দেখাতে বলছিলে কোন কোন কাজ গুলো তার করা। আমাকে বললেন, হেলাল সাহেব কি খাবেন বলুন? দেখলাম এখানে ওরা এক্সপ্রেসো বেচে। ভাবলাম ট্রাই করা যাক ঢাকার এক্সপ্রেসো। আমি বললাম ভাই একটা এক্সপ্রেসো খাওয়ান, আর আপনের বাবার সাথে দেখা করার একটু বন্দবস্ত করে দেন। আশিক সাহেবের মুখটা কেমন যেনো ম্লান হয়ে উঠল, একটা নিঃশ্বস ফেলে বললেন অপরাজেয় বাংলা নিয়ে আমাদের পরিবারের এক ইমোশনাল গল্প আছে। আমার বাবা অভিমানে ঢাকা ছেড়ে দিনাজপুর চলে গেছেন। আঁকাঅাকি পর্য্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন সে অভিমানে। জানি না তিনি আপনাদের সাথে কথা বলতে রাজী হবেন কিনা!
আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কি ভাবে পার করতে হয় এমন সিচুয়েশন, মানুষের ইমোশন নিয়ে এমন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় কি বলতে হয় আমি জানি না। বললাম, ভাই আপনি যদি আমাকে কিছু বলতে চান বলতে পারেন। আশিক বললেন, বুয়েটে পড়া অবস্থায় বাবা মা দিনাজপুর থাকতেন। কত দিন মন খারাপ হলে বাবার কথা মনে হলে এই অপরাজেয় রাংলার কাছে এসে বসে থাক তাম। ভাবতাম এইত বাবা আছেন। বাবার কাছে বাবার তৈরী সৃষ্টির কাছে বসে থাকলে মনে শান্তি পেতাম। এই অপরাজেয় বাংলা নির্মানে আমার বাবার রক্ত ঘাম জড়িয়ে আছে। অথচ কেউ তার মূল্যায়ন কলল না। কাউকে যদি বলি আমার বাবার কথা কেউ তা জানে না! অপ্রস্তুত লাগে তখন। অথচ আমি গর্ব করে মানুষের কাছে বলতে চাই ঐটা আমার বাবা। এই মহান কীর্তি নির্মানে আমার বাবারও অবদান আছে, অথচ সে কথা আজ আর কেউ জানে না।
সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের কাছে বদরুল আলম বেনুর কথা শুনেছি অনেক। বদরুল আলম বেনু অপরাজেয় বাংলার প্রজেক্টে শুধু এক জন মডেলই ছিলেন না ছিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের একান্ত সহযোদ্ধা। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ পর্য্যন্ত সকল চড়াই উৎরাইতে শিল্পী আবদুল্লাহ খালিদের সাথে যে দুই জন সর্বান্ত ভাবে জড়িত ছিলেন তার এক জন হলেন তৎকালিন চারুকলার ছাত্র বদরুল আলম বেনু আর অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ঢাকসু'র সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদ। বাইরে থেকে এ সকল গল্পের কতটুকুই বা আমরা জানি!
এক্সপ্রেসোর কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে আমি বলি ভাই আমাকে আপনার বাবার কথা শুনতেই হবে, দয়া করে আমাকে একটু সুযোগ করে দেবেন প্লীজ। তিনি বলেন, ভাই এর আগেও কেউ কেউ এসে ছিলেন কথা বলে গেছেন খোজ খবর করে গেছেন কিন্তু কেউ আমার বাবার কথা কোথাও লেখেনি বলেনি! আমাদের খুব বাজে অভিজ্ঞতা আছে এসব নিয়ে, আমরা চাই না বাবা আবারো কোন কষ্ট পায়। আমি বলি ভাই, সেই অর্থে আমি কোনো সাংবাদিক নই, ঢাকার কোন টিভি অলা নই। বিদেশে থাকি। কাজ কর্ম সকল কিছু ছেড়ে পড়ে আছি এখানে; আমাকে কেউ দুটি পয়শা দিয়ে সাহাজ্যও করবে না। হতে পারে একেবারেই কাঁচা কোনো অনুভূতি তবুও দীর্ঘ পরবাসের কারণেই কিনা জানি না নিজের দেশ মাটির জন্য মোটা দাগের কিছু অনুভব কাজ করে। জানি এসব অনুভবের কোন বাজার মূল্য নেই, কিন্তু কি করবো ভাই আমার ভাবনার ক্ষমতা যে এই টুকুই।
আশিক ইমরান স্মিত হাসি মুখে এনে বললেন, ভাই আমার বাবাও হয়ত তাঁর বহু দিনের জমানো কথা আপনার মাধ্যমে বলতে পারলে একটু হালকা হতে পারবেন। বাবার কথা মানুষকে বলবার আমরাও হয়ত একটু সুযোগ পাবো আপনার এ কাজের মাধ্যমে। আপনি চিন্তা করবেন না আমি বাবাকে দিনাজপুর থেকে অনবার ব্যাবস্থা করছি। আমি আপনাকে ফোন করবো। ঢাকার বনেদী কফি শপের বিশ্বাদ এক্সপ্রেসোটি এক চুমুকে শেষ করে বেনু সাহেবের ছেলে আশিক কে বললাম থ্যাংন্কস্ ফর ইওর ট্রীট, আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগল। সি ইউ সুন।
আমরা যখন ফ্লাইওভার ক্রস করছি শান্ত তখন জিজ্ঞেস করল, আন্কেল এখন কোথায় যাবো? আমি বলি, বাবু আমাকে একটু ফার্মগেইট নামায়া দাও। আজকে আমি বাসে চইড়া শাহাবাগ যাবো।
(ছলিবেক)
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ১: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ২: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৩: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৪: অপরাজেয় বাংলা মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৫: অপরাজেয় বাংলামূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৬: অপরাজেয় বাংলা
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৭ : অপরাজেয় বাংলা
মূর্তি লইয়া আমার প্রামান্য কথন ৮ : অপরাজেয় বাংলা
ওয়েব ঠিকানা, অপরাজেয় বাংলা