আশির দশকের ঠিক কোন সময়ে আমার মনে নেই। তবে সময়টা ছিল আমাদের কৈশোর পেরোনো কোন এক সময়। বাংলাদেশের টেলিভিশন দর্শকের কাছে হুমায়ুন আহমেদ তখন এক হ্যামিলনের বাঁশি ওয়ালা! তিনি যা ই লিখছেন তা ই আমাদের কাছে অভূত দৃশ্য অন্যন্য একটা কিছু! আমরা সবাই তখন এক হুমায়ুন আহমেদের একনিষ্ঠ ভক্ত অনুরাগী। ঠিক সেই সময়ের কথা, এখন মনে পড়ছে না সম্ভবত প্রতি পনর দিনে এক বার প্রচারিত হত এক ঘন্টার ধারাবাহিক কোথাও কেউ নেই। নিম্ন মধ্যবিত্ত কেরানী মামা'র দুখের সংসারে মা/ বাবাহীন অনাথ দুখি এক মুনা আপা আর তার স্কুলে পড়ুয়া দুই শিশু মামাত ভাইবোন আর মহল্লার সেই ছন্নছাড়া দূর্ভাগা বাকের ভাই। আহা আমাদের নিরিহ কৈশোর জুড়ে সেই সব চোখে জল আসা গল্প! হুমায়ুন আহমেদ, আজকালকার অনেক দর্শকের কাছেই তার হয়ত আর তেমন বেইল নাই। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ আপনি একদা আমাদের যা দিয়ে ছিলেন আমরা তা ভুলব না কোন দিন। এমন কি গত বছরের ঈদের সেই বহুল আলোচিত নাটকটি পর্য্যন্ত (এ মুহুর্তে নামটি ঠিক মনে পড়ছে না) একমাত্র আপনার কাছে যা পেয়েছি সে কারনেই আজীবন আপনাকে স্যালুট বস।
দেশ টিভি ঈদ উপলক্ষে তাদের অনুষ্ঠান মালায় সাত পর্বের একটা অদ্ভুত ধারাবহিক প্রচার করছে। ঈদের দিন থেকে পর পর সাত দিনে সাত পর্ব প্রচার চলছে। হুমায়ুন আহমেদের কালজয়ী সেই সব চরিত্র মিসির আলী, হিমু, বাকের ভাই ও মুনা ইত্যাদি পুনরায় ফিরিয়ে আনার এক দূর্বার প্রয়াস। ভাই ব্যারাদর ড্রামাবাজদের একজন রেদোয়ান রনি'র কাঁধে বন্দুক রেখে আসাদুজ্জামান নূরের দেশ টিভি গত ক'দিন ধরে প্রচার করছে সেই সময়ের চরিত্র গুলোর এই সময়ের কাল্পনিক চিত্রায়ন। খুব আগ্রহ আর আবেগ নিয়ে গত তিন দিন চেষ্টা করেছি দেশ টিভি'র এই অভিনব এ প্রযোজনাটি দেখবার। গতকাল দশ মিনিটের মত দেখতে পেরেছিলাম পরশু রাতে সম্ভবত মিনিট পাঁচেক আর আজ চেষ্টা করে পুরো এপিসোডটাই দেখেছি। রাত পোনে দশটার সময় শুরু হয়ে শেষ হল রাত এগারোটায়। দীর্ঘ্য এই সোয়া এক ঘন্টায় নাটকটি দেখানো হয়েছে সম্ভবত সাকুল্যে ২২/২৪(ভুল*) মিনিট কিম্বা তার ও কম হতে পারে। বাদবাকী প্রায় পঞ্চাশ মিনিট বা ততোধিক কিস্তিতে কিস্তিতে পর্দাজুড়ে শুধুই বিজ্ঞাপন বানিজ্য! আর এই বানিজ্যের পুরো পুজিঁটাই ছিল হুমায়ুন আহমেদ ও তার সৃষ্ট কিছু চরিত্র মিসির আলী, হিমু, বাকের ভাই, মুনা, বহুবৃহী নাটক নাকি আজ রবিবার নাটকের বোকারাম সেই চাচা চরিত্র'র নাম ভাঙ্গানো। হুমায়ুন আহমেদ এর নাম ও তার সৃষ্ট চরিত্র গুলোকে স্মরন কালের স্মরনাতীৎ ভাবে বেচা দিয়েছে এই ঈদের বাজারে দেশ টিভি।
যতদূর জানি ঈদের দিন গুলো উপক্ষ্যে মিনি ধারাবাহিক নাটকের প্রথম নির্মাতা বা এধরনের কনসেপ্ট এর প্রবক্তা ও হুমায়ুন আহমেদই স্বয়ং। এবার ঈদে দেশ টিভি'র অন্যতম চমক হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় চরিত্র গুলো'র খিচুড়ি এখন পর্যন্ত যারা গলাধকরন করেছে তারা অনেকেই হয়ত আমার সাথে এক মত হবেন যে দেশ টিভি কাজটি ভাল করে নাই। বাকের ভাই মুনা কিংবা ধেন্দা মার্কা বড় চাচা চরিত্র ছাপিয়ে হুমায়ুন আহমেদের অনন্য সৃষ্টি দুটো চরিত্র মিসির আলী ও হিমু কে নিয়ে দেশ টিভি'র পৃষ্ঠপোষকতায় যে সার্কাস এবার ঈদে দেখতে হল তা দুঃখজনক। রাগে দুঃখে স্বয়ং হুমায়ুন আহমেদ চ্যানেল কতৃপক্ষের এহেন কর্মকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানলাম।
নিন্দুকেরা সবসময়ই বলেন হুমায়ুন আহমেদ হলেন আজীবনের ড্রামাবাজ! বাকের ভাইয়ের ফঁাসি নিয়ে সেই সময়ের আলোচিত মিছিলটিও নাকি তিনি করিয়েছিলেন প্রপাগান্ডা করার জন্য। কৈশোরে এত কিছু ত আর জানতাম বুঝতাম না! সব কিছু ছাপিয়ে কেবল মনে আছে বছরের আলোচিত ফঁাসি এমন শিরোনামে সাপ্তাহিক বিচিত্রার সেই কভার স্টোরিটি'র কথা। আসাদুজ্জামান নূরের মুখের ক্লোজআপ আর তার উপর ফাঁসির দড়ি! কাল বিকেলে টিভি'র এক সাংবাদিক বন্ধু কে জিজ্ঞেস করলাম, কি মিয়া হুমায়ুন আহমেদ'র ব্যাপারটা আসলে কি কনত। উত্তরে আমার বন্ধু বলল্লেন, আরে ঐ ব্যাটা মিয়া পাগল হইয়া গেছে। সারা দিন মাল খায় আর এর অর পিছে লাগে। আপনেরা ত জানে না ব্যাটা বহুত খচ্চর। কেউ পোছে নাত এখন। দেখেন না প্রথম আলো তার প্রতিবাদটাও ছাপে নাই। ছাপবনাত, সবতে এখন তার থেইকা দূরে থাকে খালি কিছু চামচা ছারা। বন্ধুটি আরো জানালেন প্রথমে নাকি হুমায়ুন আহমেদ একরকম মৌখিক অনুমতি দিয়েছিলেন পরে দেশ যখন প্রমোশনাল তাদের চ্যানেলে দেখানো শুরু করল তখন একবার তিনি আপত্তি করলে তারা প্রমোটা ক'দিন বন্ধ রাখে। পরে কেম্নে কি হইছে সেটা আর সে জানে না।
মনটাই শালার খারাপ হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে এই লেখাটা লিখতে বসেছিলাম কাল। অর্ধেক লিখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম কি আর লিখব! হুমায়ুন আহমেদের লেখালিখি বা নির্মানে অনেক দিন থেকেই নয় নম্বর বিপদ সংকেত চলছিল। তার সেই একচ্ছত্র প্রভাব এখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে সেটাও জানি। তবুও আমি তাকে পুছি। বাংলাদেশের টিভি দর্শক যদি স্মৃতি ভ্রষ্ট কিংবা উন্মাদ না হয়ে যান হুমায়ুন আহমেদকে আজো তাদের পুছতেই হবে। হুমায়ুন আহমেদকে রীমিক্স করে বেচতে পেরে দেশটিভি'র হয়ত এবারের ব্যাবসা ভালই হল। জানি না হুমায়ুন আহমেদ এর মানহানি'র দফারফা শেষমেষ কোথায় গিয়ে ঠেকে! তবে এই ক্যাচালে যে জিনিস স্পষ্ট তা হচ্ছে হুমায়ুন আহমদ এর মিসির আলী আর হিমু'র ধারে কাছে পৌছাতে এখনো ভাইব্যারাদরদের মাটির নীচে শরীর ঢুকাইয়া আরো বহু বছর জোৎস্না রাইতের গান শোনা বাকী আছে...
* একটা তথ্য ঠিক করবার আছে, আজ দেশ টিভিতে এই খিচুরির পঞ্চম পর্ব প্রচারিত হল। আজ লক্ষ্য করলাম কালকে আমার হিসেব ভুল ছিল। আসলে এই খিচুড়ির প্রতি পর্বের ধৈর্ঘ্য হল টাইটেল সহ ৫+৫+৫=১৫ মিনিট। বাদ বাকী ১৫+১৫+১৫= ৪৫ মিনিট হল বিজ্ঞাপন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১:২০