somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

লক্ষণ ভান্ডারী
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন

আমার ঠাকুর শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দ্র

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




দেওঘর সত্সঙ্গ বিহার
পরমপ্রেমময় শ্রী শ্রী অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম।

শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের দিব্য বাণীগুলো প্রাত্যাহিক জীবনে কাজে লাগাতে পারলে তাহলে আদর্শ একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন কোন কাজ নয়।

প্রত্যাগমনহীন আগমন ।।
জ্ঞান গরিমায় গরবিনী আর্য্য ভারতবর্ষের অখণ্ডতা রক্ষার কথা জনে জনে বলেছেন । মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার নেতাদের সাথে কথা বলেছেন সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি নিরসনের জন্য । হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার নাম বদলে আর্য্য মহাসভা রাখতে । মুসলমানরাও আর্য্য । তাদেরও আর্য্য মহাসভার সদস্য করতে হবে । আরবী শিখে কোরান পাঠ করতে হবে । লীগ যদি ইসলাম বিরোধী কিছু করে প্রীভি কাউন্সিলে শত শত কেস করতে হবে মহানবীর আদর্শ বাঁচাতে । আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে মুসলমানদের, মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে হিন্দুদের স্থানান্তর করে সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে । এই যদি করে ফেলতে পারেন দেখবেন দেশ ভাগ হবে না । এজন্য টাকার অভাব হবে না । বড় বড় জমিদারদের বোঝান । তাদের সাহায্যে এ কাজ আপনি করতে পারবেন । অত বড় বাবার ছেলে আপনি । আমি আমার সব কিছু দিয়ে আপনাকে সহায়তা করব । আমাদের চেষ্টার ত্রুটিতে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে যদি দেশ ভাগ হয়, তা'তে হিন্দু মুসলমান উভয়ের ক্ষতির সম্ভাবনা ।
কথাচ্ছলে পবিত্র বাইবেলের অনেকানেক বাণীর উপমা দিতেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র । প্রভু যীশুর একটি বাণী, "Be a Philanthropist, you will see all are philanthropist."
(লোকহিতৈষী হও, দেখবে সকলেই লোকহিতৈষী হয়েছে । )-কে বাস্তবায়নের মহাসুযোগ এসে গেছে হাতের সামনে । আর্য্যকৃষ্টির বর্ণাশ্রমানুগ মহান ঐতিহ্যের অনুশাসনের নবীকরণ করে বৃহত্তর আর্যাবর্তের লোকেদের সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ধর্মপ্রাণ এক রাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপদে রাখার প্রচেষ্টায় দৈনন্দিন জীবনে পঞ্চমহাযজ্ঞের প্রবর্তন করলেন ইষ্টভৃতি মহাযজ্ঞের মাধ্যমে। যার উদ্দেশ্য ছিল ইষ্টভরণ, পিতৃপোষণ, পরিস্থিতির উন্নয়ন । অর্থাত্‍ ইষ্ট ঈপ্সিত মঙ্গল কর্মের মাধ্যমে বৃহত্তর পরিবেশকে রক্ষা করে পিতৃপুরুষের গৌরবকে অক্ষুণ্ণ রাখার শপথ গ্রহণ ।
আর্য্য শাস্ত্র মনু সংহিতায় বর্ণিত "ইদং স্বস্ত্যয়ন" সু অস্তি অয়ন (সুন্দরের বা সতের বিদ্যমানতাকে ধারণ করে রাখার পথ ।) মন্ত্রকে নবীকরণ করতে প্রবর্তন করলে স্বস্ত্যয়নী ব্রতবিধির । যদিও স্বস্ত্যয়নীর প্রবর্তন করেন প্রথমে, ১৯৩৭ বঙ্গাব্দে । ইষ্টভৃতি ১৯৩৮-এ । সত্সনঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী মর্মার্থের সাথে পরিচিত নাহলেও 'স্বস্ত্যয়নী'র তুলনায় 'ইষ্টভৃতি' নামের সাথে বেশীরভাগ সংঘকেন্দ্রিক জনেরা যেমন পরিচিত, তেমনি সাধারণ লোকেরা ঠাকুরের নামে টাকাপয়সা রাখার মাধ্যম হিসেবে 'ইষ্টভৃতি' শব্দকে জানেন । তাই 'ইষ্টভৃতি'-অপলাপী অনুচিত কর্ম করে ফেলেছি । এজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।
যাইহোক 'ইষ্টভৃতি'কে উপস্থাপনা করার চেষ্টা করে, পরে 'স্বস্ত্যয়নী' নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব ।

শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায়
"ঈশ্বর-অনুধ্যায়িতা নিয়ে
গণহিতী অনুচর্য্যায়
তাদের যে অনুগ্রহ-অবদান অর্জ্জন কর,
সেই অবদান হ'তে
শ্রদ্ধানুস্যূত অন্তঃকরণে
স্বতঃস্বেচ্ছায় তোমার ইষ্টকে যা নিবেদন কর,
তাই-ই কিন্তু তোমার শ্রেষ্ঠ ইষ্টভৃতি ।"
(ধৃতি-বিধায়না, ১ম খণ্ড, বাণী সংখ্যা ৩০৬)

অর্থাত্‍, বর্ণানুগ কর্মের সেবার মাধ্যমে, বৃহত্তর পরিবেশে, ঘটে ঘটে ইষ্ট স্ফূরণের বা মঙ্গল প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকার বিনিময়ে অযাচিত প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পদকে বলা হয়েছে অনুগ্রহ অবদান । তা থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ ইষ্টের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে হবে ।

"জীবে প্রীতি বিতরণ করে যেই জন,
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ।"
এই হল ঈশ্বর অনুধ্যায়িতার স্বরূপ ।
বর্ণানুগ কর্ম এবং ঈশ্বর অনুধ্যায়িতা ব্যতীত ইষ্টভৃতি বাস্তবায়িত হয় না ।
ইষ্টভৃতির নামে শুধুমাত্র ইষ্টের প্রীতির জন্য কাউকে পীড়িত না করে নিজে পীড়িত না হয়ে বর্ণানুগ কর্মের সেবা মাধ্যমে আহরিত অর্থ 'দিন গুজরানী আয়'-কেই ইষ্টভৃতির অর্ঘ্য হিসেবে নিবার্চিত করেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর । ওই নির্দেশ অনুসারে ইষ্টার্ঘ্য আহরণ করার মধ্যেই প্রীতি, মৈত্রী ও ঐক্যের বীজ বপন করে দিয়েছেন । প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন আর্য্যকৃষ্টির সদাচার এবং বর্ণাশ্রম ধর্মকে । ওই ইষ্টার্ঘ্য ইষ্টকে দিতে হবে । তিনি তা দিয়ে PHILANTHROPICAL WORK বা সব্যষ্টি সমষ্টির মধ্যে ভাগবত ঐক্য স্থাপন দ্বারা গণহিতৈষণা কর্ম করবেন । ইষ্টভৃতির দাতা এবং গ্রহীতার মেলবন্ধনে গড়ে উঠবে পরম রাষ্ট্রিক সমবায় । এই ছিল ঠাকুরের পরিকল্পনা । সেই উদ্দেশে স্থাপন করেছিলেন ফিলানথ্রপি কার্যালয় । মাসান্তে ওই অর্ঘ্য পাঠাতে হবে ইষ্টসকাশে । ইষ্টের নামে প্রেরিত ওই অর্ঘ্য গৃহীত হতো ফিলানথ্রপিতে । পাঠাবার পর দুজনকে ভ্রাতৃভোজ্য দিতে হবে । এর মাধ্যমে প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করলেন । দেশের অর্থনীতিকে করলেন সমৃদ্ধ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুশ্রুতি গ্রন্থে ইষ্টভৃতির বিষয়ে বললেন :

"দিন গুজরানী আয় থেকে কর
ইষ্টভৃতি আহরণ,
জলগ্রহণের পূর্ব্বেই তা'
করিস্ ইষ্টে নিবেদন;
নিত্য এমনি নিয়মিত
যেমন পারিস ক'রেই যা'
মাসটি যবে শেষ হবে তুই
ইষ্টস্থানে পাঠাস্ তা';
ইষ্টস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে
আরো দু'টি ভুজ্যি রাখিস্,
গুরুভাই বা গুরুজনের
দু'জনাকে সেইটি দিস্;
পাড়া-পড়শীর সেবার কাজে
রাখিস কিন্তু কিছু আরো,
উপযুক্ত আপদগ্রস্তে
দিতেই হ'বে যেটুকু পার;
এসবগুলির আচরণে
ইষ্টভৃতি নিখুঁত হয়--
এ না-ক'রে ইষ্টভৃতি
জানিস্ কিন্তু পূর্ণ নয় ।"
ইষ্টভৃতিকেন্দ্রিক পূর্বোক্ত বাণীর মাধ্যমেও পরিস্ফূট হয়েছে সপারিপার্শ্বিক জীবনবৃদ্ধিদ ভাগবত ঐক্যের পরমবার্তা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত ইষ্টভৃতি নিবেদন মন্ত্রের ".....ইষ্টভ্রাতৃভূতযজ্ঞৈস্তৃপ্যন্তু পারিপারর্শ্বিকাঃ ।।" উচ্চারণ করার সাথে সাথে বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকের জীবনবৃদ্ধির দায়ভারের শপথ নিতে হয় আমাদের । সব অবস্থাতে বাস্তব কর্মে বৃহত্তর পরিবেশের জৈবাজৈব সবকিছুকে পালন-পোষণে সমৃদ্ধ করে রাখার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সার্থক হয় ইষ্টভৃতি পালন ।
যদিও ইষ্টভৃতি প্রচলনের পূর্বে সত্যানুসরণের "তুমি তোমার, নিজ পরিবারের, দেশের ও দশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী ।" বাণীতে অনুরূপ দায়ভার দিয়েই রেখেছিলেন ব্যষ্টি ও সমষ্টি উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে ।
এ তো গেল ইষ্টভৃতি আহরণ ও নিবেদনপর্ব । এর পর রয়েছে প্রেরণপর্ব । প্রেরণ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর স্পষ্ট নির্দেশ করে দিয়ে বলেছেন :
ইষ্টভৃতি ইষ্টকেই দিস
করিসনা তায় বঞ্চনা ।
অন্যকে তা দিলেই জানিস
আসবে বিপাক গঞ্জনা ।।
অর্থাত্ ইষ্টভৃতি ইষ্টেরই প্রাপ্য, অন্য কারও নয়.
আবার আমাদের প্রবৃত্তির সব বিপাক থেকে মুক্ত করতেই--
স্বস্ত্যয়নী মুক্তি আনে/রাষ্ট্রসহ প্রতি জনে.—বাণীর ভরসা দিয়ে
পঞ্চনীতি সমন্বিত স্বস্ত্যয়নী ব্রতের প্রবর্তন করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর।
১. শ্রীবিগ্রহের মন্দির ভেবে
যত্ন করিস শরীরটাকে,
সহনপটু সুস্থ রাখিস
বিধিমাফিক পালিস তাকে ,
২. প্রবৃত্তি তোর যখন যেমন
যেভাবেই উঁকি মারুক,
ইষ্টস্বা্র্থ প্রতিষ্ঠাতে ঘুরিয়ে দিবি
তার্ সে ঝোক.
৩. যে-কাজে যা ভাল বলে
আসবে মনে তত্ক্ষণা্ত্
হাতে-কলমে করবি রে তা
রোধ করে দার সব ব্যাঘাত.
৪. পাড়াপড়শীর বাঁচা-বাড়ায়
রাখিস রে তুই স্বার্থটান,
তাদের ভালয় চেতিয়ে তুলিস
ইষ্টানুগ করে প্রাণ.
৫. নিজের সেবার আগেই রোজই
শক্তি মত যেমন পারিস,
ইষ্ট অর্ঘ্য ভক্তিভরে
শুচিতে নিবেদন করিস ,
এই নিয়মে নিত্যদিন
প্রতি কাজেই সর্ব্বক্ষণ
স্বস্ত্যয়নীর নিয়মগুলি
পালিস দিয়ে অটুট মন ,
ত্রিশটি দিন পুরে গেলে
মাসিক অর্ঘ্য সদক্ষিণায়
ইষ্টভোজ্য পাঠিয়ে বাকি
মজুত রাখবি বর্দ্ধনায় ,
চিরজীবন এমনি করে
ইষ্টস্থানে হয় নিরত,
তাকেই বলে স্বস্ত্যয়নী
সবার সেরা মহান ব্রত।
এই বাণী থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হলো, যে জড়-পদার্থে নির্মিত মন্দিরের পরিবর্তে নিজ-নিজ দেহটাকেই শ্রীবিগ্রহ মন্দির জ্ঞানে পবিত্রতার সাথে রক্ষা করতে হবে, যেহেতু এই দেহের মধ্যেই পরমাত্মার আবাস। ভোগ, দুর্ভোগ, উপভোগ, মুক্তি, পরামুক্তি, পরাগতি সবকিছুই এই দেহের মধ্যেই। যা নাই ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে এই দেহভাণ্ডে। আমাদের আর্য্য শাস্ত্রাদিতেও একথার উল্লেখ রয়েছে। শ্রীশ্রীঠাকুর জীবাত্মার মধ্যে সুপ্ত পরমাত্মাকে জাগাতে বলেছেন নামের মাধ্যমে। ৫টি কর্মেন্দ্রিয়, ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন, বিবেক, জীবাত্মা, পরমাত্মাদির সমন্বয়ে সৃষ্টি এই দেহমন্দিরকে পবিত্র রাখার, সুস্থ-স্বস্থ রাখার ভাগবত-বিধির পালন-পদ্ধতি সহজভাবে বিধায়িত করেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর এই ব্রতের মাধ্যমে। তিনি কোনদিন ভুলেও তাঁর মন্দির নির্মাণের কথা বলেন নি। কথা-প্রসঙ্গে গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। তথাপিও কেন জানি আমরা বহুনৈষ্ঠিক-মন্দিরকেন্দ্রিক হয়ে স্বস্ত্যয়নী-বিধি অপলাপী চলনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
যাইহোক, স্বস্ত্যয়নীর পঞ্চম নীতিতে দৈনন্দিন অর্ঘ্য নিবেদনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জমা অর্ঘ্য থেকে সদক্ষিনায় ৩টাকা (১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দের ৩টাকা, বর্তমানে কত হতে পারে আন্দাজ করে নিতে হবে। ) ইষ্ট-সকাশে পাঠিয়ে অবশিষ্ট নিজের কাছে মজুত রেখে তা দিয়ে ইষ্টোত্তর সম্পত্তি করতে হবে। ওইসব সম্পত্তির আয়ের এক-পঞ্চমাংশ সেবায়েত হিসাবে ব্রতধারী ভোগ করতে পারবে, কিন্তু রাষ্ট্র বিপন্ন হলে ওইসব সম্পত্তি রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে বিনিয়োগ হবে.
শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে প্রেরিত ইষ্টার্ঘ্য থেকে একটি পয়সাও তিনি নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করেন নি। আদর্শ রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে হিমায়েতপুর আশ্রমকে গড়ে তুলতে এবং রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার কাজে ব্যয় করেছেন। তত্কালীন নেতৃবর্গ কথা দেওয়া সত্তেও শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশিত পথে দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন নি, তিনি কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেননি। পাবনা সংলগ্ন সব্বাইকে সেদিন রক্ষা করেছিলেন. ১৩৫০ সালের মহা-দুর্ভিক্ষের সময়েও আশেপাশের গ্রামের কাউকে অনাহারে মরতে দেন নি. স্বস্ত্যয়নীর ইষ্টোত্তর জমি এবং সোনার বিনিময়ে মাটি কিনে রাখা জমির ফসল দিয়ে রক্ষা করেছিলেন বৃহত্তর পাবনার ক্ষুধাপীড়িত মানুষদের।
তথাপিও আশ্রমের ভেতরে-বাইরের উপকৃত মানুষেরাই ঠাকুরের শত্রুতা করেই চলছিল। খুন হল আশ্রমের কর্মী, তপোবনের ছাত্র. পিতৃ-বিয়োগ, দেশবন্ধু-বিয়োগ, মাতৃ-বিয়োগ, আবাল্যের সাথী মহারাজ-কিশোরীমোহন-দের বিয়োগ-ব্যথায় ব্যথাহারী আজ ব্যথিত।
১৩৫৩ সালের প্রথম দিকে মুসলিম লীগের ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে‘ ঘোষিত হবার সাথে সাথে কলকাতায় যে পৈশাচিক হত্যালীলা হয়ে গেল সে সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে উঠলেন ঠাকুর। দেশ-নেতাদের আগাম সতর্ক করা সত্ত্বেও, প্রতিরোধী-ব্যবস্থাপত্র দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। বিপন্ন দেশবাসীদের রক্ষা করতে না পারার বেদনায় বিপর্যস্ত। বেড়ে গেল রক্তচাপ. হয়ে পড়লেন অসুস্থ। খবর শুনে পাবনার বিশিষ্ট মুসলমান নেতৃবৃন্দ ঠাকুরকে দেখতে আসেন, পাবনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে দেবেন না বলে আশ্বস্ত করেন। একটু সুস্থ বোধ করেন, আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠাকুরের প্রিয় কলকাতার বিশিষ্ট চিকিত্সক ডাঃ গুপ্ত প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যান। বাঁধের ধারে নিভৃত নিবাসের মনোরম পরিবেশে ঠাকুরের বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন ঋত্বিগাচার্য্য। চাপমুক্ত রাখতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ করে দেন। কিন্তু ঠাকুর রাজী হন না। মনের কথা, প্রাণের ব্যথা নিয়ে যারা যারা আসবে, তাদের তিনি কিছুতেই ফেরাতে নারাজ। আগন্তুকদের দুঃখ-বেদনার কথা শুনতে শুনতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে ডাঃ গুপ্ত আসেন, ঠাকুরকে দূরে কোথাও বায়ু পরিবর্তনের জন্য নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন।
অবশেষে আশ্রম কর্তৃপক্ষ ঠাকুরকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঠাকুর বিহার প্রদেশের দেওঘরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
“৩০শে আগষ্ট (১৯৪৬) শ্রীশ্রীঠাকুর পাবনা শহরের হিন্দু-মুসলমান নেতৃবর্গকে ডেকে অনুমতি চান দেওঘর যাওয়ার. তখন সবার কাছ থেকে, বিশেষতঃ মুসলিম নেতা হাকিম সাহেবের কাছে অনুমতি নেন ও কথা কাড়িয়ে নেন যাতে তিনি আশ্রমের সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন. প্রসঙ্গতঃ ঠাকুর বলেন—হাকিম সাহেব! এখন আমার বাইরে যাবার সময় নয়. আমার মার নামে-- ‘মনমোহিনী ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স য়্যাণ্ড টেকনোলজি‘ কলকাতা ইউনিভার্সিটির অধীনে নূতন কলেজ হয়েছে আমার. কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির পরিকল্পনা আমার আজন্মের. সেই সুযোগ হাতে এসে গেছে আমার. কেষ্টদা (ভট্টাচার্য্য) হচ্ছেন কলেজের প্রিন্সিপাল. কেষ্টদা সঙ্গে না থাকলে তো আমি কানা. তাই কেষ্টদাকে সঙ্গে নিয়ে যাব. আমার এই বাচ্চা প্রিন্সিপাল থাকবে প্রফুল্ল দাস. বাচ্চা দেখালে কি হয়, এলেম আছে. আপনি ওকে দেখবেন যাতে আমার মার নামের বিজ্ঞান কলেজ ভাল করে চলে.
হাকিম সাহেব বললেন—আপনি নিশ্চিন্ত মনে যান. কখনও কোনও অসুবিধা হলে বঙ্কিমবাবু (রায়) ও প্রফুল্লবাবু যেন আমাদের জানান. ফোনে একটা খবর পেলেও যা করার করতে পারি. খোদাতালার দয়ায় আপনি সুস্থ হয়ে সদলবলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন. আপনি ফিরে আসা না পর্য্যন্ত আমরা শান্তি পাব না.
পরিবেশটা তখন আবেগে ও মমতায় থরথরে করে কাঁপছে. শ্রীশ্রীঠাকুরের চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত. বেদনাহত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সবার পানে. পূজনীয় খেপুদার বাইরের ঘরে বসে এই ঐতিহাসিক শেষ বৈঠক.“
(তথ্যসূত্রঃ কুমারকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য প্রণীত মহামানবের সাগরতীরে/১ম/৩)
ঠাকুরের নির্দেশমত, “রওনা হলেন সুশীলচন্দ্র, সঙ্গে রাজেন্দ্রনাথ ও বীরেন্দ্রলাল। কলকাতা এসে ভোলানাথ সরকারের সঙ্গে রাজেন্দ্রনাথ আপ্রাণ চেষ্টা করে ৩১শে আগষ্ট বগী রিজার্ভ করলেন। ঠিক হল ১লা সেপ্টেম্বর সকালে ঈশ্বরদী থেকে আসাম মেলের সঙ্গে বগী দেওয়া হবে. ৩১শে আগষ্ট আশ্রমে পৌঁছে রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানালেন সমস্ত সংবাদ। বীরেন্দ্রলাল মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে সুশীলচন্দ্র ৩১শে আগষ্ট রাত্রে রওনা হলেন দেওঘরে বাড়ী ঠিক করার জন্য।
আশ্রমে বিদ্যুত বেগে প্রস্তুতি পর্ব্ব চলতে থাকলো. খবর রাখা হল বিশেষ গোপনে, যাতে জনসমুদ্র এসে কেঁদে কেটে ঠাকুরের মত বদলে না ফেলে। পূজনীয় বড়দা বিভিন্ন বিভাগের কর্ম্মীদের দিলেন যথোপযুক্ত উপদেশ ও নির্দ্দেশাদি—যাতে তাঁদের অনুপস্থিতি কালেও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় সমস্ত কাজ। নির্দ্ধারিত দিনে যথাসময়ে রওনা হলেন শ্রীশ্রীঠাকুর আশ্রম ছেড়ে—সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সবাই, শ্রীশ্রীঠাকুরের পরিচর্য্যাকারিগণ প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবারবর্গসহ, সপরিবারে স-সহচর ঋত্বিগাচার্যদেব, রাজেন্দ্রনাথ এবং আশ্রমের আরও কতিপয় বিশিষ্ট কর্মী. বিষণ্ণ বদনে যাত্রা করলেন শ্রীশ্রীঠাকুর—অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে তাঁর প্রিয়জনদের ছেড়ে যেতে—ছেড়ে যেতে জনক-জননীর পবিত্র স্মৃতিতীর্থ. ব্যথাতুর চিত্তে সজল নেত্রে নির্ব্বাক নিস্তব্ধ হয়ে পাষাণ মূর্ত্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল আশ্রমবাসী নরনারী—আবাল-বৃদ্ধ-শিশু-যুবা ঠাকুরের এই ঐতিহাসিক যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে. সূচনা হল পুরুষোত্তমের নবতর দ্বারকা-লীলার.” (তথ্যসূত্রঃ শ্রীমত্ আচার্য্য সতীশচন্দ্র গোস্বামী ও সত্সঙ্গ আন্দোলন, পৃঃ ১৪৩)
"এর আগেও কয়েকবার শ্রীশ্রীঠাকুরের বায়ু-পরিবর্তনের জন্য বাইরে যাওয়ার কথা হয়েছিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি । এবারেও শেষ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় ছিল । কিন্তু ১লা সেপ্টেম্বর সকালে মাতৃমন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি শ্রীশ্রীঠাকুর যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন । তাঁকে ঈশ্বরদী ষ্টেশনে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ী প্রস্তুত । বেলা দশটা নাগাদ তিনি রওনা হবেন । শ্রীশ্রীঠাকুর গাড়ীতে ওঠার আগে তাঁর পিতা ও মাতার প্রতিকৃতির সামনে প্রণাম নিবেদন করলেন । তারপর আশ্রম প্রাঙ্গণে মন্দিরে গিয়ে হুজুর মহারাজ এবং সরকার সাহেবের প্রতিকৃতির সামনে প্রণাম নিবেদন করলেন । .....তাঁর চোখে জল । চোখের জল ফেলতে ফেলতে ফেলতে তিনি মোটরে উঠলেন । ....চোখের জল ফেলতে ফেলতে তিনি জন্মভূমি থেকে শেষ যাত্রা করেছিলেন ।" (তথ্যসূত্রঃ কুমারকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য প্রণীত মহামানবের সাগরতীরে/১ম/৩-৪)
"২রা সেপ্টেম্বর বেলা ১০টা নাগাদ শ্রীশ্রীঠাকুর বৈদ্যনাথধাম স্টেশনে পৌঁছলেন । সঙ্গে পরিবার-পরিজন, পার্ষদগণ এবং সেবকগণ । তাঁর বাসের জন্য প্রথমে 'বড়াল-বাংলো' বাড়ীটি ভাড়া নেওয়া হয় । পরে 'ওয়েস্ট এণ্ড হাউস' (মনোমোহিনী ধাম), গোলাপবাগ, রঙ্গনভিলা , অশোক-আশ্রম, হিলস ওয়ে , শশধর-স্মৃতি (শিবতীর্থ), দাস-ভিলা, প্রসন্ন-প্রসাদ প্রভৃতি বাড়ী ভাড়া করা হয় । রঙ্গনভিলায় শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যমভ্রাতা পূজনীয় প্রভাসচন্দ্র চক্রবর্তী (ক্ষেপুকাকা) হিলস ওয়েতে শ্রীশ্রীঠাকুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা পূজনীয় শ্রীকুমুদরঞ্জন চক্রবর্তী (বাদলকাকা) এবং গোলাপবাগে পূজ্যপাদ বড়দা সপরিবারে বাস করতে থাকেন ।"
(মহামানবের সাগরতীরে, ১ম পৃঃ ৪)
শ্রীশ্রীঠাকুরের দেওঘর আগমনের সংবাদ জানতে পেরে, নিরাপত্তার কারণে, পূর্ববঙ্গের অনেক সত্স ঙ্গী পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে ঠাকুরের শরণাপন্ন হন । ওদিকে, ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির থাবায় ১৯৪৭ এর ১৫ আগষ্ট দ্বিজাতি-তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে দেশবিভাগের ফলে আরো ছিন্নমূল সত্স১ঙ্গী পরিবারের দল দেওঘরে চলে আসেন । দেওঘরে ঠাকুর নবাগত । নিজেই পরিবার পরিজনদের নিয়ে প্রভূত কষ্ট স্বীকার করে ভাড়া বাড়ীতে থাকেন । নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যেও প্রশাসন বা সমাজসেবী সংস্থাদের কাছ থেকে সাহায্য না নিয়ে, কাউকে বিব্রত না করে, আত্মত্যাগী ইষ্টভ্রাতাদের সাহায্যে দুর্গতদের আশ্রয়দান ও ভরণপোষণ করেছিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সর্বহারাদের যোগ্যতাহারা হতে দিলেন না ।
"বাস্তুহারা হওয়া নিদারুণ
কিন্তু যোগ্যতাহারা হওয়া সর্বনাশা,
এই যোগ্যতাকে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর ক'রে
অর্জ্জন করতে হলেই
আদর্শে কেন্দ্রায়িত হতেই হবে সক্রিয়তায়,
...তাই আজ যারা বাস্তুহারা
সর্ব্বনাশের ঘনঘটা যাদের
চারিদিকেই ঘিরে ধরেছে
আগ্রহ আকুল কণ্ঠে তাদের বলি.....
সাবধান থেকো,
যোগ্যতাকে হারিও না,
এই যোগ্যতা যদি থাকে
লাখ হারানকে অতিক্রম ক'রে
বহু পাওয়ার আবির্ভাব হতে পারে
বিধিমাফিক শ্রমকুশল
সৌকর্য্যে......"
(সূত্রঃ মহামানবের সাগরতীরে ১ম১৫)
সেদিন যারা ঠাকুরের উক্ত নিদেশ অমান্য করে খয়রাতি সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, তারা হয়েছিলেন সংকুচিত, আর, যাঁরা ঠাকুরের নিদেশ মেনে চলেছিলেন তাঁরা জীবনের কল্যাণপ্রবাহকে প্রসারিত করতে পেরেছিলেন ।
যাইহোক, দেওঘরে আগত উদ্বাস্তুদের আশ্রয়, ভরণপোষণ, চিকিত্সাদদি পরিষেবার ব্যবস্থা করতে অনেক বাড়ী ভাড়া করতে হয়েছিল শ্রীশ্রীঠাকুরকে । যা ক্রমে ক্রমে সত্সরঙ্গ প্রতিষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করে । তিলে তিলে গড়ে তোলা হিমায়েতপুরের ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই আশ্রম শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার দখল করে নেয়। ফলে শ্রীশ্রীঠাকুর নবোদ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন কেমিক্যাল ওয়ার্কস, তপোবন বিদ্যালয়, কূটিরশিল্প, প্রেস, প্রকাশনা বিভাগ, হাসপাতাল, যতি আশ্রম প্রভৃতি ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের জনকল্যাণমুখী কর্ম প্রচেষ্টার বাস্তব রূপায়নের আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত নিম্ন প্রদত্ত তথ্য পাঠ করলেই বোঝা যাবে শ্রীশ্রীঠাকুরের সুদূরপ্রসারী কল্যাণ প্রতিষ্ঠার প্রতিচ্ছবি ।
"সত্সসঙ্গের বর্তমান সর্বপ্রধান লক্ষ্যবস্তু হইল বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, দেশীয় ঔষধপত্র প্রস্তুতের রসায়ণাগার ও কারখানা, হাসপাতাল, প্রসূতিসদন, বালক-বালিকাদের শিক্ষার জন্য উচ্চ বিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র, কুটির-শিল্প ভবন, কৃষিপরীক্ষা-ক্ষেত্র প্রভৃতি স্থাপন পূর্বক পাবনার ন্যায় একটি আদর্শ পল্লী-উন্নযন কেন্দ্রের পুণঃ প্রতিষ্ঠা করা । প্রসঙ্গতঃ ইহা উল্লেখযোগ্য যে, অতীতের সেই পাবনা-সত্সঙ্গ পল্লী সংগঠনের উজ্জল আদর্শরূপে অদ্যাপি সারা ভারতে প্রসিদ্ধ হইয়া আছে. আর শুধুমাত্র বিহারেই নয়, পরন্তু ভারতের সকল প্রদেশেই এইরূপ আদর্শ কেন্দ্র স্থাপন করাই সত্সঙ্গের অভিলাষ।
শাণ্ডিল্য বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি আবাসিক পল্লী-বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন পূর্বক শ্রীশ্রীঠাকুরের পরিকল্পনাগুলির বাস্তব রূপায়নের উচ্চাকাঙ্খাও সত্সঙ্গ পোষণ করিয়া চলিয়াছে।......" (আলোচনা, মাঘ, ১৩৬৫/পৃঃ ১৫০)
উক্ত দলিল থেকে প্রাপ্ত সংবাদে এটুকু বোঝা গেল যে, পাবনা আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর যথেষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে যে-সব কর্ম-প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তুলেছিলেন, তদনুরূপ কেন্দ্র ভারতের প্রতিটি প্রদেশে স্থাপন করা হবে। এবং একটি শাণ্ডিল্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন—যা শ্রীশ্রীঠাকুরের এক অন্যতম ইচ্ছা।
সত্সঙ্গী-সাধারণের জ্ঞাতার্থে পাবনার হিমায়েতপুর-আশ্রমের কর্ম-প্রতিষ্ঠানসমূহের এক সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করছিঃ—
অখ্যাত পল্লী হিমায়েতপুরে বায়ু থেকে বিদ্যুত উত্পাদন করে পরম বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর। গড়ে তুলেছিলেন—তপোবন ও মাতৃ বিদ্যালয়—যা শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত মনোমোহিনী ইনষ্টিউট অফ সায়েন্স এণ্ড টেকনোলজি নামের বিজ্ঞান কলেজ।–যার পরিচয় ইতিপূর্বে পেয়েছি। কেমিক্যাল ওয়ার্কসের জীবনদায়ী ঔষধসমূহ দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত হয়েছিল। বৈদ্যুতিক এবং যন্ত্রশিল্পের আধুনিক সব ধরণের কাজ হতো ইলেকট্রিকাল ও মেকানিক্যাল ওয়ার্কসপে। যথা,--ঢালাই, ঝালাই, লেদের কাজ, ডাইস, ইলেক্ট্রোপ্লেটিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ফিটিং, আরমেচার, ব্যাটারি প্লেট তৈরি ও মেরামত, ডায়নামো মেরামত ইত্যাদি। ছিল—ময়দার কল, আটার কল, চালের কল, তেলের কল, চিনির কল, মেডিকেটেড ওয়াটার মেশিন, স্পাইস পাউডারিং, সুতার গুটি তৈরি, টেলারিং, বোতাম তৈরি, গ্লাস ব্লোয়িং, পটারী ওয়ার্কস্, বেকারী, লজেন্স তৈরি, গ্রোসারী প্রোডাক্ট ইত্যাদির শিল্প। ছিল—কার্ডবোর্ড কারখানা, স্টীমলণ্ড্রী, কটন ইণ্ডাস্ট্রিজ, হোশিয়ারী শিল্প, ব্যাঙ্ক, ইঞ্জিনীয়ারিং ওয়ার্কস্, বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র, স্বাস্থ্য বিভাগ, গৃহনির্মাণ বিভাগ, কলাকেন্দ্র, প্রেস (যেখানে বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃত, উর্দু, আরবী, ফারসী হরফের কাজ হতো, দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সরকার জবরদখল করে ঢাকাতে নিয়ে যায়।), পাব্লিশিং হাউস, ফিলানথ্রপি, মাতৃসঙ্ঘ ইত্যাদি।
(তথ্যসূত্রঃ ব্রজগোপাল দত্তরায় প্রণীত জীবনী গ্রন্থ)
শুধু আশ্রমবাসীরাই নয়, জাতি-বর্ণ-সম্প্রদায়-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের সুলভ সেবা পেতেন। তথাপিও পাকিস্তান সরকার ওই সর্বজনীন কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠানসমূহ দখল করে কেন বিনষ্ট করেছিলেন তার উত্তর আমার জানা নেই।
যেমন জানা নেই, আলোচনা পত্রিকাতে বর্ণিত শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছার বাস্তবায়ন দেওঘর সত্সঙ্গ কর্তৃপক্ষ করেছেন কি-না।---জানালে বাধিত হব। কারণ, ইষ্টভৃতি মানে ইষ্টভরণ, ইষ্টভৃতির অর্ঘ্যাদি ইষ্টকর্মে,--ঠাকুরের ইচ্ছার পূর্ত্তিতে ব্যবহৃত হবে, এবং সেটাই স্বাভাবিক!
তবে এটুকু জানতে পেরেছি, ঠাকুরকে প্রীত করার, সুস্থ রাখার অজুহাতে শনির দশা কাটাবার ব্যবস্থা করা হয়, যাগযজ্ঞ করা হয়, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখান হয়। “কিন্তু যা করলে তিনি সুস্থ থাকেন এবং তাঁর মন প্রফুল্ল থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি। তাঁর আবাল্যের স্বপ্ন শাণ্ডিল্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, যাজন-পরিক্রমার জন্য গাড়ী সংগ্রহ, গঙ্গা-দারোয়া পরিকল্পনা, হাসপাতাল স্থাপন, দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ প্রভৃতি বিষয়ে কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা আন্তরিক ছিল না।......... ” (তথ্যসূত্রঃ কুমারকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য প্রণীত মহামানবের সাগরতীরে/২য়/৩২৭)
চির-অতন্দ্র পুরুষোত্তম মৃতলোকের অনেক বেদনা নিয়ে অমৃতলোকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তাঁর “দেবভিক্ষা--
ওগো ভিক্ষা দাও!--
ঝাঁঝাল ঝঞ্ঝার পিশাচী জৃম্ভন শুরু হয়েছে,
বাতুল ঘুর্ণি বেভুল স্বার্থে
কলঙ্ক কুটিল ব্যবচ্ছেদ
সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে দিয়েছে,
প্রেত-কবন্ধ-কলুষ
কৃষ্টিকে বেতাল আক্রমণে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে,
অবদলিত কৃষ্টি অজচ্ছল অশ্রুপাতে
ভিক্ষুকের মতো তাঁরই সন্তানের দ্বারে
নিরর্থক রোদনে রুদ্যমান,
অলক্ষ্মী-অবশ প্রবৃত্তি-শাসিত বেদস্মৃতি--
ঐ দেখ--মর্মান্তিকভাবে নিষ্পেষিত,
ত্রস্ত দোধুক্ষিত দেবতা আজ নতজানু--তোমাদেরই দ্বারে
তোমাদেরই প্রাণের জন্য তোমাদেরই প্রাণভিক্ষায়
তোমাদেরই সত্তার সম্বর্দ্ধনার জন্য
ব্যাকুল হয়ে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছেন ;
কে আছ এমন দরদী আর্য্য-আত্মজ সন্তান!--
তাঁকে মানুষ ভিক্ষা দেবে, তাঁকে অর্থ ভিক্ষা দেবে—
সব হৃদয়ের সবটুকু উত্সর্গ করে
তোমাদেরই জন্য
সেই দেবোজ্জল প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তুলতে?
যদি থাক কেউ
ওগো ধী-ধুরন্ধর উত্সর্গপ্রাণ
নিরাশী নির্ম্মম!
এস,--উত্সর্গ কর--আত্মাহুতি দাও--
জীবন নিঙড়ানো যা-কিছু সঙ্গতি
তাঁকে দিয়ে সার্থক হয়ে ওঠ,
নিজেকে বাঁচাও, মানুষকে বাঁচাও, কৃষ্টিকে বাঁচাও ;
আর, বাঁচাও দুর্দ্দশাদলিত মহা-ঐশ্বর্য্যশালিনী
আর্য্যস্তন্যদায়িনী, পরম-পবিত্রা
ভিখারিণী মাতা ভারতবর্ষকে,
ধন্য হও, নন্দিত হও,
ঈশ্বরের অজচ্ছল আশীর্ব্বাদকে
মাথা পেতে লও,
শান্ত হও, শান্তি দাও,
অস্তি ও অভ্যুত্থানকে
অনন্তের পথে অবাধ করে রাখ ;
স্বস্তি! স্বস্তি! স্বস্তি!
(১৯৪৬ খৃস্টাব্দের প্রথম দিকে হিমায়েতপুরে নিজহস্তে লিপিবদ্ধ করেন, এই ‘দেবভিক্ষা’ বাণী, পরবর্তীতে চর্য্যা-সূক্ত গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়!)-র” ঝুলি ভরাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি! তবে আশা রাখি “অনুকূল সদাবিভুঃ পদ্মনাভঃ মনপ্রভু”-র অনুগামী ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠাপরায়ণ ঋদ্ধসেনানীদের দিয়ে তিনি তাঁর কাজ ঠিক করিয়ে নেবেন---পুণঃ প্রতিষ্ঠিত হবে তাঁর পুণ্য জন্মভূমি পরমতীর্থ হিমায়েতপুরের হৃত গৌরব!
ঠাকুরের প্রতিটি বানী আমাদের কাজে-কর্মের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছে। তিনি পৃথিবীতে এসে মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।
পরমপ্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অন্যতম প্রিয়ভক্ত অতুলচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। কর্ম-জীবন তাকে পাবনা থেকে দূরে নিয়ে যাবে। বিরহ বিচ্ছেদ কাতর ভক্ত প্রেমাশ্রুধারায় প্রার্থনা করল, নিরন্তর দিব্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত থাকতে পারে এমনতর শ্রীহস্তে লিখিত অমৃত নির্দেশ! বাংলা ১৩১৬ সালে দ্বাবিংশ বর্ষে শ্রীশ্রী ঠাকুর এক নিশায় লিপিবদ্ধ করে দিলেন তাঁর অমৃত-নিষ্যন্দী স্বতঃ-উতসারী বানী। ভক্তের প্রার্থনা নামিয়ে নিয়ে রল পৃথিবীর বুকে মন্দাকিনীর পুণ্য ধরা যা সঞ্জীবিত করে রাখবে তাকে এবং যুগ যুগ ধরে প্রতিটি মানুষকে।
মুদ্রিত সত্যানুসরণ বাংলা ১৩২৫ সাল থেকে বহন করে চলেছে ঐ শাশ্বত মহাবানী।
প্রকাশক
ভারতের অবনতি (degeneration) তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছে, যখন থেকে ভারতবাসীর কাছে অমূর্ত্ত ভগবান অসীম হয়ে উঠেছে—ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদের উপাসনা শুরু হয়েছে।
ভারত! যদি ভবিষ্যৎ উন্নতিকে আবাহন করতে চাও, তবে সম্প্রদায়গত বিরোধ ভুলে জগতের পুর্ব পুর্ব গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্পন্ন হও—আর তোমার মুর্ত ও জীবন্ত গুরু বা ভগবানে আসক্ত (attached) হও, –আর তাদের স্বীকার কর যারা তাঁকে ভালবাসে। কারণ, পুর্ব্ববর্ত্তীকে অধিকার করিয়াই পরবর্তীর আবির্ভাব হয়।
অর্থ, মান যশ ইত্যাদি পাওয়ার আশায় আমাকে ঠাকুর সাজিয়ে ভক্ত হয়ো না, সাবধান হও ঠকবে; তোমার ঠাকুরত্ব না জাগলে কেহ তোমার কেন্দ্রও নয় ঠাকুরও নয় – ফাঁকি দিলে পেতে হবে তা।
সত্যানুসরণ
সর্বপ্রথম আমাদের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। সাহসী হতে হবে, বীর হতে হবে। পাপের জলন্ত প্রতিমূর্তি ঐ দুর্বলতা। তাড়াও, যত শীগ্র পার, ঐ রক্ত শোষনকারী অবষাদ উৎপাদক vampire কে। স্বরণ কর তুমি সাহসী, স্বরণ কর তুমি শক্তির তনয়, স্বরণ কর তুমি পরমপিতার সন্তান। আগে সাহসী হও, অকপট হও, তবে জানা যাবে তোমার ধর্মরাজ্যে ঢোকাবার অধিকার জন্মেছে।
এতটুকু দুর্বলতা থাকলেও তুমি ঠিক ঠিক অকপট হতে পরবে না; আর যতদিন তোমার মন-মুখ এক না হচ্ছে ততদিন তোমার মলিনতার গায়ে হাতই পড়বে না। মন মুখ এক হলে আর ভিতরে গলদ জমতে পারে না-গুপ্ত আবর্জনা ভাষায় ভেসে উঠে পড়ে। পাপ গিয়ে তার ভিতর বাসা বাঁধতে পারে না।
হটে যাওয়াটা বরং দুর্বলতা নয়কো কিন্তু চেষ্টা না করাই দুর্বলতা। তুমি কোনকিছু করতে প্রাণপন চেষ্টা করার সত্বেও যদি বিফলমনোরথ হও, ক্ষতি নাই। তুমি ছেড় না, ঐ অম্লান চেষ্টাই তোমাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে।
দুর্বল মন চিরকালই সন্দিগ্ধ, তারা কখনই নির্ভর করতে পারে না। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে তাই প্রায়ই রুগ্ন, কুটিল, ইন্দ্রীয়পরবশ হয়। তাদের নিকট সারাটা জীবন জ্বালাময়। শেষে অশান্তিতে সুখ দুঃখ ডুবে যায়, কি সুখ কি দুঃখ বলতে পারেনা। বললে হয়তো বলে বেশ, তাও অশান্তি; অবসাদে জীবন ক্ষয় হয়ে যায়।
দুর্বল হৃদয়ে প্রেম ভক্তির স্থান নেই। পরের দূর্দশা দেখে পরের ব্যাথা দেখে, পরের মৃত্যু দেখে নিজের দূর্দ্দশা, ব্যাথা বা মূত্যুর আশঙ্খা করে ভেঙ্গে পড়া, এলিয়ে পড়া বা কেঁদে আকুল হওয়া – ওসব দূর্বলতা। যারা শক্তিমান, তারা যাই করুক, তাদের নজর নিরাকরনের দিকে; যাতে ও সব অবস্থায় আর না কেউ বিদ্ধস্ত হয়, প্রেমের সহিত তারই উপায় চিন্তা করা—বুদ্ধাদেবের যা হয়েছিল। ঐ হচ্ছে সবল হৃদয়ের দৃষ্টান্ত।
তুমি বল না তুমি ভীরু, বলনা তুমি কাপুরুষ, বলনা তুমি দুরাশয়। পিতার দিকে নজর কর, আবেগভরে বল ওগো আমি তোমার সন্তান; আমার আর জড়তা নেই, আমি আর কাপুরুষ নই, আমি আর তোমাকে ভুলে নরকের দিকে ছুটা যাব না, আর তোমার জ্যোতির দিকে পেছন ফিরে অন্ধকার অন্ধকার বলে চিৎকার করব না।
**********
অনুতাপ কর; কিন্তু স্মরণ রেখ যেন পুনরায় অনুতপ্ত হতে না হয়। যখনই তোমার কুকর্মের জন্য তুমি অনুতপ্ত হবে, তখনই পরমপিতা তোমাকে ক্ষমা করবেন, আর ক্ষমা হলেই বুঝতে পারবে তোমার হৃদয়ে পবিত্র শান্তনা আসছে, আর তা হলেই তুমি বিনীত, শান্ত ও আনন্দিত হবে।
যে অনুতপ্ত হয়েও পুনরায় সেই প্রকার দুষ্কর্মে রত হয় বুঝতে হবে সে সত্বরই অত্যন্ত দুর্গতিতে পতিত হবে। শুধু মুখে মুখে অনুতাপ ও আরও অন্তরে অনুতাপ আসার অন্তরায়। প্রকৃত অনুতাপ এলে তার সমস্ত লক্ষণ অল্পবিস্তর প্রকাশ পায়।
**********
জগতে মানুষ যত কিছু দুঃখ পায় তার অধিকাংশই আসে কামিনী কাঞ্চনে আসক্তি থেকে, ও দুটো থেকে যত দূরে সরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। ভগবান শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব সবাইকে বিশেষ করে বলেছেন, কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাৎ তফাৎ খুব তফাৎ থাক।
কামিনী থেকে কাম বাদ দিলে ইনি মা হয়ে পড়েন। বিষ অমৃত হয়ে গেল। আর মা মা-ই, কামিনী নয়কো। মার শেষে গী দিয়ে ভাবলেই সর্বনাশ। সাবধান! মা কে মাগী ভেবে মর না। প্রত্যেক মাই জগজ্জনী। প্রত্যেক মেয়েই নিজের মায়ের বিভিন্ন রুপ, এমতর ভাবতে হয়। মাতৃভাব হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত না হলে স্ত্রীলোকে ছুতে নেই—যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল; এমনি কি মুখদর্শন না করা আরও ভাল।
আমার কামক্রোদাদি গেলনা গেলনা বলে চিৎকার পাড়লে তারা যায় না। এমন কর্ম, এমন চিন্তা, অভ্যাস করে নিতে হয় যাতে কামক্রোধাদির গন্ধও নেই- মন যাতে ওসব ভুলে যায়। মনে কামক্রোধাদির ভাব এলে কী করে তার প্রকাশ পাবে? উপায় উচ্চতর উদার ভাবে নিমজ্জিত থাকা।
সৃষ্টতত্ব, গণিতবিদ্যা, রসায়ণশাস্ত্র, ইত্যাদির আলোচনায় কামরিপুর দমন থাকে। কামিনী কাঞ্চন সম্পর্কিত যে কোন প্রকার আলোচনাই ওতে আসক্তি এনে দিতে পারে। ও সব আলোচনা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল।
********
সঙ্কোচই দুঃখ আর প্রসারনই সুখ। যাতে হৃদয়ে দুর্বলতে আসে, ভয় আসে তাতেই আনন্দের খাকতি – আর তাই দুঃখ। চাওয়াটা না পাওয়াই দুঃখ। কিছু চেও না। সব অবস্থায় রাজি থাক, দুঃখ তোমার কি করবে? দুঃখ কারো প্রকৃতিগত নয়কো। ইচ্ছে করলেই তাকে তাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। পরমপিতার কাছে প্রার্থনা কর- তোমার ইচ্ছাই মঙ্গল; আমি জানি না কিসে আমার মঙ্গল হবে। আমার ভিতরে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। আর তা’র জন্যে তুমি রাজী থাক-আনন্দে থাকবে, দুঃখ তোমাকে স্পর্শ করবে না।
কারো দুঃখের কারন হয়ো না, কেহ তোমার দুঃখের কারন হবে না।
দুঃখও একরকম ভাব, সুখও একরকম ভাব। অভাবের বা চাওয়ার ভাবটাই দুঃখ। তুমি জগতের হাজার করেও দুঃখ নষ্ট করতে পারবে না-যতক্ষন তুমি হৃদয় থেকে ঐ অভাবের ভাবটা কেড়ে নিচ্ছ। আর, ধর্মই তা করতে পারে।
********
যদি সাধনায় উন্নতি লাভ করতে চাও, তবে কপটতা ত্যাগ কর।
কপট ব্যাক্তি অন্যের নিকট সুখ্যাতির আশায় নিজেকে নিজেই প্রবঞ্চনা করে, অল্প বিশ্বাসের দরুন অন্যের প্রকৃত দান হতেও প্রবঞ্চিত হয়।
তুমি লাখ গল্প কর, কিন্তু প্রকৃত উন্নতি না হলে তুমি প্রকৃত আনন্দ কখনই লাভ করতে পারবে না। কপটাশয়ের মুখের কথার সঙ্গে অন্তরের ভাব বিকশিত হয় না, তাই আনন্দের কথাতেও মুখে নীরসতার চিহ্ন দৃষ্ট হয়; কারন, মুখ খুললে কী হয়, হৃদয়ে ভাবের স্ফুর্তি হয় না।
অমৃতময় বারি কপটের নিকট তিক্ত লবন-ময়, তীরে যাইয়াও তার তৃষ্ণা নিবারিত হয় না।
সরল ব্যাক্তি উদ্ধ্বদৃষ্টি সম্পন্ন চাতকের মত। কপটী নিন্মদৃষ্টিসম্পন্ন শকুনের মত। ছোট হও, কিন্তু লক্ষ্য উচ্চ হোক; বড় এবং উচ্চ হ’য়ে নিন্মদৃষ্টিসম্পন্ন শকুনের মত হওয়ায় লাভ কি?
কপট হয়ো না, নিজে ঠক না, আর অপরকেও ঠকিও না।
********
এটা খুবই সত্য কথা যে, মনে যখনই অপরের দোষ দেখবার প্রবৃত্তি এসেছে তখনই ঐ দোষ নিজের ভিতরে এসে বাসা বেধেছে। তখনই কালবিলম্ব না করে ওই পাপপ্রবৃত্তি ভেঙ্গেচুরে ঝেঁটিয়ে সাফ করে দিলে তবে নিস্তার, নইলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।
তোমার নজর যদি অন্যের কেবল কু-ই দেখে, তবে তুমি কখনই কাউকে ভালবাসতে পারবে না। আর, যে সৎ দেখতে পারে না সে কখনই সৎ হয় না।
তোমার মন যত নির্মল হবে, তোমার চক্ষ তত নির্মল হবে, আর জগৎটা তোমার নিকট নির্মল হয়ে ভেসে উঠবে।
তুমি যাই দেখ না কেন, অন্তরের সহিত দেখার সর্ব্বাগ্রে তার ভালটুকুই দেখতে চেষ্টা কর, আর এই অভ্যাস তুমি মজ্জাগত করে ফেল।
তোমার ভাষা যদি কুৎসা-কলঙ্কজড়িতই হয়ে থাকে, অপরের সুখ্যাতি করতে না পারে, তবে যেন কারো প্রতি কোনও মতামত প্রকাশ না করে। আর, মনে-মনে তুমি নিজ স্বভাবকে ঘৃনা করতে চেষ্টা কর, এবং ভবিষ্যতে কুৎসা-নরক ত্যাগ করতে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হও।
পরনিন্দা করাই পরের দোষ কুড়িয়ে নিয়ে নিজে কলঙ্কিত হওয়া; আর, পরের সুখ্যাতি করা অভ্যাসে নিজের স্বভাব অজ্ঞাতসারে ভাল হয়ে পড়ে। তাই বলে কোন স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে অন্যের সুখ্যাতি করতে নেই। সে তো খোসামদ। সে ক্ষেত্রে মন মুখ প্রায়ই এক থাকে না। সেটা কিন্তু বড়ই খারাপ, আর তাতে নিজের স্বাধীন মত প্রকাশের শক্তি হারিয়ে যায়।
*********
যার উপর যা’কিছু সব দাঁড়িয়ে আছে তাই ধর্ম, আর তিনিই পরম পুরুষ। ধর্ম কখনও বহু হয় না ধর্ম একই আর তার কোন প্রকার নেই। মত বহু হতে পারে, এমনিকি যত মানুষ তত মত হতে পারে কিন্তু তাই বলে ধর্ম বহু হতে পারে না।
হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম, খৃষ্টান ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ইত্যাদি কথা আমার মতে ভুল, বরং ও সবগুলি মত।
কোন মতের সঙ্গে কোন মতের প্রকৃত পক্ষে কোন বিরোধ নেই, ভাবের বিভিন্নতা, রকমফের একটাকেই নানপ্রকারে একরকম অনুভব!
সব মতই সাধনা বিস্তারের জন্য, তবে তা নান প্রকারে হতে পারে; আর যতটুকু বিস্তারে যা হয় তাই অনুভূতি, জ্ঞান। তাই ধর্ম অনুভূতির উপর।
**********
যদি ভাল চাও তো জ্ঞানাভিমান ত্যাগ ছাড়, সবারই কথা শোন; আর যা তোমার হৃদয়ের বিস্তারের সাহায্য করে তাই কর। জ্ঞানাভিমান জ্ঞানের যত অন্তরায় আর কোন রিপু তত নয়। যদি শিক্ষা দিতে চাও তবে কখনও শিক্ষক হতে চেও না। আমি শিক্ষক, এই অহংকারই কাউকে শিখতে দেয় না। অহংকে যত দূরে রাখবে তোমার জ্ঞানের বা দর্শনের পাল্লা তত বিস্তার হবে।
অহংটা যখনই মিলিয়ে যায়, জীব তখনই সর্বগুন সম্পন্ন নির্গুন হয়।
**********
যদি পরীক্ষক সেজে অহংকার নিয়ে সদগুরু কিংবা প্রেমী সাধুগুরুকে পরীক্ষা করতে যাও তবে তুমি তাতে দেখবে তোমাকেই দেখবে ঠকে আসবে। সদগুরুকে পরীক্ষা করতে হলে তার নিকট সংকীর্ণ-সঙ্গস্কার বিহীন হয়ে ভাল-বাসার হৃদয় নিয়ে, দীন এবং যতদুর সম্ভব নিরহংকার হয়ে যেতে পারলে তাঁর দয়ায় সন্তুষ্ট হওয়া যেতে পারে।
তাকে অহং-এর কষ্টিপাথরে কষা যায় না, কিন্তু তিনি প্রকৃত দীনতারুপে ভেড়ার শিঙে খন্ডবিখন্ড হন।
হীরক যেমন কয়লা প্রভৃতি আবর্জ্জনায় থাকে, উত্তমরুপে পরিষ্কার না করলে তা জ্যেতি বেরোয় না, তিনি তো তেমনি সংসারে অতি সাধারন জীবের মত থাকেন, কেবল প্রেমের প্রক্ষালনেই তাঁর দীপ্তিতে জগৎ উদ্ভাসিত হয়। প্রেমীই তাঁকে ধরতে পারে। প্রেমীর সঙ্গ কর, তিনি আপনিই প্রকট হবেন।
অহংকারীকে অহংকারী পরীক্ষা করতে পারে। গলিত-অহংকে কি-করে সে জানতে পারবে? তার কাছে একটা কিম্ভুতকিমাকার-যেমন অজমূর্খের কাছে মহাপন্ডিত।
**********
সত্যদর্শীর আশ্রয় নিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা কর, এবং বিনয়ের সহিত স্বাধীন মত প্রকাশ কর। বই পড়ে বই হয়ে যেও না, তার essence* কে মজ্জাগত করতে চেষ্টা কর। Pull the husk to draw the seed.*।
উপর-উপর দেখেই কিছু ছেড়ো না বা কোন মত প্রকাশ করো না। কোনও-কিছুর শেষ না দেখলে তার সম্বন্ধে জ্ঞানই হয় না।, আর না জানলে তুমি তার বিষয়ে কি মত প্রকাশ করবে?
যাই কেন কর না, তার ভিতর সত্য দেখতে চেষ্টা কর। সত্য দেখা মানেই তাকে আগাগোড়া জানা, আর তাই জ্ঞান।
যা’ তুমি জান না, এমন বিষয়ে লোককে উপদেশ দিতে যেও না।
*********
নিজের দোষ জেনেও যদি তুমি তা ত্যাগ করতে না পার, তবে কোন মতেই তার সমর্থন করে অন্যের সর্বনাশ কর না। তুমি যদি সৎ হও তোমার দেখাদেখি হাজার হাজার লোক সৎ হয়ে পড়বে। আর যদি অসৎ হও তোমার দুর্দ্দশার জন্য সমবেদনা প্রকাশের কেউই থাকবে না; কারণ তুমি অসৎ হয়ে তোমার চারিদিকই অসৎ করে ফেলেছ।
তুমি ঠিক ঠিক জেন যে তুমি তোমার, তোমার নিজ পরিবারের, দশের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দ্বায়ী। নাম যশের আশায় কোন কাজ করতে যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু কোন কাজ নিঃস্বার্থভাবে কর’তে গেলেই কায্যের অনুরুপ যশ তোমার সেবা করবেই করবে।
নিজের জন্য যাই করা যায় তাই সকাম, আর, অন্যের জন্য যা করা যায় তাই নিষ্কাম। কারো জন্য কিছু না চাওয়কেই নিষ্কাম বলে—শুধু তা নয়কো। দিয়ে দাও নিজের জন্য কিছু চেও না, দেখবে, সব তোমার হয়ে যাচ্ছে।
**********
তুমি অন্যের নিকট যেমন পেতে ইচ্ছা কর, অপরকেও তেমনি দিতে চেষ্টা কর- এমনতর বুঝে চলতে পারলেই যথেষ্ট- আপনিই সবাই তোমাকে পছন্দ করবে, ভালবাসবে।
নিজে ঠিক থেকে সবাইকে সৎভাবে খুশি করতে চেষ্টা কর, দেখবে সবাই তোমাকে খুশি করার চেষ্টা করছে। সাবধান নিজত্ব হারিয়ে কাউকে খুশি করতে যেও না, তাহলে তোমার দূর্গতির সীমা থাকবে না।
**********
কাজ করে যাও কিন্তু আবদ্ধ হয়ো না। যদি বিষয়ের পরিবর্তনে তোমার হৃদয়ে পরিবর্তন আসছে বুঝতে পার, আর সে পরিবর্তনগুলো তোমার বাঞ্চনীয় নয়, তবে ঠিক জেনো তুমি আবদ্ধ হয়েছ। কোন প্রকার সংস্কারে আবদ্ধ থেকো না, একমাত্র পরমপুরুষের সংস্কার ছাড়া যা কিছু সবই বন্ধন।
তোমার দর্শনের-জ্ঞানের পাল্লা যতটুকু অদৃষ্ট ঠিক তারই আগে; দেখতে পাচ্ছ না জানতে পাচ্ছ না, তাই অদৃষ্ট।
তোমার শয়তান অহংকারী আহম্মক আমিটাকে বের করে দাও; পরমপিতার ইচ্ছায় তুমি চল, অদৃষ্ট কিছুই করতে পারবে না। পরমপিতার ইচ্ছাই অদৃষ্ট।
তোমার সব অবস্থার ভিতর তার মঙ্গল-ইচ্ছা বুঝতে চেষ্টা কর, দেখবে কাতর হবে না, বরং হৃদয়ে সফলতা আসবে।, দুঃখেও আনন্দ পাবে।
কাজ করে যাও , অদৃষ্ট ভেবে ভেঙ্গে পড় না; আলসে হয়ো না, যেমন কাজ করবে তোমার অদৃষ্ট তেমনি হয়ে দৃষ্ট হবেন। সৎকর্মীর কখনও অকল্যান হয় না। একদিন আগে আর পাছে।
পরমপিতার দিকে তাকিয়ে কাজ করে যাও। তাঁর ইচ্ছাই অদৃষ্ট; তা ছাড়া আর-একটা অদৃষ্ট-ফদৃষ্ট বানিয়ে বেকুব হয়ে বসে থেকো না। অনেক লোক অদৃষ্ট নেই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে, অথচ নির্ভরতাও নেই , শেষে সারা জীবন দুর্দ্দশায় কাটায়, ওসব আহম্মকী।
তোমার তুমি গেলেই অদৃষ্ট ফুরুলো, দর্শনও নাই অদৃষ্টও নাই।
**********
এগিয়ে যাও, কিন্তু মেপে দেখতে যেও না কতদুর এগিয়েছ; তাহলে আবার পিছিয়ে পড়বে।
অনুভব কর, কিন্তু অভিভূত হয়ে পড় না, তাহলে চলতে পারবে না। যদি অভিভূত হতে হয় তো ঈশ্বরপ্রেমে।
যত পার সেবা কর, কিন্তু হুকুম করতে যেও না।
কখনও নিন্দা কর না, কিন্তু অসত্যের প্রশ্রয় দিও না।
ধীর হও, তাই বলে আলসে দীর্ঘসূত্রী হয়ে পড় না।
ক্ষিপ্র হও, কিন্তু অধীর হয়ে বিরক্তিকে ডেকে এনে সব নষ্ট করে ফেল না।
বীর হও, কিন্তু হিংস্রক হয়ে বাঘ ভাল্লুক সেজে বস না।
স্থিরপ্রতিজ্ঞ হও, গোঁয়ার হয়ো না।
তুমি নিজে সহ্য কর , কিন্তু যে পারে না তাকে সাহায্য কর, ঘৃণা করো না, সহানুভূতি দেখাও, সাহস দাও।
নিজেকে নিজে প্রশংসা দিতে কৃপন সাজ, কিন্তু অপরের বেলায় দাতা হও।
যার উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ, আগে তাকে আলিঙ্গন কর, নিজ বাটিতে ভোজনের নিমন্ত্রন কর, ডালা পাঠাও, এবং হৃদয় খুলে বাক্যালাপ না-করা পর্যন্ত অনুতাপের সহিত তার মঙ্গলের জন্য পরমপিতার কাছে প্রার্থনা কর; কেন না, বিদ্বেষ এলেই ক্রমে তুমি সংকীর্ণ হয়ে পড়বে, আর সংকীর্নতাই পাপ।
যদি কেহ তোমার কখনও অন্যায় করে, আর একান্তই তার প্রতিশোধ নিতে হয় , তবে তুমি তার সংগে এমন ব্যবহার কর যাতে সে অনুতপ্ত হয়; এমনতর প্রতিশোধ আর নেই-অনুতাপ তুষানল। তাতে উভয়েরই মঙ্গল।
বন্ধুত্ব খারিজ করো না, তাহলে শাস্তিতে সমবেদনা ও সান্ত্বনা পাবে না।
তোমার বন্ধু যদি অসৎও হয় , তাকে ত্যাগ করো না, বরং প্রয়োজন হলে তার সঙ্গ বন্ধ কর, কিন্তু অন্তরে শ্রদ্ধা রেখে বিপদে-আপদে কায়মনোবাক্যে সাহায্য কর, আর অনুতপ্ত হলে আলিংগন কর।
তোমার বন্ধু যদি কু-পথে যায়, আর তুমি যদি তাকে ফিরাতে চেষ্টা না কর বা ত্যাগ কর, তার শাস্তি তোমাকেও ত্যাগ করবে না।
বন্ধুর কুৎসা রটিও না বা কোনও প্রকারে অন্যের কাছে নিন্দা করো না; কিন্তু তাই বলে তার নিকট তার কোন মন্দের প্রশ্রয় দিও না।
বন্ধুর নিকট উদ্ধত হয়ো না, কিন্তু প্রেমের সহিত অভিমানে তাকে শাসন কর।
বন্ধুর নিকট কিছু প্রত্যাশা রেখো না, কিন্তু যা পাও, প্রেমের সহিত গ্রহন করো। কিছু দিলে পাওয়ার আশা রেখো না, কিন্তু কিছু পেলে দেওয়ার চেষ্টা করো।
**********
যতদিন তোমার শরীর ও মনে ব্যাথা লাগে, ততদিন তুমি একটি পিপীলিকারও ব্যথা নিরাকরনের দিকে চেষ্টা রেখো, আর যদি না কর, তবে তোমার চাইতে হীন আর কে?
তোমার গালে চড় মারলে যদি বলতে পার, কে কাকে মারে, তবে অন্যের বেলায় বল, ভালই। খবরদার, নিজে যদি না ভাবতে পারতবে অন্যের বেলায় বলতে যেও না।
যদি নিজের কষ্টের বেলায় সংসারী সাজো, অন্যের অন্যের বেলায় ব্রক্ষজ্ঞানী সেজো না। বরং নিজের দুঃখের বেলায় ব্রক্ষজ্ঞানী সাজো আর অন্যের বেলায় সংসারী সাজো, এমন ভেলও ভাল।
যদি মানুষ হও তো নিজের দুঃখে হাস, আর পরের দুঃখে কাঁদ। নিজের মৃত্যু যদি অপছন্দ কর তবে কখনও কাউকে মর বলো না।
**********
হাসো, কিন্তু বিদ্রুপে নয়।কাঁদো, কিন্তু আসক্তিতে নয়, ভালবাসায়, প্রেমে।
বল, কিন্তু আত্মপ্রশংসায় বা খ্যাতি বিস্তারের জন্য নয়। তোমার চরিত্রের কোনও উদাহরনে যদি কারো মঙ্গল হয়, তব্র তার নিকট তা গোপন রেখো না। তোমার সৎস্বভাব কর্মে ফুটে উঠুক, কিন্তু আপন ভাষায় ব্যক্ত না হয়, নজর রেখো। সৎ-এ তোমার আসক্তি সংলগ্ন কর, অজ্ঞাতসারে সৎ হবে। তুমি আপনভাবে সৎ-চিন্তায় নিমগ্ন হও, তোমার অনুযায়ী ভাব আপনি ফুটে বেরুবে।
অসৎ চিন্তা যেমন চাহনিতে , বাক্যে, আচরনে, ব্যবহারে ইত্যাদিতে ফুটে বেরোয়, সৎ-চিন্তাও তেমনি উক্তরুপেই ফুটে বেরোয়।
**********
স্পষ্টবাদী হও, কিন্তু মিষ্টভাষী হও। বলতে বিবেচনা কর, কিন্তু বলে বিমুখ হয়ো না!
যদি ভুল বলে থাক, সাবধান হও, ভূল করো না।
সত্য বল, কিন্তু সংহার এনো না। সৎ কথা বলা ভাল, কিন্তু ভাব, অনুভব করা আরোও ভাল।
অসৎ কথা বলার চেয়ে সৎ কথা বলা ভাল নিশ্চয়, কিন্তু বলার সঙ্গে কাজ করা ও অনুভব না থাকলে কী হলো-বেহালা, বীণা যেমন বাদকানুগ্রহে বাজে ভাল, কিন্তু তারা নিজে কিছু অনুভব করতে পারে না।
যে অনুভুতির খুব গল্প করে অথচ তার লক্ষন প্রকাশ পায় না, তার গল্পগুলি কল্পনা-মাত্র বা আড়ম্বর।
যত ডুববে তত বেমালুম হবে।
যেমনি ডালিম পাকলেই ফেটে যায়, তোমার অন্তরে সৎভাব পাকলেই আপনি ফেটে যাবে-তোমার মুখে তা প্রকাশ করতে হবে না।
**********
যে-খেয়াল বিবেকের অনুচর তারই অনুসরন কর, মঙ্গলের অধিকারী হবে।
বিস্তারে অস্তিত্ব হারাও, কিন্তু নিভে যেও না। বিস্তারই জীবন, বিস্তারই প্রেম।
যে-কর্মে মনের প্রসারন নিয়ে আসে তাই সুকর্ম, আর যাতে মনে সংস্কার, গোঁড়ামী ইত্যাদি আনে, ফলকথা, যাতে মন সংকীর্ণ হয় তাই কু-কর্ম।
যে-কর্ম মানুষের কাছে বলতে মুখে কালিমা পড়ে, তা করতে যেও না। গোপন যেখানে ঘৃণা-লজ্জা-ভয়ে সেখানেই দুর্ব্বলতা, সেখানেই পাপ!
যে-সাধনা করলে হৃদয়ে প্রেম আসে, তাই কর, আর যাতে ক্রুরতা, কঠোরতা, হিংসা আসে, তা আপাততঃ লাভজনক হলেও তার কাছে যেও না।
তুমি যদি এমন শক্তি লাভ করে থাক যাতে চন্দ্র-সূর্য্য কক্ষচ্যুত করতে পার, পৃথিবী ভেঙ্গে টুকরা-টুকরা করতে পার বা সব্বাইকে ঐশ্বর্য্যশালী করে দিতে পার, আর যদি হৃদয়ে প্রেম না থাকে, তবে তোমার কিছুই হয়নি।
**********
একটা চাইতে গিয়ে দশটা চেয়ে বস’না, একেরই যাতে চরম হয় তাই কর, সবগুলিই পাবে। জীবনে যে ভাবে বলি দেবে, নিশ্চয় তেমনতর জীবন লাভ করবে। যে কেহ প্রেমের জন্য জীবন দান করে সে প্রেমের জীবন লাভ করে। উদ্দ্যেশে অনুপ্রাণিত হও, আর প্রশান্ত চিত্তে সমস্ত সহ্য কর, তবেই তোমার উদ্দ্যেশ্য সফল হবে।
*********
হৃদয় দাও কখনও হটে যেতে হবে না। নির্ভর কর, কখনও ভয় পাবে না। বিশ্বাস কর, অন্তরের অধিকারী হবে। সাহস দাও, কিন্তু শঙ্কা জাগিয়ে না দেবার চেষ্টা কর। ধর্য্য ধর, বিপদ কেটে যাবে। অহঙ্কার ক’রো না জগতে হীন হয়ে থাকতে হবে না।
কেহ তোমাকে দোষী করার পূর্বেই কাতরভাবে নিজ দোষ স্বীকার কর, মুক্ত কলঙ্ক হবে, জগতের স্নেহের পাত্র হবে।
সংযত হও, কিন্তু নির্ভিক হও। সরল হও, কিন্তু বেকুব হয় না। বিনীত হও, তাই বলে দুর্বল হৃদয়ের অধীকারী হয়ো না।
**********
নিষ্ঠা রেখো কিন্তু গোঁড়া হয়ো না। সাধু সেজো না, সাধু হতে চেষ্টা কর।
কোন মহাপুরুষের সাথে তোমার নিজের তুলনা করো না, কিন্তু সর্বদা তার অনুসরণ কর। যদি প্রেম থাকে তবে অপরকে আমার বল, কিন্তু স্বার্থ রেখো না।
প্রেমের কথা বলার আগে প্রেম কর।
*********
অন্ধ হওয়া দূর্ভাগ্য বটে কিন্তু যষ্টিচ্যুত হওয়া আরো দুর্ভাগ্য; কারণ যষ্টিই অনেকটা চক্ষুর কাজ করে। স্কুলে গেলেই তাকে ছাত্র বলেনা, আর মন্ত্র নিলেই তাকে শিষ্য বলে না, হৃদয়টা শিক্ষক বা গুরুর নির্দেশ পালনের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত রাখতে হয়। অন্তরে স্থির বিশ্বাস চাই। তিনি যা’ই বলে দেবেন তাই করতে হবে, বিনা আপত্তিতে, বিনা ওজরে বরং পরম আনন্দে। যে- ছাত্র বা শিষ্য প্রাণপণে আনন্দের সহিত গুরুর আদেশ পালন করেছে, সে কখনই বিফল হয়নি। শিষ্যের কর্ত্তব্য প্রাণপণে গুরুর আদেশ কার্য্যে পরিনত করা, গুরুকে লক্ষ্য করে চলা।
যখনই দেখবে, গুরুর আদেশে শিষ্যের আনন্দ হয়েছে, মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে, তখনই বুঝবে যে তার হৃদয়ে শান্তি এসেছে।
**********
খবরদার, হুকুম করে বা চাকর বাকর দিয়ে গুরুর সেবা শুশ্রষা করতে যেও না—প্রষাদ থেকে বঞ্চিত হয়ো না। মা নিজের হাতে ছেলেপিলের যত্ন করে বলে ছেলের উপর অশ্রদ্ধা আসে না- তাই অত ভালবাসা।
নিজহাতে গুরু সেবা করলে অহঙ্কার পাতলা হয়, অভিমান দূরে যায় আর প্রেম আসে।
গুরুই ভগবানের সাকার মূর্তি, আর তিনিই Absolute.* (অখন্ড)
গুরুকে আমার বলে জানতে হয়- মা, বাপ, পুত্র ইত্যাদি বাড়ীর লোককে ভাবতে গেলে যেন তার মুখও মনে পড়ে। তাঁর ভর্সনার ভয় রাখার চেয়ে ভালবাসার ভয় রাখাই ভাল; আমি যদি অন্যায় করি তবে তার প্রণে ব্যথা লাগবে। সবসময় তাঁকে অনুসরণ করতে চেষ্টা কর; তিনি যা বলেন, যত্নে তা রক্ষা করে অভ্যাসে চরিত্রগত ক’রতে নিয়ত চেষ্টা কর; আর তাই সাধনা।
**********
তুমি গুরুতে বা সৎ এ চিন্তা সংলগ্ন করে আত্নোন্নয়নে যত্নবান হও, অন্যে তোমার বিষয়ে কী বলছে দেখতে গিয়ে আকৃষ্ট হয়ে প’ড় না- তাহলে আসক্ত হয়ে পড়বে, আত্নোন্নয়ন হবে না।
স্বার্থবুদ্ধি অনেক সময়ে আদর্শে দোষারোপ করে, সন্ধেহ এনে দেয়, অবিশ্বাস এনে দেয়। স্বার্থবুদ্ধিবশতঃ আদর্শে দোষ দেখো না, সন্দেহ করো না, অবিশ্বাস করো না-করলে আত্মোন্নয়ন হবে না।
মুক্তস্বার্থ হয়ে আদর্শে দোষ দেখলে তার অনুসরন করো না-করলে আত্মোন্নয়ন হবে না।
আদর্শের দোষ-মূঢ় অহংকার, স্বার্থ-চিন্তা, অপ্রেম। অনুসরনকারীর দোষ-সন্দেহ, অবিশ্বাস, স্বার্থবুদ্ধি।
যিনি প্রেমের অধিকারী, নিঃসন্দেহচিত্তে তাঁরই অনুসরন কর, মঙ্গলের অধিকারী হবেই হবে।
যিনি ছলে বলে কৌশলে, যেমন করেই হোক না কেন, সর্ব্বভূতের মঙ্গলচেষ্টায় যত্নবান, তাঁরই অনুসরন কর, মঙ্গলের অধিকারী হবেই হবে।
যিনি কোনও প্রকারে কাহাকেও দুঃখ দেন না, অথচ অসৎ-এরও প্রশ্রয় দেন না, তারই অনুসরন কর, মঙ্গলের অধিকারী হবেই হবে।
**********
যাকে তুমি চালক রূপে মনোনীত করে নিয়েছ, তার কাছে তোমার হৃদয়ের কোনও কথা গোপন রেখো না। গোপন করলে তাকে অবিশ্বাস করা হবে, আর, অবিশ্বাসেই অধঃপতন। চালক অন্তর্য্যামী, যদি ঠিক-ঠিক বিশ্বাস হয়, তবে তুমি কুকার্য করতেই পারবে না। আর, যদি করেই ফেল তবে নিশ্চয়ই স্বীকার করবে। আর, গোপন করতে ইচ্ছা হলেই জেনো, তোমার হৃদয়ে দুর্বলতা এসেছে, এবং অবিশ্বাস তোমাকে আক্রমন করেছে,-সাবধান হও, নতুবা অনেক দূর গড়াবে।
তুমি যদি গোপন কর, তোমার সৎ-চালকও গা-ঢাকা দেবেন; আর, তুমি হৃদয়ের ভাব ব্যক্ত কর, উন্মুক্ত হও, তিনিও তোমার সম্মুখে উন্মুক্ত হবেন, ইহা নিশ্চয়ই।
গোপন অভিপ্রায়ে চালককে ‘অন্তর্য্যামী’ সবই জানতে পারছ-বলে চালাকি করলে নিজেই পতিত হবে, দূর্দ্দশায় ঘিরে ধরবে।
হৃদয়-বিনিময় ভালবাসার একটি লক্ষন, আর, তুমি যদি সেই হৃদয়ই গোপন কর, তবে এ-নিশ্চয়ই যে তুমি স্বার্থভাবাপন্ন, তাকে কেবল কথায় ভালবাস।
কামে গোপন আছে, কিন্তু ভালবাসায় তো উভয়ের ভিতর কিছুই গোপন থাকতে পারে না।
সৎ চালক পাতলা অহংযুক্ত; তিনি নিজে তার ক্ষমতা কিছুতেই তোমার নিকট জাহির করবেন না; এবং সেই জন্য তোমার ভাবানুযায়ী তোমাকে অনুসরন করবেন-আর, এ-ই সৎ-চালকের স্বভাব। যদি সৎ চালক অবলম্বন করে থাক, যাই করে থাক, যাই কর, ভয় নাই, মরবে না; কিন্তু কষ্টের জন্য রাজী থেকো।
**********
দীন হওয়া অর্থ নোংরা সাজা নয়কো।
ব্যাকুলতা মানে বিজ্ঞাপন নয়কো, বরং হৃদয়ের একান্ত উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা।
স্বার্থপরতা স্বাধীনতা নয়কো, বরং স্বাধীনতার অন্তরায়।
তুমি যত লোকের সেবা করবে তত লোকের যথাস্বর্ব্বস্বের অধীশ্বর হবে।
তেজ মানে ক্রোধ নয়কো, বরং বিনয়-সমন্বিত দৃড়তা।
সাধু মানে যাদুকর নয়কো, বরং ত্যাগী, প্রেমী।
ভক্ত মানে কি অহম্মক?-বরং বিনীত-অহংযুক্ত জ্ঞানী।
সহিষ্ণুতা মানে পলায়ন নয়কো, প্রেমের সহিত আলিঙ্গন।
**********
ক্ষমা কর কিন্তু অন্তরের সহিত; ভিতর গরম রেখে অপারগতাবশতঃ ক্ষমাশীল হতে যেও না। বিচারের ভার, শাস্তির ভার আপনহাতে নিতে যেও না; অন্তরের সহিত পরমপিতার উপর ন্যস্ত কর, ভাল হবে।
কাহাকেও অন্যায়ের জন্য যদি তুমি শাস্তি বিধান কর, নিশ্চয়ই জেনো-পরমপিতা ঐ শাস্তি উভয়ের মধ্যে তারতম্যানুসারে ভাগ করে দেবেন।
পিতার জন্য, সত্যের জন্য দুঃখ ভোগ করো, অনন্ত শান্তি পাবে।
তুমি সত্যে অবস্থান কর, অন্যায়কে সহ্য করতে চেষ্টা কর, প্রতিরোধ করো না, শীঘ্রই পরম মঙ্গলের অধিকারী হবে।
**********
যদি পাপ করে থাক, কাতর কন্ঠে তা, প্রকাশ কর, শীঘ্রই সান্ত্বনা পাবে।
সাবধান! সংকীর্নতা বা পাপকে গোপন রেখো না, উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হয়ে অতি সত্বর তোমাকে অধঃপতনের চরমে নিয়ে যাবে।
অন্তরে যা গোপন করবে তাই বৃদ্ধি পাবে।
**********
দান কর, কিন্তু দীন হয়ে প্রত্যাশা না রেখে। তোমার অন্তরে দয়ার দরজা খুলে যাক। দয়া করা হিসাবে দান অহঙ্কারের পরিপোষক।
যিনি কাতরভাবে তোমার দান গ্রহণ করেন, গুরুরূপে তিনি তোমার হৃদয়ে দয়া ভাবের উদ্বোধন করেন; অতএব কৃতজ্ঞ হও।
যাকে দান করবে তাকে অনুভব করে সহানুভূতি প্রকাশ কর, সাহস দাও, সান্তনা দাও; পরে যা সাধ্য, যত্ন-সহকারে দাও; প্রেমের অধিকারী হবে-দান সিদ্ধ হবে।
দান করে প্রকাশ যত না কর ততই ভাল, অহঙ্কার থেকে রক্ষা পাবে।
যাঞ্চাকারীকে ফিরিও না। অর্থ, না হয় সহানুভূতি, সাহস, সান্তনা, মিষ্টিকথা যা হয় একটা দাও-হৃদয় কোমল হবে।
অপরের মঙ্গল-কামনাই নিজ মঙ্গলের প্রসূতি।
**********
হেগে মরার চেয়ে হেটে মরা ভাল।
যে বলায় কম কাজে বেশী, সে-ই প্রথম শ্রেণীর কর্মী; যে যেমন বলে তেমনি করে, সে মধ্যম শ্রেণীর কর্মী; যে বলে বেশী, কাজে কম, সে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মী; আর যার বলতেও আলস্য, করতেও আলস্য, সেই অধম।
দৌড়ে যাও, কিন্তু হাঁপিয়ে যেও না; আর, হোঁচট খেয়ে যাতে না পড়, দৃষ্টি রেখো।
যে-কার্য্যে তোমার বিরক্তি ও ক্রোধ আসছে, নিশ্চয় জেনো, তা পন্ড হওয়ার মুখে।
কার্য্যসাধনের সময় তা হতে যে বিপদ আসবে, তার জন্য রাজি থাকো; বিরক্ত বা অধীর হয়ো না, সফলতা তোমার দাসী হবে।
চেষ্টা কর, দুঃখ করো না, কাতর হয়ো না, সফলতা আসবেই।
কার্য্যকূশলের চিহ্ন দুঃখের প্রলাপ নহে।
উত্তেজিত মস্তিষ্ক ও বৃথা আড়ম্বরযুক্ত চিন্ত-দুইটিই অসিদ্ধির লক্ষণ।
বিপদকে ফাকি দিয়ে ও পরাস্ত করে সফলতা-লক্ষ্মী লাভ কর; বিপদ যেন তোমার সফলতা থেকে বঞ্চিত না করে।
সুখ কিংবা দুঃখ যদি তোমার গতিরোধ না করে তবে তুমি নিশ্চয় গন্তব্যে পৌছিবে, সন্দেহ নাই।
**********
ধনী হও ক্ষতি নাই, কিন্তু দীন এবং দাতা হও।
ধনবান যদি অহঙ্কারী হয়, সে দূর্দ্দশায় অবনত হয়।
দীনতাহীন অহঙ্কারী ধনী প্রায়ই অবিশ্বাসী হয়, আর তার হৃদয়ে স্বর্গের দ্বার খোলে না।
অহঙ্কারী ধনী মলিনতার দাস, তাই জ্ঞানকে উপেক্ষা করে।
**********
ক্ষমা কর, কিন্তু ক্ষতি করো না।
প্রেম কর, কিন্তু আসক্ত হয়ো না।
খুব ভালবাস, কিন্তু মাখামাখি করো না।
বগবগানি পূর্ণত্বের চিহ্ন নয়।
যদি নিজে সন্তুষ্ট বা নির্ভাবনা হয়ে থাক, তবে অন্যের জন্য চেষ্টা কর।
যে পরিমানে দুঃখের কারণে মন সংলগ্ন হয়ে আভিভূত হবে, সেই পরিমানে হৃদয়ে ভয় আসবে ও দুর্বলতারগ্রস্থ হয়ে পড়বে।
যদি রক্ষা পেতে চাও, ভয় এবং দুর্বলতা বলে কিছু রেখো না; সৎ চিন্তা এবং সৎ কর্মে ডুবে থাক।
অসৎ-এ আসক্তি থেকে ভায়, শোক ও দুঃখ আসে।
অসৎ পরিহার কর, সৎ-এ আস্থাবান হও, ত্রাণ পাবে।
সৎ-চিন্তায় নিমজ্জিত থাক, সৎ-কর্ম তোমার সহায় হবে এবং তোমার চতুর্দিক সৎ হয়ে সকল সময় তোমাকে রক্ষা করবেই করবে।
**********
ধর্মকে জানা মানেই বিষয়ের মূল কারণকে জানা; আর তা জানাই জ্ঞান।
ঐ মূলের দিকে অনুরক্তিই ভক্তি; আর, ভক্তির তারতম্য অনুসারেই জ্ঞানের তারতম্য হয়। যতটুকু অনুরক্তিতে যতটুকু জানা যায়, ভক্তি আর জ্ঞানও ততটুকু হয়।
তুমি বিষয়ে যতটুকু আসক্ত হও, বিষয়-সম্মন্ধে তোমার জ্ঞানও ততটুকু হয়।
জীবনের উদ্দেশ্য অভাবকে একদম তাড়িয়ে দেওয়া, আর তা কেবল কারনকে জানলেই হতে পারে।
অভাবে পরিশ্রান্ত মনই ধর্ম আব ব্রক্ষ্ম জিঙ্গাসা করে, নতুবা করে না।
কিসে অভাব যায়, আর তা কেমন করে-এই চিন্তাতেই পরিশেষে ব্রক্ষ্ম-জিঙ্গাসা আসে।
যার উপর বিষয়ের অস্তিত্ব তাই ধর্ম; যতক্ষণ তা জানা যায় নাই, ততক্ষণ বিষয়কে ঠিক ঠিক জানা হয় নাই।
**********
যে-ভাব বিরুদ্ধ ভাব দ্বারা আহত বা অভিভূত না হয়, তাই বিশ্বাস।
বিশ্বাস না থাকলে দর্শন হবে কি করে? কর্ম বিশ্বাসের অনুসরণ করে; যেমনতর বিশ্বাস, কর্মও তেমনতর হয়।
গভীর বিশ্বাসে সবাই হতে পারে। বিশ্বাস কর,–সাবধান, অহঙ্কার, অধর্য্যে ও বিরক্তি না আসে—যা চাও তাই হবে।
বিশ্বাসই বিস্তার ও চৈতন্য এনে দিতে পারে, আর অবিশ্বাস, জড়ত্ব অবসাদ, সঙ্কীর্ণতা এনে দেয়।
বিশ্বাস যুক্তিতর্কের পর, যদি বিশ্বাস কর, যত যুক্তিতর্ক তোমার সমর্থন করবেই করবে।
তুমি যেমনতর বিশ্বাস করবে, যুক্তিতর্ক তোমায় তেমনতর সমর্থন করবে।
**********
ভাবেই বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা। যুক্তিতর্ক বিশ্বাসকে এনে দিতে পারে না। ভাব যত পাতলা, বিশ্বাস ততপাতলা, নিষ্ঠা তত কম।
বিশ্বাস বুদ্ধির গন্ডির বাইরে; বিশ্বাস-অনুযায়ী বুদ্ধি হয়। বুদ্ধিতে হনঁ-না আছে, সংশয় আছে; বিশ্বাসে হাঁ-না নেই, সংশয় নেই।
**********
যার বিশ্বাস যত কম যে তত undeveloped, বুদ্ধি তত কম, তীক্ষ্ণ।
তুমি পন্ডিত হতে পার, কিন্তু যদি অবিশ্বাসী হও, তবে তুমি কলের গানের রেকর্ডের কিংবা ভাষাবাহী বলদের মত নিশ্চয়।
যার পাকা বিশ্বাস নেই, তার অনুভূতি নেই; আর, যার অনুভূতি নেই, সে আবার পন্ডিত কিসের?
যার অনুভূতি যতটা, তার দর্শন, জ্ঞান ততটা; আর জ্ঞানের বিশ্বাসের দৃঢ়তা।
যদি বিশ্বাস না কর, তোমার দেখাও হয় না, অনুভব করাও হয় না। আবার, ঐ দেখা ও অনুভব করা বিশ্বাসকেই পাকা করে দেখা।
**********
যেরুপ আদর্শে তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তোমার স্বভাবও সেই ভাবে গঠিত হবে, আর তোমার দর্শন ও তদ্রুপ হবে।
বিশ্বাসীকে অনুসরন কর। ভালবাস, তোমারও বিশ্বাস আসবে।
আমার বিশ্বাস নেই-এই ভাবের অনুসরনে মানুষ হীন বিশ্বাস হয়ে পড়ে।
বিশ্বাস নেই এমনতর মানুষ নেই। যার বিশ্বাস যত গভীর, যত উচ্চ, তার মন তত উচ্চ, জীবন তত গভীর।
যে সৎ-এ বিশ্বাসী সে সৎ হবেই, আর। অসৎ-এ বিশ্বাসী অসৎ হয়ে পড়ে।
**********
বিশ্বাস বিরুদ্ধ ভাব দ্বারা আক্রান্ত হলেই সন্দেহ আসে।
বিশ্বাস সন্দেহ-দ্বারা অভিভূত হলে মন যখন তাই সমর্থন করে তখনই অবসাদ আসে।
প্রতিকূল যুক্তি ত্যাগ করে বিশ্বাসের অনুকূল যুক্তি শ্রবণ ও মননে সন্দেহ দূরীভূত হয়, অসসাদ থেকে না। বিশ্বাস পেকে গেলে কোন বিরুদ্ধ ভাবই তাকে টলেতা পারে না।
প্রকৃত বিশ্বাসীর সন্দেহই বাকী করবে, অবসাদই বা কী করবে।
সন্দেহকে প্রশ্রয় দিলে সে ঘুণপোকার মত মনকে আক্রমণ করে, শেষে অবিশ্বাসরূপে জীর্ণতার চরম মলিন দশা প্রাপ্ত হয়।
সন্দেহের নিরাকরণ করে বিশ্বাসের স্থাপন করাই জ্ঞানপ্রাপ্তি।
তুমি যদি পাকা বিশ্বাসী হও, বিশ্বাস-অনুযায়ী ভাব ছাড়া জগতে কোন বিরুদ্ধ ভাব কোন মন্ত্র, কোন শক্তি তোমাকে অভীভূত বা যাদু করতে পারবে না, নিশ্চয় জেনো।
তোমার মন থেকে যে পরিমাণে বিশ্বাস সরে যাবে, জগৎ সেই পরিমান তোমাকে সন্দেহ করবে বা অবিশ্বাস করবে, এবং দুর্দশাও তোমাকে সেই পরিমাণে আক্রমণ করবে, ইহা নিশ্চয়।
অবিশাস ক্ষেত্র দুর্দশা বা দুর্গতির রাজত্ব।
বিশ্বাস ক্ষেত্র বড়ই উর্বর। সাবধান, অবিশ্বাসরূপ আগাছার সন্দেহরুপে অঙ্কুর উঠতে দেখলেই তৎক্ষণাৎ তা উৎপাটন কর, নতুবা ভক্তিরূপ অমৃতবৃক্ষ গজাতে পারবে না।
শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস দুই ভাই, একটি আসলে আর একটি আসে।
সন্দেহের নিরাকরন কর, বিশ্বাসের সিংহসনে ভক্তিকে বসাও, হৃদয়ে ধর্মরাজ্য সংস্থাপন হোক।
সৎ-এ নিরবচ্ছিন্ন সংলগ্ন থাকার চেষ্টাকেই ভক্তি বলে।
ভক্তিই প্রকৃত জ্ঞানী, ভক্তিবিহীন জ্ঞান বাচকজ্ঞান মাত্র।
তুমি সোহহংই বল আর ব্রক্ষ্মস্মিই বল, কিন্তু ভক্তি অবলম্বন কর, তবেই সেই ভাব তোমাকে অবলম্বন করবে; নতুবা কিছুতেই কিছু হবে না।
বিশ্বাস যেমনতর, ভক্তি তেমনতরভাবে আসবে এবং জ্ঞানও তদানুযায়ী।
আগে নিরহঙ্কার হতে চেষ্টা কর, পরে সোহহং বল, নচেৎ সোহহং তোমাকে আরও অধঃপথে নিয়ে যেতে পারে।
তুমি যদি সৎচিন্তায় সংযুক্ত থাকতে চেষ্টা কর, তোমার চিন্তা, আচার, ব্যবহার ইত্যাদি উদার এবং সত্য হতে থাকবে; আর, সেই লক্ষণগুলিই ভক্তির।
সংকীর্ণতার নিকট গেলে মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে এবং বিস্তৃতির নিকট গেলে মন বিস্তৃতি লাভ করে; তেমনি ভক্তির নিকটে গেলে মন উদার হয়; আর, যত উদারতা ততই শান্তি।
**********
বিষয়ে মন সংলগ্ন থাকাকে আসক্তি বলে, আর সৎ-এ সংলগ্ন থাকাকে ভক্তি বলে।
প্রেম ভক্তিরই ক্রোমোন্নতি। ভক্তির গাঢ়ত্বই প্রেম। অহঙ্কার যেখানে যত পাতলা, ভক্তির স্থান সেখানে তত বেশি। ভক্তি ভিন্ন সাধনার সফল হওয়ার উপায় কোথায়? ভক্তিই সিদ্ধি এনে দিতে পারে।
বিশ্বাস যেমন অন্ধ হয় না, ভক্তিও তেমনি মুঢ় হয় না।
ভক্তিতে কোনও কালে কোনও রুপে দুর্বলতা নেই।
ক্লীবত্ব, দুর্বলতা অনেক সময় ভক্তির খোলস পরে দাড়ায়, তা হতে সাবধান হও।
**********
একটু কাঁদলেই বা নৃত্যগীতাদিতে উত্তেজিত হয়ে লম্ফ-ঝম্পাদি করলেই যে ভক্তি হল তা নয়কো; সাময়িক ভাবোন্মত্ততাদি ভক্তির লক্ষণ নয়কো। ভক্তির চরিত্রে পাতলে অহঙ্কারের চিহ্ন, বিশ্বাসের চিহ্ন, সৎ চিন্তার চিহ্ন, সদ্বব্যবহারের চিহ্ন এবং উদারতা ইত্যাদির চিহ্ন কিছু-না-কিছু থাকবেই থাকবে, নতুবা ভক্তি আসে না।
বিশ্বাস না এলে নিষ্ঠা আসে না, আর, নিষ্ঠা ছাড়া ভক্তি থাকতে পারে না।
দুর্বল ভাবোন্মত্ততা অনেক সময় ভক্তির মত দেখা যায়, সেখানে নিষ্ঠা নাই, আর, চক্তির ভরিত্রগত লক্ষণও নাই।
যার হৃদয়ে আছে সে বুঝতে পারে না যে সে ভক্ত; আর দুর্বলতা, নিষ্ঠাহীন, শুধু ভাবপ্রবণ, গাঢ়-অহংযুক্ত হৃদয় ভাবে আমি খুব ভক্ত।
অশ্রু পুলক, স্বেদ, কম্পন হলেই যে সেখানে ভক্তি এসেছে তা নয়কো, ভক্তির ঐগুলির সঙ্গে তার সধর্ম-চরিত্রগত লক্ষণ থাকবেই থাকবে।
অশ্রু, পুলক, স্বেদ, কম্পন ইত্যাদি ভাবের লক্ষণ; তা অনেক রকমে হতে পারে।
ভক্তির চরিত্রগত লক্ষণের সঙ্গে যদি ঐ ভাবের লক্ষঙুলি প্রকাশ পায়, তবেই তা সাত্ত্বিক-ভাবের লক্ষণ।
**********
জাল ভক্তি মোটা-অহংযুক্ত, আসল ভক্তি অহঙ্কার-মুক্ত অর্থাৎ খুব পাতলা-অহঙ্কার-যুক্ত।
জাল-ভক্তি-যুক্ত মানুষ উপদেশ নিতে পারে না, উপদেষ্টারুপে উপদেশ দিতেই পারে; তাই কেউ উপদেশ দিলে মুখে চটার লক্ষণ, বিরক্তির লক্ষণ, সঙ্গ পরিহারের চেষ্টা ইত্যাদি লক্ষণ প্রায় স্পষ্ট প্রকাশ পায়।
অবিশ্বাসী ও বহুনৈষ্ঠি হৃদয়ে ভক্তি আসতেই পারে না।
ভক্তি একের জন্য বহুকে ভালবাসে, আর আসক্তি বহুর জন্য এককে ভালবাসে।
আসক্তিতে স্বার্থ আত্মতুষ্টি, আর ভক্তিতে পরার্থে আত্মতুষ্টি।
ভক্তির অনুরোক্তি সৎ-এ আর আসক্তির নেশা স্বার্থে, অহং-এ।
আসক্তি কামের পত্নী, আর ভক্তি প্রেমের ছোট ভগিনী।
**********
অনুভূতির দ্বারা যা জানা যায় তাই জ্ঞান।
জানাকেই বেদ বলে, আর বেদ অখণ্ড। যে যতটুকু জানে সে ততটুকু বেদবিৎ। জ্ঞান ধাঁধাকে ধ্বংশ করে মানুষকে প্রকৃত চক্ষু দান করে।
জ্ঞান বস্তুর স্বরুপকে নির্দেরশ করে; আর, বস্তুর যে ভাব-জানলে জানা বাকি থাকে না, তাই তার স্বরুপ।
ভক্তি চিত্তকে সৎ-এ সংলগ্ন করতে চেষ্টা করে, আর তা হতে যেরূপ উপলব্দি হয় তাই জ্ঞান।
অজ্ঞানতা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে, জ্ঞান মানুষকে শান্ত করে। অজ্ঞানতাই দুঃখের কারণ, আর জ্ঞানই আনন্দ।
তুমি যতটুকু জ্ঞানের অধিকারী হবে, ততটুকু শান্ত হবে। তোমার জ্ঞান যেমনতর, তোমার স্বচ্ছন্দে থাকবার ক্ষমতাও তেমনতর।
**********
অহঙ্কার যত ঘন, অজ্ঞনতা তত বেশী; আর অহং যত পাতলা, জ্ঞান তত উজ্জ্বল।
সন্দেহ অবিশ্বাসে দূত, আর অবিশ্বাসই অজ্ঞানতার আশ্রয়।
সন্দেহ আসলে তৎক্ষনাৎ তা নিরাকরণের চেষ্টা কর, আর সৎ চিন্তায় মন নিমগ্ন হও-জ্ঞানের অধিকারী হবে আর আনন্দ পাবে।
তুমি অসৎ-এ যতই আসক্ত হবে ততই স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন হবে, আর ততই কুজ্ঞান বা মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে; আর রোগ, শোক, দারিদ্র, মৃত্যু ইত্যাদি যন্ত্রণা তোমার উপর ততই অধিপত্য করবে, ইহা নিশ্চয়।
**********
অহঙ্কার আসক্তি এনে দেয়; আসক্তি এনে দেয় স্বার্থবুদ্ধি; স্বার্থবুদ্ধি আনে কাম; কাম হতেই ক্রোধের উৎপত্তি; আর, ক্রোধ থেকেই আসে হিংসা।
ভক্তি এনে দেয় জ্ঞান; জ্ঞানেই সর্ব্বভূতে আত্মবোধ হয়; সর্বভূতে আত্মবোধ হলেই আসে অহিংসা; আর অধিংসা হতেই প্রেম। তুমি যতটুকু যে-কোনটির অধিকারী হবে, ততটুকু সমস্তগুলির অধিকারী হবে।
**********
অহঙ্কার থেকেই আসক্তি আসে; আসক্তি থেকে অজ্ঞনতা আসে; আর, অজ্ঞনতাই দুঃখ।
সন্দেহ থেকেই অবিশ্বাস আসে; আর, অবিশ্বাসই জড়তা।
আলস্য থেকেই মুঢ়তা আসে; আর, মুঢ়তাই অজ্ঞনতা।
বাধাপ্রাপ্ত কামই ক্রোধ, আর, ক্রোধ হিংসার বন্ধু।
স্বার্থবুদ্ধির আত্মতুষ্টির অভিপ্রায়ই লোভ; আর, এই লোভই আসক্তি। যে নির্লোভ সেই অনাসক্ত।
**********
সরল সাধুতার মত আর চতুরতা নেই; যে যেমনই হোক না কেন, এ ফাঁদে ধরা পড়বেই পড়বে। Honesty is the best policy.
বিনয়ের মত সম্মোহঙ্কারক আর কিছুই নেই।
প্রেমের মত আকর্ষণকারীই বা আর কে ?
বিশ্বাসের মত আর সিদ্ধি নেই।
জ্ঞানের মত আর দৃষ্টি নেই।
আন্তরিক দীনতার মত অহঙ্কারকে জব্দ করার আর কিছুই নেই।
সদগুরুর আদেশ পালনের মত আর মন্ত্র কী আছে?
চল এগিয়ে যাও, রাস্তা ভেবেই ক্লান্ত হয়ে পড়না, তাহলে আর যাওয়া হবে না।
**********
যে আগে ঝাপ দিয়েছে, আগে পথ দেখিয়েছে, সেই নেতা; নতুবা শুধু কথায় কি নেতা হওয়া যায়?
আগে অন্যের জণ্য যথাসর্বস্ব ঢেলে দাও, দশের পায়ে মাথা বিক্রয় কর, আর কারো দোষ বলে দোষ দেখা ভুলে যাও, সেবায় আত্মহারা হও, তবে নেতা, তবে দেশের হৃদয়, তবে দেশের রাজা। নতুবা ও-সব কেবল মুখে-মুখে হয় না।
যদি নেতা হতে চাও, তবে নেতৃত্বের অহঙ্কার ত্যাগ কর, আপনার গুনগান ছেড়ে আও, পরের হিতে যথাসর্বস্ব পণ কর, আর যা মঙ্গল ও সত্য নিজে তাই করে দেখাও, আর, সকলেকে প্রেমের সহিত বল; দেখবে হাজার হাজার লোক তোমার অনুসরণ করবে।
**********
নির্ভর কর, আর সাহসের সহিত অদম্য উৎসাহে কাজ করে যাও, লক্ষ্য রেখো, তোমা হতে তোমার নিজের ও অন্যের কোনওরূপে অমঙ্গল না আসে। দেখবে সৌভাগ্যলক্ষ্মী তোমার ঘরে বাধা থাকবে।
কথায় আছে “বীরভাগ্য বসুন্ধরা”। তা ঠিক; বিশ্বাস, নির্ভরতা আর আত্মত্যাগ এই তিনটিই বীরত্বের লক্ষণ।
**********
নাম যশ আত্মোন্নয়নের ঘোর অন্তরায়। তোমার একটু উন্নতি হলেই দেখবে কেউ তোমাকে ঠাকুর বানিয়ে বসেছে, কেউ মহা-পুরুষ বলছে, কেউ অবতার, কেউ সদগুরু ইত্যাদি বলছে; আবার কেউ শয়তান, বদমায়েস, কেউ ব্যবসাদার ইত্যাদিও বলছে; সাবধান! তুমি এদের কারো দিকে নজর দিও না। তোমার পক্ষে এরা সবাই ভূত, নজর দিলেই ঘাড়ে চেপে বসবে, তা ছাড়ানও মহা মুশকিল। তুমি তোমার মত কাজ করে যাও, যা ইচ্ছা তাই হোক।
নাম যশ ইত্যাদের আশায় যদি তোমার মন ভকের আচরণ করে, তাহলে তো মনে কপটতা লুকিয়ে রয়েছে, তাৎক্ষণাৎ তাকে মেরে বের করে দাও। তবেই মঙ্গল, নতুবা সবাই পন্ড হবে।
ঠাকুর, অবতার কিংবা ভগবান, ইত্যাদি হবার সাধ গেলেই তুমি নিশ্চয় ভন্ড হয়ে পড়বে, আর তাতে মুখে হাজার বললেও কাজে কিছুই করতে পারবে না। যদি ওরুপ ইচ্ছা থেকে থেকে, তবে এখনি ত্যাগ কর, নতুবা অমঙ্গল নিশ্চয়।
**********
তুমি যেমনতর প্রকৃত হবে, প্রকৃতি তোমাকে তেমনতর উপাধি নিশ্চয় দেবেন এবং নিজের ভিতরে তেমন অধিকারও দেবেন; ইহা নিত্য প্রত্যক্ষ করছ; তবে আর চাইবে কী? প্রাণপণে প্রকৃত হতে চেষ্টা কর। পড়ে না পাশ করলে কি ইউনিভার্সিটি কাউকে উপাধি দিয়ে থাকে?
ভুলেও নিজেকে প্রচার করতে যেও না বা নিজেকে প্রচার করতে কাউকে অনুরোধ কর না-তাহলে সবাই তোমাকে ঘৃণা করবে আর তোমা হতে দূরে সরে যাবে।
তুমি যদি কোনও সত্য জেনে থাক আর তা যদি মঙ্গলপ্রদ বলে জান, প্রাণপণে তারই বিষয়ে বল এবং সবাইকে জানতে অনুরোধ কর; বুঝতে পারলে সব্বাই তোমার কথা শুনবে এবং তোমার অনুসরণ করবে।
তুমি যদি সত্য দেখে থাক, বুঝে থাক, তবে তোমার কায়মনবাক্যে তা ফুটে বেরুবেই বেরুবে। তুমি তাতে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই স্থির থাকতে পারবে না; সূর্য্যকে কি অন্ধকারে ঢেকে রাখতে পারে?
**********
তোমার ভতরে যদি সত্য না থাকে, তবে হাজার বল, হাজার ভান কর, হাজার কায়দাই দেখাও, তোমার চরিত্রে, তোমার মনে, তোমার বাক্যে তার জ্যোতি কিছুতেই ফুটবে না; সূর্য্য যদি না থাকে, তবে বহু আলোও অহংকারকে একদম তাড়িয়ে দিতে পারে না।
যে সত্য প্রচার করতে গিয়ে আপন মহত্বের গল্প করে এবং সব সময় আপনাকে নিয়েই ব্যস্ত, আর নানারকমের কায়দা করে নিজেকে সুন্দর দেখাতে চায়, যার প্রতি-অঙ্গ-সঞ্চালনে ঝলকে-ঝলকে অহঙ্কার ফুটে বেরুচ্ছে, যার প্রেমে অহঙ্কার, কথায় অহঙ্কার, দীনতায় অহঙ্কার, বিশ্বাসে, জ্ঞানে, ভক্তিতে, নির্ভরতায় অহঙ্কার-সে হাজার পন্ডিত হোক, আর সে যতই জ্ঞান ভক্তির কথা বলুক না কেন, নিশ্চয় জেনো সে ভন্ড; তার কাছ থেকে বহুদূরে সরে যাও, শুনো না তার কথা; কিছুতেই তার হৃদয়ে সত্য নেই; মনে সত্য না থাকলে ভাব কি করে আসবে!
প্রচারের অহঙ্কার প্রকৃত প্রচারের অন্তরায়। সেই-প্রকৃত প্রচারক যে আপন মহাত্বের কথা ভুলেও মুখে আনে না, আর, শরীর দ্বারা সত্যের আচরন করে, মনে সত্যি-চিন্তায় মুদ্ধ থাকে এবং মুখে মনের ভাবানুযায়ী সত্যের বিষয়ে বলে।
যেখানে দেখবে, কেউ বিশ্বাসের গর্বেরর সহিত সত্যের বিষয় বলছে, দয়ার কথা বলতে বলতে আনন্দে এবং দীনতায় অধীর হয়ে পড়ছে, প্রেমের সহিত আবেগভরে সবাইকে ডাকছে, আলিঙ্গিন করছে, আর যে-মুহুর্তে তার মহত্ত্বের কথা কেউ বলছে, তা স্বীকার করছে না, বরং দীন এবং ম্লান হয়ে বুকভাঙ্গা মত হয়ে পড়ছে-খুবই ঠিক তার কাছে উজ্জ্বল সত্য আছেই আছে, আর, তার সাধারণ চরিত্রেও দেখতে পাবে, সত্যে ফুটে বেরুচ্ছে।
তুমি ভক্তিরুপ তেলে জ্ঞানরূপ পলতে ভিজিয়ে সত্যরূপ আলো জ্বালাও, দেখবে কত ফড়িং, কত পোকা, কত জানোয়ার, কত মানুষ তোমাকে কেমন করে ঘিরে ধরেছে।
যে সৎকেই চিন্তা করে, সৎকেই যাজন করে, যে সত্যেরই ভক্ত, সেই প্রকৃত প্রচারক।
আদর্শে গভীর বিশ্বাস না থাকলে নিষ্ঠাও আসে না, ভক্তিও আসে না; আর ভক্তি না হলে অনুভূতিই বা কী হবে, জ্ঞানই বা কী হবে, আর, সে প্রচারই বা করবে কী?
প্রকৃত সত্য-প্রচারকের অহঙ্কার তার আদর্শে; আর, ভন্ড-প্রচারকের অহঙ্কার আত্মপ্রচার।
যা মঙ্গল বালে জানবে, যা সত্য বলে জানবে, মানুষকে বলবার জণ্য বুক ফাটো-ফাটো হয়ে উঠবে, মানুষ তোমাকে যা-ই বলুক না কেন, মনে কিছুই হবে না, কিছু মানুষকে সত্যমুখী প্রচার বলি।
ঠিক ঠিক বিশ্বাস, নির্ভরতা ও ভক্তি না থাকলে সে কখনই প্রচারক হতে পারে না।
**********
যে নিজেকে প্রচার করে সে আত্মপ্রবঞ্চনা করে, আর, যে সত্যে বা আদর্শে মুগ্ধ হয়ে তার বিষয়ে বলে, সেই কিন্তু ঠিক-ঠিক আত্মপ্রচার করে।
প্রকৃত সত্য-প্রচারকই জগতের প্রকৃত মঙ্গলাকাঙ্খী। তার দয়ায় কতনা জীবের যে আত্মউন্নয়ন হয় তার ইয়ত্তা নেই।
তুমি সত্যে বা আদর্শে মুগ্ধ থাক, হৃদয়ে ভারব আপনি উথলে উঠবে, আর, সেই ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কত লোকের যে উন্নতি হবে তার কিনারা নেই।
গুরু হতে যেও না। গুরুমুখ হতে চেষ্টা কর; আর, গুরুমুখই জীবের প্রকৃত উদ্ধারকর্ত্তা।
**********
দেহ থাকতে অহঙ্কার যায় না, আর ভাব থাকতেও অহং যায় না। তাবে নিজের অহং আদর্শের উপর দিয়ে, passive হয়ে যে যত থাকতে পারে, সে তত নিরহঙ্কার এবং সে তত উদার।
নিজের গর্ব যত না করা যায় ততই মঙ্গল, আর আদর্শের গর্ব যত করা যায় ততই মঙ্গল।
পরমপিতাই তোমার অহঙ্কারের বিষয় হউন, আর তুমি তাঁতেই আনন্দ উপভোগ কর।
অসৎ আদর্শে তোমার অহঙ্কার ন্যাস্ত করো না; তাহলে তোমার অহঙ্কার আরও কঠিন হবে।
আদর্শ যত উচ্চ বা উদার হয় ততই ভাল, কারণ, যত উচ্চতা বা উদারতার আশ্রয় নেবে, তুমিও তত উচ্চ ও উদার হবে।
যখনই দেখবে, মানুষে তোমাকে প্রণাম করছে আর তাতে তোমার বিশেষ কোন আপত্তি হচ্ছে না, মৌখিক এক-একবার আপত্তি করছ বটে-মনে বিশেষ একটা কিছু হচ্ছে না-তখনই ঠিক জেনো, অন্তরে চোরের মত হামবড়াই ঢুকেছে; তুমি যত শীগ্র পার, সাবধান হও, নতুবা নিশ্চয়ই অধঃপতে যাবে।
আর, যখনই দেখবে প্রণাম করলেই অমনি দীনতায় তোমার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে, সেবা নিতে মন মোটেও রাজি নয়কো, বরং সেবা করতে মন সকল সময় ব্যস্ত রয়েছে, আদর্শের কথা বলতেই প্রাণে আনন্দ বোধ হচ্ছে-তোমার ভয় নেই, তুমি মঙ্গলের কোলেই রয়েছ; আর, নিয়ত আরও বেশী অমনি থাকতে চেষ্টা কর।
**********
তুমি লতার স্বভাব অবলম্বন কর আর আদর্শ স্বরূপ বৃক্ষকে জড়িয়ে ধর-সিদ্ধিকাম হবে।
যদি তোমার আদর্শের কথা বলতে আনন্দ, শুনতে আনন্দ, তার চিন্তায় আনন্দ, তার হুকুম পেলে আনন্দ, তাঁর আদরে আনন্দ, অনাদরেও আনন্দ, তাঁর নামে হৃদয় উথলে ওঠে-আমি নিশ্চয় বলছি, তোমার উন্নয়নের জন্য আর ভেব না।
সদগুরুর শরনাপন্ন হও, সৎ-নাম মনন কর, আর, সৎসঙ্গের আশ্রয় গ্রহণ কর-আমি নিশ্চয় বলছি, তোমাকে আর তোমার উন্নয়নের জন্য ভাবতে হবে না।
তুমি ভাক্তিরূপ জল ত্যাগ করে আসক্তিরুপ বালির চড়ায় বহুদূর যেও না, দুঃরুপে সূর্য্যোত্তাপে বালির চড়া গরম হলে ফিরে আসা মুশকিল হবে; অল্প উত্তপ্ত হতে-হতে যদি না ফিরে আসতে পার, তবে শুকিয়ে মরতে হবে।
ভাবমুখী থাকতে চেষ্টা কর, পতিত হবে না বরং অগ্রসর হতে থাকবে।
গুরুমুখী হতে চেষ্টা কর, আর মনের অনুসরণ করো না-উন্নতি তোমাকে কিছুতেই ত্যাগ করবে না।
বিবেককে অবলম্বন কর, আর মনের অনুসরণ করো না-উদারতা তোমাকে কখনও ত্যাগ করবে না। সত্যকে আশ্রয় কর, আর অসত্যের অনুগমন করো না-শান্তি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে থাকবে না।
দীনতাকে অন্তরে স্থান দাও-অহঙ্কার তোমার কিছি করতে পারবেনা।
যা ত্যাগ করতে হবে তার দিকে আকৃষ্ট বা আসক্ত হয়ো না-দুঃখ হতে রক্ষা পাবে।
**********
প্রেমকে প্রার্থনা কর, আর হিংসাকে দূরে পরিহার কর, জগৎ তোমার দিকে আকৃষ্ট হবেই হবে।
তোমার মনের সন্ন্যাস হোক; সন্ন্যাসী সেজে মিছামিছি বহুরুপী হয়ে বসো না।
তোমার মন সৎ-এ বা ব্রক্ষ্মে বিচরণ করুক, কিন্তু শরীরকে গেরুয়া বা রং চং এ সাজাতে ব্যস্ত হয়ো না, তাহলে মন শরিরমুখী হয়ে পড়বে।
অহঙ্কার ত্যাগ কর, সৎস্বরূপে অবস্থান করতে পারবে।
পতিতকে উদ্ধারের কথা শুনাও, আশা দাও, ছলে-বলে-কৌশলে তার উন্নয়নে সাহায্য কর, সাহস দাও-কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল হতে দিও না।
যদি কোনদিন তোমার প্রেমাস্পদকে সর্বস্ব বিকিয়ে নিমিজ্জিত হয়ে থাক, আর ভেসে উঠবার আশঙ্খা দেখ, তবে জোর করে তৎক্ষনাৎ নিমজ্জিত হয়ে বিগতপ্রাণ হও—দেখবে প্রেমাস্মদ কত সুন্দর, কেমন করে তোমাকে আলিঙ্গন করে আছেন।
যদি এতটুকু লোকনিন্দা, উপহাস, স্বজনানুরক্তি, স্বার্থহানি, অনাদর, আত্মা বাপরগঞ্জনা তোমার প্রেমাস্পদ হতে তোমাকে দূরে রাখতে পারে, তবে তোমার প্রেম কতই ক্ষীন-তা নয় কি?
কোন কিছু আজ বুঝেছি আবার কাল বুঝ যায় না-হেয়ালি ইত্যাদি বলে শৃগাল সেজো না-কারণ, ইতর জন্তুরাও যা বোঝে তা ভোলে না। তাই, এই প্রকার বলাটাই দৃষ্টি বা অস্থির-বুদ্ধির পরিচায়ক।
আজ উপকৃত হয়েছি বলে কাল আবার স্বার্থান্ধ হয়ে অপকৃত হওয়ার ভান করে অকৃতজ্ঞতাকে ডেকে এনো না। এর চাইতে ইতরমো আর কী আছে? যাকে-তাকে জিঙ্গাসা কর।
মুর্খতা না থাকলে উপকৃতের কুৎসায় উপকারীকে নিন্দিত করা যায় না।
উপকারী যখন উপকৃতের নিকট বিধ্বস্ত হয়, তখন মুঢ় অহং কৃতজ্ঞতারুপে অর্গল ভেঙ্গে দম্ভ-কন্ঠকাকীর্ণ মৃত্যুপথ উন্মুক্ত করে।
আশ্রিতের নিন্দায় যিনি আশ্রয়কে কুৎসিত বিবেচনা করেন-বিশ্বাসঘাতকতা তার পশ্চাৎ অনুসরণ করে।
প্রিয়ের প্রতি ভালবাসা বা মঙ্গলবিহীন-কর্ম কখনই প্রেমের পরিচায়ক নয়।
প্রিতমের জন্য কিছু করএ ইচ্ছা করে না-অথচ খুব ভালবাসি-এ কথাও যা আর, সোনার পিতলে ঘুঘুও তাই। স্বার্থ বুদ্ধিই প্রায় উক্ত প্রকার ভালবাসে, তাই-ঐ প্রকার নিষ্কাম-ধর্মাক্রান্ত ভালবাসা দেখে সবধান হওয়া ভাল, নতুবা বিপদের সম্ভাবনা অধিক।
ভালবাস-অথচ সে তোমার উপর জোর বা আধিপত্য, শাসন, অপমান, অভিমান কিংবা জিদ করলেই সুখ না হয়ে বরং উলটো হয় বা মুছে যায়,-আমি বলছি-তুমি ঠকবে ও ঠকাবে নিশ্চয়-তা তুমি যতদিন এমনতর থাক,-তাই এখনও সাবধান হও।
প্রেমের মোহ-বাধা পেলেই বুদ্ধি, প্রেমাস্মপদের অত্যাচারেও ঘৃণা আসে না, বিচ্ছেদে সতেজ হয়, মানুষকে মূঢ় করে না, চিরদিন অতৃপ্তি, একবার স্পর্শ করলে আর ত্যাগ হয় না-অপরিবর্তনীয়।
কামের মোহ-বাধায় ক্ষীণ, কামের অত্যাচারে বা যেরূপে চাওয়া যায় সেরূপে না চাইলে ঘৃণা, বিচ্ছেদে ভুল, মানুষকে কাপুরুষ ও মূঢ় করিয়া তোলে, ভোগেই তৃপ্তি ও বিষাদ, চিরদিন থাকে না-পরিবর্ত্তনীয়।
গরীয়ান হও কিন্তু গর্বিত হয়ো না।
যদি মুগ্ধ করতে চাও, তবে নিজে সম্পূর্ণভাবে মুগ্ধ হও। যদি সুন্দর হতে ইচ্ছা থাকে তবে বিশ্রীতেও সুন্দর দেখ।
একানুরক্তি, তীব্রতা ও ক্রমাগতিতেই জীবনের সৌন্দর্যতা ও স্বার্থকতা।
বহু ভাললাগা যে এক ভালো লাগাকে টলাতে বা বিচ্ছিন্ন করতে পারে না, সেই ভাললাগাই প্রেমের ভগিনী।
ভালমন্দ বিচার করে বিদ্ধস্ত্ব হওয়ার চেয়ে সৎ-এ (গুরুতে) আকৃষ্ট হও নির্বিঘ্নে সফল হবে নিশ্চয়।
দুর্বলতার সময় সুন্দর সবলতার চিন্তা করো, আর অহঙ্কারে প্রিয় ও দীনতার চিন্তা করো-মানসিক স্বাস্থ্য অক্ষুন্ন থাকবে।
দোষ দেখে দুষ্ট হয়ো না আর তোমাতে সংলগ্ন সবাইকে দুষ্ট করে তুলো না। তাকে দাও-চেও না-পেলে আনন্দিত হয়ো।
তুমি তার ইচ্ছাধীন হও, তোমার ইচ্ছাধীন তাকে করতে চেষ্টা করো না-কারণ তোমার নিকট তিনিই সুন্দর।
মিলনের আকুলতাকে কিছুতেই ত্যাগ করো না, তাহলে বিরহের ব্যথা মধুর হবে না-আর, দুঃখের ভিতর শান্তিকে অনুভব করতে পারবে না।
যার উপর তোমার ভাবা, করা ও বোধযতখানি ও যেমনতর, টান বা ভালবাসা ততখানি ও তেমনতর।
যাঁতে সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়েছ-তিনিই তোমার ভগবান, আর তিনিই তোমার গরম গুরু।
**********
যেমন করে যা পেতে হয়, তা না করে সেজন্য দুঃখিত হয়ো না।
করার আগে দুঃখ করা না-পাওয়াকেই ডেকে আনে।
পেতে হলে-তা যাই হোক, শুনতে হবে তা কি করে পাওয়া যায়-আর ঠিক ঠিক তা করতে হবে-না করে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হওয়ার চেয়ে বোকামি আর কী আছে?
নিশ্চয় জেনো করাই পাওয়ার জননী।
করাটা যখই চাওয়াকে অনুসরণ করে-তার কৃতার্থতা তখনই সামনে এসে দাঁড়ায়।
মানুষের আকাঙ্খিত মঙ্গল তার অভ্যস্ত সংস্কারের অন্তরালে থাকে, আর মঙ্গলদাতা তখনই দন্ডিত হন-যখনই দেওয়া মঙ্গলটার অভ্যস্ত সংস্কারের সাঙ্গে বিরোধ উপস্থিত হয়-আর তাই প্রেরিত-পুরুষ স্বদেশে কুৎসামন্ডিত হন।
প্রকৃতি তাদের ধিক্কার করে, যারা নাকি প্রত্যক্ষকে অবজ্ঞা বা অগ্রাহ্য করে পরোক্ষকে আলিঙ্গন করে।
আর, পরোক্ষ যাকে প্রত্যক্ষকে রঞ্জিত ও লাঞ্চিত করে-তারাই ফাঁকির অধিকারী হয়।
**********
যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে যা-কিছু হয়ে তাই আছে-তাই ব্রক্ষ্মা।
জগতের সমস্ত ঐশ্বর্য-জানা, ভালবাসা ও কর্ম-যার ভিতর সহজ-উৎসারিত, আর যার প্রতি আসক্তিতে মানুষের বিছিন্ন জীবন ও জগতের সমস্ত বিরোধের চরম সমাধান লাভ হয়-তিনিই মানুষের ভগবান।
ভগবানকে জানা মানেই সমস্তটাকে বুঝা বা জানা।
যার কো মুর্ত্ত আদর্শে কর্মময় অটুট আসক্তি-সময় বা সীমাকে ছাপিয়ে তাঁকে সহজভাবে ভগবান করে তুলেছে-যার কাব্য, দর্শন ও বিজ্ঞান মনের ভাল-মন্দ বিচ্ছিন্ন সংস্কারগুলিকে ভেদ করে ঐ আদর্শেই সার্থক হয়ে উঠেছে-তিনিই সদগুরু।
যার মন সৎ বা একাসক্তিতে পূর্ণ তিনিই সৎ বা সতী।
আদর্শে মন সম্যুক প্রকারে ন্যস্ত করার নাম সন্ন্যাস।
কোন বিষয়ে মন সম্যুকভাবে লেগে থাকার নাম সমাধি।
নামে মানুষকে তীক্ষ্ণ করে আর ধ্যানে মানুষকে স্থির ও গ্রহনক্ষম করে।
ধ্যান মানেই কোন-কিছু একটা চিন্তা নিয়ে লেগে থাকা। আর, তাই আমরা বোধ করতে পারি-যা-ই আমাদের লেগে থাকাটার বিক্ষেপ এনে দেয়, কিন্তু ভেঙ্গে দিতে পারে না।
বিরক্ত হওয়া মানেই বিক্ষিপ্ত হওয়া। তীক্ষ্ণ হও, কিন্তু স্থির হও-সমস্ত অনুভব করতে পারবে। কোন কিছুতেই যুক্ত হওয়া বা একমুখী আসক্তির নামই যোগ।
কোন কিছুর দ্বারা প্রতিহত হলে যা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়-তাই অহং। অহংকে শক্ত করা মানেই অন্যকে জানা।
বস্তু-বিষয়ক সম্যক দর্শন দ্বারা তন্মনে মনের নিবৃত্তি যাদের হয়েছে তারাই ঋষি।
মনের সর্বপ্রকার গ্রন্থির (সংস্কারের) সমাধান বা মোচন হয়ে এক-এ সার্থক হওয়াই-মুক্তি।
যে-ভাব ও কর্ম মানুষকে কারণমুখী করে দেয়-তাই আধ্যাত্মিকতা।
যে-তুলনা অন্তনিহিত কারণকে ফুটিয়ে তোলে তাই প্রকৃত বিচার।
কোন বস্তুকে লক্ষ্য করে তার স্বরুপ নির্দেশক বিশ্লেষণই যুক্তি।
কোন কাজ করে-বিচার দ্বারা তার ভাল-মন্দ অনুভব করে যে তাপের দরুন মন্দে বিরক্তি আসে-তাই অনুতাপ।
যেখানে গমন করলে মনের গ্রন্থি মোচন হয় বা সমাধান হয়-তাই তীর্থ।
যা করলে আস্তিত্বকে রক্ষা করা হয় তাই পূণ্য।
যা করলে রক্ষা হতে পতিত হয়-তা পাপ।
যার অস্তিত্ব আছে এবং তার বিকাশ আছে তাই সত্য (Real)।
যা ধারন করতে মনের নিজত্ব অক্ষুন্ন থাকে-তাই সসীম।
যা ধারণা করতে গিয়ে মন নিজত্ব হারিয়ে ফেলে-তাই অনন্ত বা অসীম।
শান্তি ! শান্তি !! শান্তি !!!

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×