স্কাইপি কেলেঙ্কারির পর অনেকের মত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমিও শঙ্কিত, কারণ এই নিয়ে আওয়ামি লিগ অনেক অপরাজনীতি করেছে, জামায়াত মরিয়া ও সর্বাত্মক অবস্থানে চলে গেছে আর বিএনপি নিয়েছে সুবাধাবাদি অপকৌশলের. বরাবরের বাঙ্গালি চরিত্রের মত ব্লগেও আমরা দলীয় আনুগত্যের উর্ধে যাই না, সত্যমিথ্যার বেসাতি চলে নিয়মিত, জেনে বা না-জেনে, বুঝে বা না-বুঝে. আজকের পোস্টটা স্বভাবতই পিছন ফিরে শুরু করতে হচ্ছে.
১৯৭৫ সালের ২০ শে এপ্রিল পর্যন্ত দালাল আইনে ৭৫২ জন ব্যাক্তি দন্ডিত হয়। যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জনেরও বেশী ফাঁসির আসামী ছিলো। জিয়ার এই দালাল আইন বাতিল করবার পরেও কিন্তু সেই ৭৫২ জন কোনোভাবেই উপরের ডকুমেন্টস অনুযায়ী মুক্তি পেতে পারেন না। - জানতে চেয়েছেন লিগপন্থী ব্লগার নিঝুম মজুমদার
দেখা যাক, একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায় বইতে কী লিখেছে -
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর একটি আকস্মিক সরকারী ঘোষণায় দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন সকল আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ইতিপূর্বেকার সমস্ত প্রতিশ্রুতি, জনসভায় ক্রন্দন, মানব সমাজ ও ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকার ভীতি প্রকাশ করে দেয়া বক্তব্য প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি বিস্মৃত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ নির্দেশ দেন যেন এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত দালালকে ছেড়ে দেয়া হয়, যাতে তারা দেশের তৃতীয় বিজয় দিবস পালনের উত্সবে শরীক হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এই দালালদের দেশ গড়ার কাজে সামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং শান্তি ও কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার চক্রান্তকারী দালালসহ মূল স্বাধীনতা বিরোধীরা জেল থেকে বেড়িয়ে আসে।
৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে সাধারণ ক্ষমার ফলোআপ এসেছিলো যে সিদ্ধান্তটাকে সকল মহল স্বাগত জানিয়েছে। সেখানেই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মোট সংখ্যা ৩৭ হাজার ৪শত ৭১ শিরোনামে লেখা হয়েছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মালেক উকিল বলেন যে, আটককৃত বা সাজাপ্রাপ্ত অনেক প্রাক্তন নেতা এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় মুক্তি লাভ করিবেন। ...যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্ণর ডাঃ এ এম মালেক ও তাহার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ শীঘ্রই মুক্তিলাভ করিবেন। অন্যদের মধ্যে যাহারা মুক্তি পাইবেন তাহাদের মধ্যে ডঃ কাজী দীন মোহাম্মদ, ডঃ হাসান জামান, ডঃ সাজ্জাদ হোসেন, ডঃ মোহর আলী (প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল শিক্ষক) ও খান আবদুর সবুরও রহিয়াছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাহাদের সম্পত্তি ফেরত পাইবেন এবং দেশের নাগরিকদিগকে প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করিবেন।
অনুসিদ্ধান্ত কী এল? ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’-এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দন্ডপ্রাপ্ত ৭৫২ জনের মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্ণর ডাঃ এ এম মালেক ও তাহার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় ডিসেম্বর ১৯৭৩ এ-ই মুক্তিলাভ করেছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত পালের গোদারাই যখন ১৯৭৩-এ মুক্তি পেয়ে গেলেন তখন ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকৃত দালাল আইন বাতিরকরণ অধ্যাদেশ দণ্ডপ্রাপ্ত ঐ ৭৫২ জনকে জিয়া নিঃশর্তে মুক্তি দিয়েছেন বলাটা কতটা অযৌক্তিক ও হাস্যকর, বুঝতে না পারার কথা নয়. হ্যাঁ, দণ্ডপ্রাপ্ত মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং শান্তি ও কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার চক্রান্তকারী দালালসহ মূল স্বাধীনতা বিরোধীরা ডিসেম্বর ১৯৭৩-এ জেল থেকে বেড়িয়ে আসে এবং তারা ঐ ৭৫২ জনেরই অন্তর্ভূক্ত.
প্রকৃতপক্ষে, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদিতে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বে না বলে সরকারি প্রেসনোটে (বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা : কিছু দালিলিক চিত্র ও প্রাসঙ্গিক গল্প....অমি রহমান পিয়াল) বলা হয়েছিল. এর সাথে দন্ডপ্রাপ্ত ৭৫২ জনের কোন সম্পৃক্ততা নাই. দণ্ডপ্রাপ্তরাসহ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকালিন অনিষ্পত্তিকৃত ৩৪,৬২৩ জনের মধ্যেও যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িত ছিলেন তারাও এই সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়বেন না - এটাইতো আমি বুঝলাম!
আসল ব্যাপার হল, বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে শুধু প্রেসনোট দিয়েছিলেন এবং দণ্ডিত ও অভিযুক্ত দালালদের (হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগকারীদের ব্যতিত) মুক্তও করা শুরু করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’ কে কার্যত রহিত করে ফেললেও কোন আইন প্রণয়ন বা অধ্যাদেশ জারি করে বাতিল করেন নাই. বস্তুত, বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম কার্যত বাতিল ১৯৭২ এর দালাল অধ্যাদেশকে রহিত করে রেটিফাই করেছেন মাত্র! বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে রেটিফাই না-করেই কার্যকরী করে কার্যত বাতিল করে ফেলা দালাল অধ্যাদেশকে জিয়ার পক্ষে কার্যকরী করা কখনও সম্ভব হত না, আর তার রাজনৈতিক অভিলাসের পক্ষেও তা করাটা সময়ের বিচারে শুভ হত না.
আমি বুঝতে অক্ষম, দণ্ডপ্রাপ্ত মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং শান্তি ও কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দরা কী ধরণের অপরাধে অভিযুক্ত ছিলেন, পালের গোদা হয়েও কেন নিজ হাতে হত্যা, ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগ না করুক, নেতৃত্বের দায় কী ছিল না? এতে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগকারীদের ব্যতিত অন্যদের মুক্তি না দেয়ার যে ঘোষণা ছিল, কার্যত তাও মানা হয়নি বা আইওয়াশ ছিল বলেই প্রতীয়মান.
একটি গুরুতর আইনি প্রশ্ন : তৎকালিন আওয়ামি লিগ নিজেদের জারিকৃত ১৯৭২-এর দালাল অধ্যাদেশকে কীভাবে, কী বিধিবিধানমতে নতুন কোনো অধ্যাদেশ জারি না করে বা আইন প্রণয়ন না করেও শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর মৌখিক ঘোষণা ও তৎপরবর্তী সরকারি প্রেসনোট দিয়ে বাতিল বলে চালিয়ে দিয়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্ত তাবৎ দালালদের পালের গোদাদেরসহ পালাক্রমে মুক্তি দেয়ার প্রয়াস পেল? আইনের শাসন ও প্রশাসনিক বিধিবিধানকে কতখানি তুচ্ছজ্ঞান করতো তৎকালিন লিগ/বাকশাল সরকার, এটা তার নমুনা বটে!
পূর্বে বর্ণিত সোর্সে নিঝুম মজুমদার ১৯৭৪-এর ২ এপ্রিলে দালাল আইনে বিচারের প্রমাণ দিয়েছেন, অর্থাৎ দণ্ডিত পালের গোদারা মুক্তি পেলেও বিচ্ছিন্নভাবে চুনোপুটি দালালেরা কেউ কেউ যে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অপরাধে পার পেতে পারেননি, দেখা যাচ্ছে. এক যাত্রায় কী ভীষন ভিন্ন ফল!
আর তাই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভুলের দায় দলীয় চশমা দিয়ে মিথ্যার বেসাতি খুলে অন্যায্যভাবে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে গেলে গোঁজামিলটা ধরা পড়বেই!
নিঝুমের পোস্টে ৭২-এর দালাল অধ্যাদেশ বাতিল করে জারিকৃত ৭৫-এর অধ্যাদেশের ছবি দেয়া আছে, ছবির উপর বোল্ড করে ‘ঘাতকদালালদেল নিঃশর্ত মুক্তির গেজেট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে আর মুক্তির শর্তগুলিও তিনি অনুবাদ করে দিয়েছেন যার ইংরেজিও স্পষ্টই পড়া যায় – তাহলে নিঃশর্ত হল কীভাবে? দলবাজির ধোঁকা দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না, ধরা পড়বেই!
----------------------------------------------
এবার দেখুন, দালালদের বিচার করা যে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষনার জন্যেই রুদ্ধ হয়েছিল, সেটা যারা ভূক্তভোগী, যারা স্বজন হারিয়েছেন, তারাই বলেছেন. 'একাত্তরের ঘাতক দালালেরা কে কোথায়' বইয়ের কিছু তথ্যের উদ্ধৃতি দিচ্ছি –
জাহানারা ইমাম বলেছেন, ‘গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যায় যাদের ভূমিকা সস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল,... সাধারণ ক্ষমার জন্য তা হয় নি। তত্কালীন সরকারের সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক একটি ভুল। সেদিন ক্ষমা ঘোষণা না করা হলে ঘাতকরা নিজেদের সমাজে পুনর্বাসিত করার সুযোগ পেত না।.......
শহীদ শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার বলেন, বর্তমানে রাজাকার, আল বদরদের যে দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমারই ফল। ওই ক্ষমা ছিল বিচার-বুদ্ধি হীন। সেদিন সরকার যদি ঘাতকদের বিচার করে সাজা দিত, তাহলে আজ এ অবস্থা হত না।... আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোন নেতা যুদ্ধে আপনজন হারান নি। ফলে স্বজন হারানোর ব্যথা তাদের জানা ছিল না। ঘাতকদের তারা সহজেই ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন।...
তিন শহীদ ভাই বদিউজ্জামান বদি, শাহজাহান ও করিমুজ্জামান ওরফে মল্লুক জাহানের (রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাদের লাশ পাওয়া যায়) ফুপাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হুদা আওয়ামী লীগ সরকারের সাধারণ ক্ষমা সম্পর্কে বলেন, রাষ্ট্র প্রধান যে কাউকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু যারা লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী লোককে হত্যা করেছিল তাদের ক্ষমা করে দেয়া অমার্জনীয় অপরাধ ছিল। ছিল একটি চরম ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, শুধু ক্ষমা নয়, ঐসরকার শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাও প্রদর্শন করেনি।
শহীদ বদির পুত্র তুরানুজ্জামান বলেন যে, আমার পিতার হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ায় আমি স্তব্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মর্তুজার স্ত্রী মিসেস মর্তুজা বলেন, যাদের প্রাণ গেছে , তাদের আত্মীয়- স্বজনরাই বুঝতে পেরেছেন, শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমার মর্মান্তিক মর্ম।
‘স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রারম্ভে হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে নিহত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙারোর একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানের অমর সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা মাহমুদ বলেন, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা কোন ভাবেই উচিত হয় নি।... ’৭১ সালে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মিলে যারা একের পর এক হত্যাকান্ড চালিয়েছে, তারাই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একইভাবে কাজ করছে। আর এটা ঐ সাধারণ ক্ষমারই ফল।
শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস মনোয়োরা চৌধুরী বলেন, ঘাতকদের সাধারণ ক্ষমা করা হবে তা আমরা ভাবরতই পারিনি। কিন্তু সরকার সাধারণ ক্ষমা করে দিলেন। আমরা ভেবেছিলাম শেখ মুজিবুর বহমান ঢাকায় এসে ঘাতকদের বিচার করবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। শেখ মুজিব তো ব্যক্তিগতভাবেও আমদের চিনতেন। সে চেনা-জানাটুকুও কাজে লাগালো না।
জ্যোতির্ময় গুহ ঠকুর্তার বিধবা স্তী বাসন্তী গুহ ঠকুর্তা সাধারণ ক্ষমা সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন যে, ১শ’ ৯৫ জন যুদ্ধ অপরাধী পাক সামরিক অফিসারদের কোন বিচার হলো না? শেখ মুজিব তো বহুবার বললেন, যুদ্ধ অপরাধী পাক সামরিক অফিসারদের বিচার করবেন। কিন্তু পারলেন না। আবার তিনি এ দেশীয় ঘাতকদেরও ক্ষমা করে দিলেন। আর এই ক্ষমাটাই সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। সেদিন যদি ক্ষমা না করে অন্ততঃ দু’একজন ঘাতকেরও যদি সাজা হতো তাহলে অনেক শহীদ পরিবারই শান্তি পেতেন। তাছাড়া ঘাতকরাও আজ আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না।
শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হকের স্ত্রী বেগম সুরাইয়া খানম বলেন, ঘাতকদের আমরা তো ক্ষমা করিনি। ক্ষমা করেছে সরকার। আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তা পাইনি।
শহীদ অধ্যাপক মোহাম্মদ সাদেকের স্ত্রী শামসুন্নাহার বলেন, যাদের ক্ষমা করা হয়েছে তাদেরকে আমরা ঘৃণার চোখে দেখি। সেই ক্ষমার জোরে আজ সেই সব দালাল রাজাকাররা এখন আমাদের বাড়ি থেকে উত্খাতের চেষ্টা করছে। সাধারণ ক্ষমা একটা গুরুতর অপরাধ ছিল।
সংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের জ্যৈষ্ঠ পুত্র শাহীন রেজা বলেন, শুধু সাধারণ ক্ষমা নয়, এর আগে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছিল। হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সুকৌশলে রেহাই দেয়া হয়। অথচ যাদের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডের কোন প্রমাণ ছিলনা তাদেরকে জেলে ঢোকানো হয়। এছাড়াও যারা হত্যার মূল পরিকল্পনা করেছিল তারাও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় সকল দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এরকম প্রহসনমূলক বিচারর পর আবার আসলো সাধারণ ক্ষমা।... এটা অত্যন্ত গর্তিত কাজ হয়েছিল। আর এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তত্কালীন সরকারের অদুরদর্শিতাই প্রমাণিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছিল বলেই আজ তারা সমাজ ও রাজরীতিতে পুনর্ববাসিত হয়েছে।
ইউনিট কমান্ডার শহীদ শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহের বাকির পিতা শেখ মোহাম্মদ আবদুল বারী বলেন, শহীদদের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতে আওয়ামী লীগ সরকার ’৭১-এর ঘতকদের ক্ষমা করে দিল। এই ক্ষমা ছিল এক অদ্ভুত খেয়ালীপনা। পৃথিবীতে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। খুনীদের ক্ষমা করে দিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে তা মেনে নেয়া যায় না। ... আর এই না হওয়াটা অমার্জনীয় অপরাধ...
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক দালালেরা কে কোথায়' বইতে জাহানারা ইমাম, পান্না কায়সার, মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হুদা, তুরানুজ্জামান বা শাহীন রেজারা সুবিচার না পাওয়ার জন্যে স্পস্টতই বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ঘোষনাকে দায়ী করেছেন, জিয়াকে নয়. শহীদদের স্বজনরা কিংবা বইয়ের প্রকাশক কেউই বিএনপির জন্যে কোন বাড়তি সহানুভূতি রাখেন না, তাহলে দলবাজি করার মিথ্যাচার কোন?
------------------
দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে বলে বঙ্গবন্ধু কী কী বলেছিলেন তা দেখা যাক -
১০ জানুয়ারী রমনা রেসকোর্স ময়দানে ক্রন্দনরত অবস্থায় শেখ মুজিব বলেন, বিশ্বকে মানবেতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক দল এই বর্বরতার তদন্ত করুক এই আমার কামনা।... যারা দালালী করেছে, আমার শত শত দেশবাসীকে হত্যা করেছে , মা বোনকে বেইজ্জতি করেছে, তাদের কি করে ক্ষমা করা যায়? তাদের কোন অবস্থাতেই ক্ষমা করা হবে না, বিচার করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে। (দৈনিক বাংলা, ১১/১/৭২)
১২ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করার পর বলেন, লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কাহিনী আমারা শুনেছি, তবু বাংলার মানুষ এত নীচে নামবে না, বরং যা মানবিক তাই করবে, তবে অপরাধীদের আইনানুযায়ী অবশ্যই বিচার হবে।’ (দৈনিক বাংলা, ১৩/১/৭২)
১৪ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ অফিসে বলেন, দালালদেরকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। (পূর্বদেশ, ১৫/১/৭২)
৬ ফেব্রুয়ারী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দশ লক্ষ লোকের বৃহত্তম জনসমাবেশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘যারা গণহত্যা চালিয়েছে তারা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, এদর ক্ষমা করলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না।’ (দৈনিক বাংলা, ৭/২/৭২)
২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় জনসভায় তিনি বলেন, ‘বাংলার মাটিতেই খুনীদের বিচার হবে।’(দৈনিক বাংলা ২৩/২/৭২)
৩০ মার্চ চট্টগ্রামের জনসভায় গণহত্যাকারীদের ‘নমরুদ’ বলে আখ্যায়িত করে তিনি প্রশ্ন করেন দালালদের ক্ষমা করা হবে কি না, সমবেত জনতা হাত তুলে বলে ‘না,’ ‘না।’ (পূর্বদেশ, ৩১/৩/৭২)
৩১ মার্চ খুলনার জনসভায় বলেন, ‘বর্বর হানাদার বাহিনীর সাথে স্থানীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, জামাত প্রভৃতি যোগ দেয়। তারা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যদি কেউ দালালদের জন্য সুপারিশ করতে আসে তবে তাকেই দালাল সাব্যস্ত করা হবে, দালালদের কখনোই ক্ষমা করে দেয়া হবে না।’ (পূর্বদেশ, ১/৪/৭২)
২৬ এপ্রিল তিনি দিল্লী স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘যারা গণহত্যা করেছে তাদের এর পরিণতি থেকে রেহাই দেয়া যায় না। এরা আমার ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে। এদের ক্ষমা করলে ভবিষ্যত্ বংশধরগণ এবং বিশ্ব সমাজ আমাদের ক্ষমা করবেন না।’ (দৈনিক বাংলা, ৩০/৪/৭২)
৬ মে এবিসি সাথে এক টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘আমি অবশ্যই তাদের বিচার করব, এ ব্যাপারে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। যেখানে তারা ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে সেখানে কোন দেশ কি তাদের ছেড়ে দিতে পারে?... অবশ্য যারা অপরাধ সংগঠনের জন্য দায়ী নিশ্চিতভাবেই তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।’ (আজাদ, ১৫/৫/৭২)
এত বাগাড়ম্বর করে, এমনকি কেউ দালালদের জন্য সুপারিশ করতে আসে তবে তাকেই দালাল সাব্যস্ত করা হবে বলে ঘোষনা দেয়ার পর পাল্টি খাওয়াকে জাতি বিশেষ করে স্বজন-হারানো, ইজ্জত-হারানো ও সম্পদ-হারানো ক্ষতিগ্রস্থরা স্পোর্টিঙলি নেবে, তা হয় না. আমরা বরং বঙ্গবন্ধুর চলমান নানান বিরূপ পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় অগত্যা নিজের বাগাড়ম্বরকে এমন গিলে খেয়েছেন বলে অনুমান করতে পারি.
-----------------------------------
এবার যাক, বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশ ১৯৭২-কে কীভাবে ঘাতকদের রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে 'একাত্তরের ঘাতক দালালেরা কে কোথায়' বইয়ে লেখা হয়েছে -
১. বিভিন্ন মহল থেকে দালালদের বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আদালোতের দাবীকে উপেক্ষা করে জারী করা ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’ এ দালালদের বিচারের জন্য এই আদেশ অনুযায়ী আসামীর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করার অধিকার থাকলেও ফরিয়াদীকে ট্রাইব্যুনালের বিচার্য অপরাধের জন্য অন্য কোন আদালতের বিচার প্রার্থনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
২. গণহত্যাকারী ও দালাল নেতাদের সুকৌশলে রক্ষার জন্য আইনের ৭ম ধারায় বলা হয়েছিল, থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি যদি কোন অপরাধকে অপরাধ না বলেন তবে অন্য কারো কথা বিশ্বাস করা হবে না, অন্য কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার হবে না ট্রাইব্যুনালে। অন্য কোন আদালতেও মামলা দায়ের করা যাবে না। দালালদের আত্মীয়-স্বজনের ওসিকে তুষ্ট করার মত আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল, স্বজন হারানো নির্যাতিত দরিদ্র জনসাধারণের তা ছিল না।
৩. সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে দালাল-অধ্যাদেশে অভিযুক্ত মোট ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১ জনের মধ্যে ২ হজার ৮ শত ৪৮ জনের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল ৭ শত ৫২ জন, বাকী ২ হাজার জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। এর মধ্যে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় মাত্র একজন রাজাকারকে।
৪. দালাল আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনালের বিচারও ছিল প্রহসন মাত্র। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের অপহরণকারী আল বদরটির বিরুদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্যে শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণের অভিযোগ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, কিন্তু তবু তাকে মাত্র ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। গণহত্যার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর ইত্যাদি দলে যোগদানকারী ব্যক্তিদের এইভাবে লঘু শাস্তি দিয়ে কিছু দিনের জন্য কারাগারে রেখে বিক্ষুব্ধ জনতা এবং তাদের হাতে নির্যাতিতদের রোষানল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
৫. দালাল রক্ষার এই ষড়যন্ত্র কুখ্যাত দালালদের তথাকথিত বিচার হওয়ার পূর্বে জনসাধারণের কাছে ধরা পড়ে নি। এরপর যখন দেখা গেল সরাসরি গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী দালালরা নামমাত্র শাস্তি পেয়ে নিষ্কৃতি পাচ্ছে তখন এ ব্যাপারে সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পায়।
৬. ২৩ জুলাই ১৯৭২ তারিখে দৈনিক বাংলায় এ বিষয়ে ‘দালাল আইন সংশোধনের প্রয়োজন’ শীর্ষক একটি রিপোর্টে লেখা হয়।বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয় এ বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য। ৪ আগস্ট ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভা সাব কমিটির এক বৈঠকে অপরাধীধের সর্বোচ্চ শাস্তি দানের বিধান রাখার জন্য দালাল আইন সংশোধনের বিষয় নিয়ে আরোচনা করা হয়। তবে বৈঠকে কোন সদ্ধান্ত নেয়া হয় নি।
৭. এইভাবে কালক্ষেপণের খেলা চলতে থাকে। ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলই তত্কালীন আইন মন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর গণহত্যাকারীদের সহায়তাকারীদের বিচারের জন্য রাষ্ট্রকে ক্ষমতা দেবার উদ্দেশ্যে আনীত সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, দালাল অধ্যাদেশের মাঝেই নানান ফাঁক-ফোকর রেখে দেয়া হয়েছিল, বোধগম্যভাবেই ইচ্ছাকৃতভাবে. শেষ পর্যন্ত সেই অধ্যাদেশের ক্ষমতা বড়ানোর বিল পাশ করা হয়নি, বরং আকস্মিকভাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করে রাঘব-বোয়ালদের অনতিবিলম্বে ছেড়ে দেয়া হল, চুনোপুটি দালালরাও ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসতে শুরু করল, বিচারগুলো আর এগুলো না, কেবল এক-আধটা মামলার খুবই বিচ্ছিন্নভাবে রায় বের হল. আর এসব করতে গিয়ে নিয়মনীতির কোন ধার ধারা হয়নি, কোন নতুন অধ্যাদেশ জারি হয়নি, কোন আইন পাশ হয়নি, সরকারি প্রেসনোটই হয়ে থাকল গেজেটের বিকল্প.
----------- ----------
৭১-এর নরঘাতকদের বিচার দাবি শুধু ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর নয়, সমস্ত বাংলাদেশীর. বরং ক্ষতিগ্রস্থরা যে ক্ষমা করে নাই, তাদের হয়ে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা ঘোষনা করে দেয়াটা (এবং পরবর্তীতে বিচারপতি সায়েমের রেটিফাই করা) যে তারা বা অসংখ্য বাংলাদেশী মানে নাই, এই বিযয়টাকে আলোতে এনে আমরা ঘাতক-দালালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে পারি ও ন্যায়বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারি - এই অঙ্গিকারে সততার সাথে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করাই হোক একমাত্র চেষ্টা.
এক দঙ্গল দলবাজ ট্রাইবুনালে ঘিরে বসে সারা দুনিয়ায় জাতির মাথা হেট করে দিয়ে আপামর মানুষের পরম আকাঙ্খার বিচারকে ক্রমাগত বিতর্কিত করে যে অনিশ্চয়তার মুখে এন ফেলে দিয়ে, তাতে তাদের কোন গ্লানি বোধ হয় না, সেটা স্পষ্ট. গোলাম আজমদের মত পালের গোদাদের দিকে না ফিরে ৭১-এ কোথাকার কোন নামগোত্রহীন সাঈদীকে এক সত্যের সাথে দশ মিথ্যা মিশিয়ে তামাশার বিচার বসিয়ে যে হাস্যরসের জন্ম দেয়া হল, তাতে জাশিরা যত্রতত্র রাতদিন বলে বেড়াবার সুযোগ পাচ্ছে যে, একাত্তরে তারা জনসেবা করে পার করেছে, গোলাম আজম, নিজামি, কামরুজ্জামান - এরা দুধে ধোয়া তুলসি! এইসব কুলাঙ্গারেরা গণমানুষের আশা-আকাঙ্খা নিয়ে অনেক মকারি করেছে, অনেক অপরাজনীতি করেছে, অনেক অর্থ-পদোন্নতির ছেলেখেলা করেছে, এবার তাদের থামিয়ে দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে, পদ্মাসেতুর মত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটাও টেঁসে না যায় – সেই সজাগ প্রহরা থাকতে হবে আমাদের সকলকে.
বিদ্র: আমি কোন ইতিহাসবিদ নই, আইনজ্ঞও নই, আমার জানার, বোঝার ভুল থাকতে পারে –তথ্যপ্রমাণ পেলে সংশোধন করতে প্রস্তুত, সেই সৎসাহস রাখি. দ্বিমত হলে আপনার যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে মন্তব্য করুন, গালাগাল নয়, প্লিজ.