২০০২ সালের দিকে খুলনার নিউ মার্কেটের পিছনে প্রায় বিকেলেই যাওয়া হতো। নূর, শান্ত, মুক্তা এবং আমি সাইকেল চালিয়ে ওখানে যেতাম। উদ্দেশ্য ছিলো আড্ডা আর বিশেষ মালাই চা খাওয়া।
আড্ডার মাঝে প্রায় লক্ষ করতাম একটি বিল্ডিং এর সামনে বিভিন্ন বয়সি তরুন ছেলেরা ভির করে দাড়িয়ে আছে। তাদের সবাই সুসজ্জিত। গলায় টাই বাধা হাতে একটি করে ডায়েরী। পরষ্পর নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন কথা বলছে।
একদিন আমাদের ব্যাচের এক ছেলের সাথে কথা হলো। আলাপ প্রসঙ্গে বললো লেখা পড়ার পাশাপাশি সে পার্ট টাইম কাজ করে। মাসে ভালো টাকা আয় করে। বেকার লাইফে অন্য কোনো ছেলের এ রকম কথা শুনলে স্বাভাবিক ভাবেই কৌতুহল জাগে। তাকে প্রশ্ন করলাম সে কি কাজ করে ? উত্তরে বললো মার্কেটিং এর কাজ করে। জানতে চাইলাম কি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করো। সে বললো তুমি যদি আগ্রহী থাকো তবে আমাদের অফিসে একদিন সময় করে আসো, সবকিছু বুঝিয়ে বলা হবে। যাহোক পরবর্তীতে জানলাম সে ডেসটিনি-২০০০ লিঃ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাদের ব্যবসা হচ্ছে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং সংক্ষেপে এমএলএম।
খুলনার মতো একটি বিভাগিয় শহরে যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম এমন একটি জায়গায় এই ব্যবসা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরেছিল। এমনকি আমাদের বন্ধু মহলে অনেকেই এমএলএম এর সাথে জড়িয়ে যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউেই সফল হতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে সরকার এর কঠর অবস্থান এবং এমএলএম কোম্পানীগুলোর প্রতারনার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ব্যবসা অনেকটা বিলুপ্তপ্রায় হয়।
কিন্তু এত বছর পর ইদানিং আবার সেই টাই পরা সুসজ্জিত বেকার ছেলেদের ডাইরি হাতে ঘুরে বেড়ানো দৃশ্য চোখে পরছে। প্রোডাক্ট বিক্রির আড়ালে তারা এমএলএম এর ব্যবসা করছে।
আমাদের এলাকায় একজন বয়স্ক লোকের সাথে সম্প্রতি পরিচয় ঘটে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি তিনি একটি ডিস্ট্রিবউটর কোম্পানীতে চাকরী করেন। একটি সুপরিচিত কোম্পানীর প্রোডাক্ট বিক্রি করেন। তিনি পাবনা, রাজশাহী অঞ্চলের দায়িত্বে আছেন। তার আন্ডারে বেশকিছু টিম আছে তারা এই ডিস্ট্রিবউশনের কাজ করে। প্রায়ই দেখি তার বাসায় গ্রাম থেকে নতুন নতুন ছেলে আসছে। কিছুদিন থাকে তারপর চলে যায়। আবার নতুন ছেলেদের আগমন ঘটে। ভদ্রলোক তার কাজ সম্পর্কে এর থেকে বেশিকিছু কখনো বলেন না।
কৌতুহল বশত তার টিমের এক ছেলেকে ডেকে তাদের কাজের ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। ছেলেটি গ্রাম থেকে এসেছে। এস.এস.সি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সংসারে অভাবের কারনে তাকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে উপার্জনের পথ বেছে নিতে হয়েছে। সে বললো তার চাকরী নেওয়ার জন্য কোম্পানীকে ৪৫০০০/- টাকা ভর্তি ফি হিসেবে দিতে হয়েছে। এর পর সে যতজন লোক ভর্তি করতে পারবে তাকে জনপ্রতি ৩০০০/- টাকা দেওয়া হবে। যখন তার আন্ডারে ১০জন লোক হবে তখন সে টিম লিডার হয়ে যাবে। সে সময় তাকে এককালীন ১০০০০/- টাকা দেওয়া হবে। এভাবে তার আন্ডারে যখন ৭ টি টিম তৈরি হবে তখন সে মাসে ৭০০০০/- টাকা পাবে।
প্রথমিক অবস্থায় একজন ছেলে যখন নতুন ভর্তি হয় তখন সে এক মাস ট্রেনিং এ থাকে। তার থাকা খাওয়ার ব্যয়ভার কোম্পানী বহন করে। সারাদিন তাদের কোনো কাজ নেই । শুধু অফিসে হাজিরা দেওয়া আর সিনিয়রদের কাছ থেকে নিয়মকানুন শেখা ছাড়া। একমাস পর লোক ঢুকাতে পারলে টাকা পাবে আর না হলে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হবে।
এই তরুন ছেলেগুলো অনেক টাকার মোহে বাস্তবিক চিন্তা ভাবনা না করে এমএলএম চক্রে প্রবেশ করছে। কম বয়সী বেকার ছেলেদের টার্গেট করে যে প্রতারনা কোম্পানীটি করছে তা এই ছেলেগুলো বুঝতে পারছে না। একমাস টাই পরে ফিটফাট হয়ে অফিসে যাচ্ছে। সবাইকে বলছে চাকরী করছে কিন্তু মাস শেষে যখন টার্গেট ফিলআপ করতে পারে না তখন শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয় বেকার অবস্থায়। মাঝখানে সংসারের ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বেকার ছেলেদের সাথে এই প্রতারনা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।
শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু
উত্তরা, ঢাকা
২৬/০৮/২০১৬
www.facebook.com/snalam.raju