somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবীণদের সম্মানে নবীনের ঈদ আয়োজনের গল্প

২৩ শে আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঈদের দিন সবাই যখন পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দে মত্ত তখন একাকী নির্জনে সবসময়ে ঈদ পালন করা এক ঝাঁক প্রবীনদের ঈদ এবার অন্যভাবে কেটেছে। ‘তাহাদের সাথে ঈদ’ শিরোনামে লোরক সোসাইটি এর পক্ষ থেকে ঈদের ২য় দিন সুবার্তা প্রবীণ সেবা কেন্দ্র, ব্যাংক টাউন, সাভারে ঈদ উদযাপন করা হয়। সেই ঈদ আয়োজনের গল্প আপনাদের আজ শোনাতে চাই।


আকাশে মেঘ ছিল। সকাল থেকে দোয়া পড়তে ছিলাম যেন বৃষ্টি না হয়। দোয়াতে কাজ হয়নি, প্রকৃতি অঝোরে কেঁদেই গেছে। তাই মনটা বিষন্ন ছিল। সেই বিষন্নতা আরো বহুগুণে বেড়ে গেল যখন শুনলাম আমাদের সাথে কয়েকজন বন্ধু যেতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত আমরা ১১ জন সদস্য ফার্মগেট থেকে সকাল ১০.০০টায় রওনা দেই। আমরা যাচ্ছিলাম সাভারে অবস্থিত বৃদ্ধাশ্রমে। সাভারের এক বন্ধু আরিফকে বলেছিলাম আমাদের সাথে থাকতে কারণ সেটা আমাদের কাছে ছিল অপরিচিত জায়গা। শেষ মুহুর্তে শুনলাম সেও থাকতে পারবে না। বাঁধা-বিপত্তি দিয়েই যাত্রা শুরু হচ্ছে। একটু বিষন্ন হলেও মনোবল ঠিক রেখে আমরা এগিয়ে চলছি। যখন আমরা পৌছলাম তখন আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সাভারের বন্ধু আরিফ ঈদ চমক হিসেবে সেখানে উপস্থিত। আমি একটু আশার আলো খুঁজে পেলাম কারণ সাংস্কৃতিক পর্ব তার উপস্থাপনার কথা ছিল। তো যাইহোক, সবার সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। সেখানে ২০ জন প্রবীণ লোক বসবাস করেন। সেই ২০ জনকে ঈদ কার্ড এর মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা জানালাম। উল্লেখ্য ঈদ কার্ডগুলো আমাদের নিজেদের হাতে বানানো ছিল। তারা ঈদ কার্ড পেয়ে অনেক আপ্লুত ছিলেন। একজনের উক্তি আজ চল্লিশ বছর পর এই প্রথম ঈদ কার্ড পেলেন।


অনেকে নতুন ঈদের কাপড় পড়ে আছেন কারণ আমরা আসবো বলে। এই প্রবীণ সেবা কেন্দ্রের পরিচালক সেলিনা আপার সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। তিনি মহাব্যস্ত রান্না-বান্নার কাজে। মোট চল্লিশজনের রান্না তিনি নিজ হাতে রেঁধেছেন। তার রান্নার হাত অসাধারণ। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার সেলিনা আপাকে ‘বাংলার মমতা’ বলে ডাকেন। কারণ তার চেহারার সাথে পশ্চিম বঙ্গের মমতা ব্যানার্জীর সাথে মিল আছে। এত আপন মমতায় যিনি এই প্রবীণ সেবা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন তিনি তো বাংলার মমতা হবেনই। দুপুর ১২.০০ টায় আমাদের শুরু হয় মেহেদী উৎসব। ইমা, বৃষ্টি, সানজীদা, সেঁজুতি ওরা মেহেদী লাগানোতে ব্যস্ত হয়ে গেল। তারা প্রত্যকে তাদেরকে নিজের দিদা বানিয়ে ফেললো। সব দিদারাও এত নাতি-নাতনি পেয়ে আনন্দিত। এক দিদার গল্প বলি। আমরা তার নাম দিয়েছি চিরসবুজ দিদা। কারণ তার সবুজ রঙ পছন্দ। সচরাচর আটপৌরে পোশাক পড়লেও আমরা আসবো বলে স্বামীর দেয়া সবুজ শাড়ি আজ অনেকদিন বাদে পড়েছেন। এই কথা শুনে চোখের জল আটকানো মুশকিল। আরেকজন আছে সাবানা দিদা। আমাদের বৃষ্টির সাথে তার বেশ ভালো ভাব হয়েছে। তার বয়ামে চকলেট, বিস্কুট থাকলেও কাউকে তিনি তা দেন না। তাই র্যাআফেল ড্র এর সময় যখন বলা হল সবচেয়ে কৃপন ব্যক্তিকে এই প্যাকেটটি দিন তখন সেই প্যাকেটটি সাবানা দিদার কাছে চলে গেল। মজার বিষয় হল সেই কৃপণ দিদা আমাদের বৃষ্টিকে তার বয়াম থেকে চকলেট-বিস্কুট খেতে দিয়েছেন এবং অনেক উপহার দিতে চেয়েছিলেন তাকে। সাবানা দিদার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি ভালো কবিতা লেখেন আর তিনি অনেক শিল্পমনা। মেয়েরা যখন তার হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছিল তখন সাবানা দিদা বলে দিচ্ছিলেন এভাবে মেহেদী পড়াও, এখানে একটা পাতা দাও ইত্যাদি।


আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম তাদের সাথে, তাদের অতীত ঈদ কিভাবে কেটেছিল তার গল্প শোনার চেষ্টা করেছি। শুনেছি তারা কিভাবে এখানে এল। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সেলিনা আপা রসুই ঘরে ব্যস্ত আমাদের রসনাভোজের জন্য। আমরা তাকে রান্নায় সাহায্য করতে চাইলাম। তিনি বললেন-কোন সাহায্য লাগবে না, তিনি নিজ হাতে সব কিছু করতে চান। খুব সংসারী মানুষ সেলিনা আপা। এত অল্প সময় এত কিছু রান্না খুব কঠিন। আপনাদের খাবারের মেনুগুলো বলি- মুরগির রোস্ট, চিকেন নাগেট, ডিম, সয়াভেজিটেবল, গরুর রেজালা, দই সালাত, ডিমের পুডিং, স্মোকি পায়েশ, টক দই এবং কোমল পানীয়। এত সব খাবার সব সেলিনা আপা নিজ হাতে রেঁধেছিলেন। প্রতিটি আইটেম ছিল অসাধারণ। তাদের সাথে এক টেবিলে বসে আমরা খেয়েছিলাম। আমরাই সব কিছু এগিয়ে দিচ্ছিলাম।

খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হলে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমেই ছিল অনুরোধের গান। আমরা প্রত্যকের কাছে একটি করে গানের অনুরোধ রেখেছিলাম। আমরাই তাদের গান গেয়ে শোনাবো। আমাদের সাথে ছিল ছায়ানটের শিল্পী ইমা। সে একটু ভয়ে ছিল কি গানের অনুরোধ তারা করে? পুরাতন যুগের অনেক সুন্দর সুন্দর গানের অনুরোধ তারা করলেন। সব গান সম্পূর্ন না গেতে পারলেও আংশিক গেয়েও শোনানো হয়। তারাও আমাদের সাথে গেয়ে উঠেন। একজন দিদা ছিলেন, আমরা নাম দিয়েছিলাম ধবল কেশী দিদা নামে। তিনি রেগে যাচ্ছিলেন আমরা পুরো গান শোনাতে পারছি না দেখে। পচা ডিম ছোঁড়ার ভয় দেখাচ্ছিলেন। ধবল কেশী দিদা এলজাইমা রোগে ভুগছেন। এই রোগে সবাই অল্পতে রেগে যায়। ওনার রাগ শান্ত করে আমাদের পরশ তার হাস্য কৌতুক দিয়ে। পরশের নোয়াখালী ভাষায় বিদ্রোহী কবিতা শুনে নবীন-প্রবীণ সহ সবাই প্রাণখুলে হেসে উঠে। অনেকদিন তারা এভাবে প্রাণ খুলে হাসেন না। চার দেয়ালের বন্দী জীবনে তাদের হাসির খুব অভাব। আমাদের কাছ থেকে হাসির খোরাক পেয়ে তাদের বিদায়ের বেলায় একটাই জিজ্ঞাসা ছিল- আমরা কবে আবার আসবো? কবে এভাবে আবার হেসে উঠবেন?

পরশের হাস্য পরিবেশনার পর র‍্যাফেল ড্র এর আয়োজন করা হয়। র‍্যাফেল ড্র এর বিজয়ী হন এক দাদু যিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে কথা বললেও আমরা যখন জাতীয় সঙ্গীত গাইলাম তখন তিনি সেই ভাঙ্গা কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত আমাদের সাথে গেয়ে উঠলেন। পুরান ঢাকার এক দাদু ছিলেন। তার পৃথিবী হচ্ছে শুধু তার সেই একটি ঘর। সেই ঘর থেকে আমরা তাকে একটি বারের জন্যও বের করতে পারিনি। সংসার জীবনের প্রতি বড়ই অভিমান তার। তাই এই স্বেচ্ছায় কারাবাস বরণ করে নিয়েছেন। প্রত্যেক দাদু-দিদার আছে নিজস্ব গল্প। সেই গল্প অনেক করুণ।

র‍্যাফেল ড্র এরপর শুরু হয় আলোচনা। অনুভুতি ভাগাভাগির পালা। সেলিনা আপা বললেন- প্রবীণদের দেখাশোনা করার কিছু নিয়ম আছে। আমরা তা জানি না দেখে তাদেরকে আমরা বোঝা মনে করি। তিনি বললেন-তারাও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠুক তা চান না। তবে যাদের কেউ নেই, তাদের দেখাশোনা করার জন্য প্রবীণ সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত। ছেলে-মেয়ে থাকা সত্বেও কেউ যেন তাদের পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠায়। এরপর আমাকে কিছু বলার জন্য বলা হয়। আমি বলেছি- সংস্কৃতির নিবাস হচ্ছে পরিবার। আমাদের লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের ধারক হচ্ছেন এই প্রবীনরা। তারা যে অভিজ্ঞতা বহন করছেন। সেই অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য আমরা মাসে একবার করে হলেও তাদের সাথে দেখা করার প্রস্তাব দেই। সেলিনা আপা সেই প্রস্তাবে রাজি হোন। আলোচনা পর্ব শেষে প্রত্যকের জন্য ছিল উপহারস্বরূপ স্মারক মগ। সেখান থেকে আমরা নতুন কিছু শিখে আসলাম। আরিফ তার অনুভুতি জানায় এভাবে- ‘এখানে সব সুযোগ সুবিধা থাকলেও সন্তানের ভালোবাসার বড় অভাব। তাদের সন্তানেরা যেন মাঝেমাঝে হলেও তাদের দেখে যায়।‘ বৃষ্টি তার অনুভুতি জানায় এভাবে-‘আমি কখনো আমার দিদাকে পাইনি। এখানে এসে আমি আমার দিদাকে খুজে পেয়েছি। সাবানা দিদার সাথে আমার একদিনের পরিচয়। তার সাথে যেভাবে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে সেটা সহজে ভাঙ্গার নয়’।

আমাদের আয়োজন দেখে আপনদের মাঝে যদি বিন্দুমাত্র ভাবনার উদ্রেক হয়- আসলে আমরা কোন পথে হাঁটছি ? তাহলেই আমাদের এই আয়োজন সার্থক হবে।


লেখকঃ
মোহাম্মদ আলামিন
সভাপতি
লোকসংস্কৃতি রক্ষা করি (লোরক) সোসাইটি
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×