somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিলুপ্ত হচ্ছে পরিবার প্রথা সংস্কৃতি

১৯ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জনাব জায়েদ আহমেদ (ছদ্মনাম) সিড়ি ঘরের কোণে ছোট্ট একটি কক্ষে বসবাস করতেন। অথচ একসময় তার বিত্ত বৈভব দেখে এলাকাবাসী অবাক হত। ঢাকা শহরে রয়েছে তার বিপুল ধন সম্পদ। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুরতা, সন্তানদের অবহেলা, অনাদর আর ভালোবাসার কাঙাল হয়ে তিনি আজ সুবার্তা ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত বৃদ্ধাশ্রমে এ আশ্রয় নিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান আর আত্মীয়স্বজনদের পদভারে মুখরিত ছিল তার চারপাশ। পাঞ্জাবীর পকেটে কিংবা লুঙ্গির কোচরে থাকত শতশত টাকার নোট। সন্তানরা প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পরে তাদের অনাগত ভবিষ্যতকে আরো সমৃদ্ধশালী করার মানসে তিনি সন্তানদের নামে সব কিছু লিখে দিলেন, আর এটাই হল তার সর্বনাশের কারণ। একদিন তিনি স্ট্রোক করে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হলেন, কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে তিনি দেখলেন সবকিছু বদলে গেছে। সন্তানরা আর আগের মত তার কাছে ভিড়ে না। সন্তানদের জামাই বা স্ত্রীরা তাকে অবজ্ঞা করে। কারণ, তিনি বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করেন, নিজের হাতে খেতে পারেন না, একা একা চলতে পারেন না। এভাবে চলতে চলতে তিনি কিছুদিন পর তিনি নিজেকে সিঁড়ির ঘরের ছোট্ট রুমটিতে আবিষ্কার করেন। সেই আস্তাকুঁড়ে থেকে তুলে এনে তাকে সন্তানের স্নেহ-ভালোবাসায় আর পরম মমতায় জড়ান ট্রাস্টটির পরিচালক শেলিনা আক্তার। নবম শ্রেণী পড়ুয়া ছোট্ট মুনির তাকে পরম যত্নে মুখে খাবার তুলে দেয়। তিনি এখন বাথরুমে যাওয়ার কথা বলতে পারেন। বৃদ্ধাশ্রমের সকলের সঙ্গে তার সখ্যতা চোখে পড়ার মত। তিনি জানালেন এখানেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে চান। ফিরে যেতে চান না ঐ আস্তাকুঁড়ে।

আরও একজন বৃদ্ধ জনাব মোখলেছুর রহমান (ছদ্মনাম) অনবরত দুই সন্তানকে বকা দিয়েই যাচ্ছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ঈদের দুইদিন পার হয়ে গেল অথচ তার দুই সন্তানের কেউই দেখা করতে আসেননি তার সঙ্গে। শুনলাম তার দুঃখের কথা। শুনতে শুনতে দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসল, উপস্থিত সবাইকে বিমর্ষতা গ্রাস করে নিল। সবাই বিষন্ন হয়ে বসে রইলাম। আর ভাবলাম এ কী বর্বরতা! এ কী নিষ্ঠুর মানবতা! পরিবার প্রথার এ কী পরিনতি! ঢাকা শহরে বিত্ত বৈভব থাকা সত্বেও তিনি আজ বৃদ্ধাশ্রমে।


ঢাকা শহরের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশে গঠিত লোকসংস্কৃতি রক্ষা করি (লোরক) সোসাইটি’র উদ্যোগে ১৫ জনের একটি টিম তৈরি করল। ঢাবির ছাত্র ও সংগঠনটির প্রাণ মোহাম্মদ আলামিন। বলা যেতে পারে ওর একক প্রচেষ্টায় আমরা ‘তাহাদের সাথে ঈদ’ শিরোনামে এবার এক ব্যতিক্রমধর্মী আনন্দ উৎসব করতে গেলাম সাভারে সুবার্তা ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত সুবার্তা প্রবীণ সেবা কেন্দ্রে। লোরক সোসাইটি ঈদের পূর্বেই নিজ হাতে ঈদ কার্ড তৈরি করে সকলের মাঝে বিতরণ করেছে। ঈদের পরেরদিন নিজ খরচে সকলের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের উদ্দেশ্য আমরা রওনা হলাম সুবার্তা প্রবীণ সেবা কেন্দ্রে। লোরকের উদ্দেশ্য হল প্রবীণদের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে সম্মান জানানো এবং পারিবারিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা কারণ, পরিবার হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির আবাস। শান্ত-সুনিবিড় পরিবেশে ট্রাস্টটির প্রাণ ‘বাংলার মমতা’ (অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কর্তৃক দেয়া উপাধি) শেলিনা ম্যাডাম ও তার স্বামী হাফিজ ভাইকে দেখেই মনটা আবেগে উদ্বেলিত হল। তারা দুইজন পরম মমতায় বৃদ্ধাশ্রমের সকলকে আগলে রেখেছেন। আমাদের দলের মেয়েরা বৃদ্ধাশ্রমের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাদের হাতে মেহদী পরাতে পরাতে গান গেয়ে চলল। বৃদ্ধাশ্রমের আশ্রিত বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের দেখে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে রইলাম, আর ভাবতে লাগলাম ছেলে-মেয়েরা কতটা মানবিক মূল্যবোধহীন হলে এদের মতো মায়েদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যেতে পারে! এদের সকলের চেহারায় দেখলাম আভিজাত্যের ছাপ।

শত কষ্ট বেদনায় দিনের পর দিন যাদের পেটে বুকে আগলে রেখেছিলেন সেইসব বিবেকহীন সন্তানরা তাদেরকে দূরে ঠেলে রেখেছেন। একবারও কী ভেবে দেখেছি যে আমাদের জীবনেও বার্ধক্য আসবে, আপনিও আপনার সন্তান দ্বারা নিগৃহীত হতে পারেন। আমাদের আনন্দ উল্লাস দেখে শ্রদ্ধেয় হাফিজ ভাই বললেন এরা এখানে উৎসব দেখলে আনন্দিত হন, সকলের সঙ্গে মজা করেন। অথচ, এদেরও ইচ্ছে করে নাতি-নাতনিদের জন্মদিনের উৎসব করতে, তাদের নিয়ে দূরে পার্কে কোথাও ঘুরে বেড়াতে, ছেলেমেয়েদের বিবাহ বার্ষিকী, বিভিন্ন উৎসব পার্বণ একসঙ্গে পালন করতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এবং চরম বাস্তবতা হচ্ছে তারা আজ বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত। তাই আমরা লোরক সোসাইটির সকল সদস্য পণ করলাম এখন থেকে সময় পেলেই তাদের সঙ্গে এসে গল্প করব, সময় কাটাব, তাদের দূরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাব। হাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে বসে শুনলাম মহৎ প্রতিষ্ঠানটির গড়ে উঠার কাহিনী। শ্রদ্ধায়-বিনয়ে নতজানু হয়ে রইলাম শেলিনা ম্যাডাম ও তার সকল সহকর্মীর কাছে। তিনি জানালেন এখানে বসবাসরত নারী-পুরুষদের জীবনে ঘটে যাওয়া হরেক রকম বেদনাতুর জীবন কাহিনী। শুনলাম মুমূর্ষ অবস্থায় অনেকের আগমণ ঘটেছিল এই বৃদ্ধাশ্রমে। কেউ কেউ কথা বলতে পারত না, কেউ নির্বাক হয়ে বসে থাকত, কেউ সারাদিন রুমে শুয়ে থাকত, কেউ বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করত, কেউ নিজ হাতে খেতে পারত না। এদের সকলেই এখন সুস্থ তাদের পরিচর্যায়। এদের জীবনে প্রাণ ফিরে এসেছে। এদের মধ্যে অনেকেই আমাদের সাথে এসে কথা বললেন। আমাদের দেখে আনন্দিত হলেন এবং বারংবার জিজ্ঞাসা করলেন-আমরা আবার কবে আসবো? তাদের দেখে মন হল আমাদের মাঝে তারা তাদের ছেলে মেয়েদের খুঁজে ফিরছেন। হয়তোবা তারা তাদের সন্তানের হাসি ভরা মুখ খুঁজে চলেছেন। হয়তোবা ভাবছেন, তাদের সন্তানেরা আজ কেমন আছে? হয়তোবা ইচ্ছে করছে সন্তানের কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিতে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি সব কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তারা খুঁজে পেয়েছেন সুবার্তা ট্রাস্টের শেলিনা ম্যাডামের মত একজন মেয়েকে। যিনি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ান, তার সহকর্মীরা ভোর পাঁচটায় উঠে তাদেরকে নিয়ে হাঁটতে বের হন। সন্তানের মমতায় বিছানা থেকে উঠিয়ে সকালের নাস্তা খাওয়ান, ওষুধ খাওয়ান, চুলে তেল দিয়ে দেন, তাদেরকে নিয়ে দৈনন্দিন কাজ কর্ম করেন। তবে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত অনেকেই সামাজিক মর্যাদা বা সন্তান ও আত্মীয় স্বজনদের সামাজিক সম্মান বিনষ্ট হয়ার ভয়ে সম্মুখে আসেন না। কিন্তু কথা হচ্ছে এভাবেই কী আমাদের হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলা পরিবার প্রথার সংস্কৃতি কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? স্বার্থের বেড়াজালে বিবেক বন্দী থাকবে? কতটুকু বিত্তশালী হলে আমরা শান্ত হব? পার্থিব বড়লোক হওয়ার চাইতে কি আত্মার বিস্তৃতি কী বড় হওয়া উচিত নয়? শেলিনা ম্যাডাম ও হাফিজ ভাইয়ের মত আলোকিত মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক, যারা শত প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতার মাঝেও ছুটে চলেছেন অবিরত।

লেখকঃ
মুমিত আল রশিদ
শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উপদেষ্টা, লোরক সোসাইটি

(লেখাটি পত্রিকার কলামে প্রকাশের জন্য রচিত হয়েছে। কোন পত্রিকার প্রকাশক বা সম্পাদক যদি লেখাটি প্রকাশ করতে চান তাহলে মন্তব্য করার অনুরোধ থাকলো)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×