somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহজিয়া দর্শন ৩: ওয়ান ডাইমেনশনাল পার্সোনালিটি

২৬ শে জুন, ২০০৭ সকাল ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনেক ভাল দিক আছে, সেগুলো নিয়ে গুনীজনদের লেখালেখির শেষ নেই। সেই আলোচনা আবার লেখায় টেনে আনাটা হতে পারে পুরোনো কাঁসুন্দি ঘাঁটার মতোই, আপাতত সেদিকে যাচ্ছিনা। বরং, মুদ্রার উল্টোপিঠটা একটু দেখি।
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার খারাপ দিকটা কি?
খারাপ দিকটা হলো ড্রেনে মধ্যে প্রবাহিত হওয়া, যারা ফ্যাক্টরীতে কনভেয়ার বেল্টে কাজ করেছেন তারা বুঝবেন, একটা ড্রেন বা বেল্টের মাধ্যমে প্রবাহিত হতে থাকে প্রোডাক্টগুলো, কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে সরষেফুল দেখার মতো হবে, একই রকম জিনিস বেরুচ্ছে হাজারে হাজারে, লাখে লাখ।
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাও অনেকটা সেরকম, একই রকম অসংখ্য মানুষ তৈরী হয়ে যায়, এরা একমাত্রায় ভাবে, একমাত্রায় চলে, একমাত্রায় জীবন যাপন করে। রাস্তার দিকে তাকালে এদের চোখে পড়ে শুধু বড়বড় গাড়ীঘোড়া, রাস্তার এক কোণায় ফুটে থাকা মিষ্টি হলুদ ফুলটার অস্তিত্বও টের পায়না।

তো আজ, চিন্তাধারার একমাত্রিকতার দূষণ নিয়ে কথা বলি। এটা সবচেয়ে ভয়াবহ, যখন মানুষের মাথার ভেতরের প্রসেসরটা ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাপিং শুরু করে। ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাপিং হলো এরকম, যে একটা ঘটনা দেখে আপনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন তার কারণ একটাই!
উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরুন, শেরাটন হোটেলের পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে দেখলেন স্যুটপরা এক ভদ্রলোক দেয়ালের দিকে মুখ করে হিসু করছে। একমাত্রিক চিন্তাধারায় সাথেসাথেই ধরে নেয়া হবে, 'লোকটার ভব্যতা জ্ঞান নেই'।
কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখুন, লোকটার এই 'ভব্যতাজ্ঞান'টা যদি পৃথিবীর সবচেয়ে টনটনে পর্যায়ের হয়, তারপরও কি এমন কারণ থাকতে পারে যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হিসু করবে?
অনেক কারণ পাবে, রাইট। যেমন, সবচেয়ে সহজ একটা কারণ হতে পারে সে ব্লডার ফাটার পর্যায়ে চলে গেছে, আর পারেনি। এমনও হতে পারে সে শেরাটনে গিয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে, সেখানে গিয়ে মেয়েটাকে লবীতে বসিয়ে রেখে টয়লেটে গেলে কেমন দেখাবে তা নিয়ে তার ভব্যতাজ্ঞান বেশী টনটন করায় সে এখানেই কাজ সেরে যাচ্ছে, কারণ হয়ত সে বুঝতে পেরেছে মেয়েটা অলরেডী চলে এসেছে। এরকম আরও বিশটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু ড্রেনে প্রবাহিত হবার কারণে অধিকাংশ মানুষই একমাত্রিকভাবে চিন্তা করবে, তা হলো 'লোকটার ভব্যতাজ্ঞান নেই'।

ব্যাপারটার আরও এক্সট্রিম লেভেলের উদাহরণ দেই, তাহলে আরও ভাল বোঝা যাবে।
একটু আগের হিসু করা লোকটা যদি একজন রিক্সাওয়ালা টাইপের লুঙ্গি-ছেঁড়া গেঞ্জিপরা লোক হতো?
তাহলে আপনি দেখে হয়তো সেটুকু ভাবার সময়ও নষ্ট করতেননা। কারণ, আপনি তো জানেনই এসব ফকিরের বাচ্চারা হরহামেশা এরকম কাজ করে বেড়ায়, চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়ায়। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, এরক কি ভাবার স্কোপ নাই যে ঐ ছেঁড়া লুঙ্গিওয়ালার ভব্যতাজ্ঞান খুবই টনটনে, সে কখনোই রাস্তার পাশে হিসু করেনা, কিন্তু আজ সে ব্লাডার ফাটার পর্যায়ে চলে গেছিল?
কিন্তু সেটা কয়জন ভাববে?
একজন রিক্সাওয়ালাকে রাস্তার পাশে মুততে দেখে কয়জন ভাববে, আহারে বেচারা মনে হয় হিসু চাপতে পারছিলনা।

এটাই একমাত্রিকতা, ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাপিং করে দুয়েদুয়ে চার মিলিয়ে ফেলে নিজেনিজে প্রশস্তি লাভ করা, আহা! আমার চেয়ে বোদ্ধা কে আছে?
এই একমাত্রিকতাটাকে কাটিয়ে ওঠাটাই হওয়া উচিত ছিল শিক্ষার আসল লক্ষ্য, তার বদলে একটা কন্ট্রাডিকশনের মাঝে পড়ে গেল প্রাতিষ্থানিক শিক্ষা।

আরেকটা কৌতুকসহ উদাহরন দিই।
জাপানে সামার আর স্প্রিং ভ্যাকে এদের প্রধান রেললাইন জে.আর. একটা সস্তা টিকেট ছাড়ে, ২০ ডলার সমমানের টাকায় একদিন পুরো ট্রেনে চড়া যায়, আপনি দেশের একমাথা থেকে আরেক মাথায় চলে যেতে পারবেন হয়ত। তো এসময়ে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকত, নামাজ পড়তে ইসলামিক সেন্টারে গেলে তবলীগের হুজুররা জোরাজুরি কর ধরে নিয়ে যেতে চাইত কয়েকদিনের ট্রিপে। তো একবার গেলাম।

ট্রেনে চেপে প্রায় বিশজন, এখানে ট্রেনের দৈর্ঘ্যের সাথে লম্বালম্বি সিট থাকে , একেকটা ব্লকে বিশজনের মতো বসতে পারে। এমন একটা ব্লকে সবাই মিলে বসে আছি, গল্প করছি।
তো আমরা যে তিন-চারজন ছাত্র ছিলাম, তাদের এসে ধরল এক হুজুর। তিনি নানারকম উদাহরণ দিয়ে এটা সেটা প্রচুর বয়ান করছেন, অধিকাংশই ইসলামের সাথে কোন সম্পর্কও নাই! আমরা মজা পাচ্ছি। হঠাৎ আমাদের এক বন্ধু ফাজলামি করে জিজ্ঞেস করল, হুজুর, আপনার ভিসা আছেনি?

হুজুর থমকে গেলেন, তারপর সুর করে আবার ওয়াজের ভঙ্গিতে মস্করা করে বললেন, আল্লার দুনিয়ায় মুমিন-মুসলমানের ভিসা লগেনাআআআআআআ।

সেই ট্রিপ থেকে ফিরে এসে এটা হয়ে গেল হট টক। সবাই এই সব ভিসাবিহীন লোকদের, তারওপর আবার হুজুর, এমন লোকদের আঠারো গুষ্ঠি উদ্ধার করলেন।
আমিও করলাম, ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাপিংয়ে একটুও সময় লাগেনি।

৯৮ এর বন্যার সময় একটা ফান্ড রেইজিং কাজ করেছিলাম, সেটা আমাকে লজ্জিত করেছিল। তখন আমি দেখেছিলাম কতবড় বেকুবের মতো ওয়ান-টু-ওয়ান ম্যাপিং করে এসেছি।

কারণ, তখন দেখলাম এইসব ভিসাবিহীন দেশের মান-ইজ্জতনষ্টকারী লোকগুলো দেশের জন্য পারলে নিজের গায়ের চামড়া খুলে দিয়ে দেয়!
একজন, ব্যাংকে গিয়ে দেখল পাঁচ হাজার ইয়েন ছাড়া আর কিছু নাই, সে তাই দিয়ে দিল, পরের সপ্তায় বেতন পেয়ে আবার দিতে আসল।

আর আমরা যারা নাক সিঁটকেছিলাম তাদের অনেকেই কেমন "বিজি" হয়ে গেলেন, একজন পোস্টডক ফেলো দিলেন ২০০ ইয়েন, হ্যাঁ ২০০ ইয়েন। ১১০ টাকা!! তাঁর স্কলারশীপ ছিল আড়াই লাখ ইয়েন প্রতিমাসে!!!!

যখন মসজিদের ফান্ড তোলা হলো, ঐ হতচ্ছাড়া দেশের মান-ইজ্জতনষ্টকারী ভিসাবিহীনেরা কি করেনি!!
সারাদিন কারখানায় হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে রাতে চলে যেত দূরে দূরে, ইসলামিক সেন্টারগুলোতে ফান্ড কালেকশনের জন্য।
আর এলিটরা? মাসে দুমাসের মিটিংয়ে লম্বা লম্বা কমেন্ট করে বুঝিয়ে দিতেন আমাদের কোন ভুলগুলো দেখলে তাদের হাসি পায়।

সেসময় আমি বুঝেছিলাম, জীবন একমাত্রার না।

তার দুবছর পর ফোর্থ ইয়ারে যখন ল্যাবে ঢুকলাম, আমার প্রফেসর যিনি কমপ্লেক্স সিস্টেম নিয়ে কাজ করেন, বললেন, মানুষ,মূষের জীবন যবই হলো ক্যাওস, মাত্রায় বাঁধা যায়না। আমি আবার দুবছর আগের সেই অনুভূতিটা পেলাম।

*******************************************
ইন্দোনেশিয়ার আচে ৎসুনামির পর বিশ্বের সব হোটেলে ইউনিসেফ একটা বাক্স রেখেছিল কাউন্টারে, যাতে পর্যটকরা দান করেন।
স্পেনের কোন এক হাজারতারা হোটেলে ডেভিড বেকহ্যাম ছিলেন একরাত, স্যুটভাড়া ৮০০০ পাউন্ড, আর তিনি ইউনিসেফের বক্সে দিলেন কত পাউন্ড বলেনতো?

পাঁচ পাঁচ টি পাউন্ড!!!

এদের শুধু চিন্তাধারা না, এদের কাজকর্মও একমাত্রিক।
এদের নিয়ে পারলে আরেকদিন লিখব।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০০৭ সকাল ৯:৩১
২৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×