somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ গল্পঃ দ্যা স্ট্রীট দ্যাট গট মিসলেইড

১৯ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মার্ক জিরনডিন সিটি হলের প্রকৌশলী বিভাগের নথি সংরক্ষণ সেকশনে এত দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে যে পুরো শহরটা একটা মানচিত্রের মত তাঁর মনের ভিতরে ছিলো অধিশায়িত। শহরের প্রতিটা জায়গা, আনাচ-কানাচ, রাস্তাঘাট, কানা গলি আর চিপা গলি সবই ছিলো তাঁর মুখস্থ।

পুরো মন্ট্রিয়ালে শহর সম্পর্কিত এত জ্ঞান তাঁর মত আর কেউ রাখতো না। ডজন খানেক পুলিশ আর ট্যাক্সি চালক মিলেও এই বিষয়ে প্রতিযোগিতায় তাঁকে হারাতে পারেনি। ব্যপারটা এমন না যে সত্যিই সে শহরের প্রতিটা জায়গা চিনে, যদিও সে মন্ত্র পাঠের মত তাঁদের নাম গড়গড় করে বলে যেতে থাকে যেন সে সবকটি রাস্তায় নিজে হেঁটে বেড়িয়েছে। আসলে শুধুমাত্র তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সে অবগত —কোথায় কোন জায়গায় কোন রাস্তা আছে, এক জায়গার সাথে আরেক জায়গার সম্পর্ক কি ইত্যাদি।

কিন্তু এইটুকু জ্ঞান এই বিষয়ে তাঁকে বিশেষজ্ঞ বানানোর জন্যে ছিলো যথেষ্ট। কেবিনেটের নথি সংরক্ষণের ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা ছিলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে, যেখানে অ্যাবোট থেকে যটিক পর্যন্ত সকল রাস্তার সমস্ত খুঁটিনাটি — রাস্তার সামনে, পিছনে, মাঝামাঝি— সকল তথ্য ছিলো নথিবদ্ধ । সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তিরা, প্রকৌশলী, ইন্সপেক্টর, তাঁদের মত আরও অনেকেই তাড়াহুড়োর মধ্যে বিশেষ তথ্য বা খুঁটিনাটি উপাত্তের জন্যে তাঁর কাছে ছুটে আসতো। তাঁরা হয়তো তাঁকে নিম্ন শ্রেণীর একজন কেরানী হিসেবে অবজ্ঞাই করতো কিন্তু উপায় নেই, অন্য সবার মত তাকেও তাঁদের সমভাবে দরকার।

কাজ-কর্মে উদ্দীপনার একটা বড় ধরনের ঘাটতি থাকলেও মার্ক তাঁর ওভেন স্ট্রীটের বাড়ি থেকে নিজের অফিসটাকেই বেশী পছন্দ করতো। ওভেন স্ট্রীটের ওখানে তাঁর প্রতিবেশীরা বড্ড হৈচৈ করে, মাঝে মাঝে মারামারিও করে আর বাড়িওয়ালীও তো নিরন্তর কোলাহলে মেতেই থাকে। একবার সে সাথের ভাড়াটিয়া লুইসকে তাঁর নিজের অস্তিত্বের অর্থটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। লুইস যখন প্রাচিরের উপর উঠে বসলো, তখন তাঁর চেহারায় একটা তীক্ষ্ণ বিদ্রূপাত্মক ভাব ফুটে উঠলো।

“সুতরাং ক্রেইগ গিয়ে ব্লেউরির খিড়কি খুলে ঢুকে এবং ব্লেউরি হয় পার্ক, তো এই নিয়ে মাথা ঘামায় কে? এত উত্তেজনার কি আছে?”

“সেটা আমি তোমাকে দেখাবো” বললো মার্ক, “তাঁর আগে আমায় বলো তুমি কোথায় বাস কর।”

“পাগল নাকি? কোথায় আবার? ওভেন স্ট্রীট। আর কোথায় হবে?”

“তুমি কি করে জানলে?”

“আমি কি করে জানলাম মানে? আমি এখানেই থাকি, থাকি না? আমি ভাড়া দেই, এখানেই আমার চিঠিপত্র আসে, আসে না?”

মার্ক আলতো ভাবে মাথা নাড়লো।

“যা যা বললে, এর কোনটাই প্রমাণ করে না যে তুমি এখানকার বাসিন্দা,” সে বললো। “তুমি যে এই ওভেন স্ট্রিটে থাকো এর একমাত্র প্রমাণ হলো সিটি হলের নথির কেবিনেটে এই কথাটা উল্লেখ আছে। পোস্ট অফিস তোমার কাছে চিঠি পাঠায় এর কারণ হলো আমার কার্ড ইনডেক্সে তোমার ঠিকানা লেখা আছে। যদি আমার নথিতে এসব লেখা না থাকতো, তাহলে তোমার হয়তো কোন অস্তিত্বই থাকতো না, এমনকি এই ওভেন সড়কেরও কোন অস্তিত্ব থাকতো না। বুঝেছ বন্ধু, এটাই হলো আমলা প্রশাসনের বিজয়।”

“এইসব কথা বাড়িওয়ালীকে গিয়ে বলার চেষ্টা করো,” বিরক্তিতে বিড়বিড় করতে করতে লুইস হেঁটে চলে গেলো।

অতএব মার্ক তাঁর অখ্যাত কর্মজীবনে দিনাতিপাত করতে থাকলো। এর মধ্যে তাঁর চল্লিশতম জন্মদিন আসলো এবং চলেও গেল, কেউ লক্ষ্যই করলো না। দিনের পর দিন পার হতে থাকলো নিরস আর ঘটনা বিহীন। ওদিকে কোথাও কোন রাস্তার নাম পাল্টানো হয়েছে, নতুন আরেকটা নির্মিত হয়েছে, তৃতীয় কোনটা প্রশস্থ করা হয়েছে, এইসব তথ্য সতর্কতার সাথেই নথিবদ্ধ হচ্ছিলো।

তারপর এমন কিছু একটা ঘটলো যা তাঁকে হতবিহব্বল করে দিলো, সে মাত্রাহীন বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে গেলো, কেঁপে উঠলো পুরো কেবিনেটের লৌহ ভিত্তি।

অগাস্টের এক বিকেলে, ড্রয়ার খুলতে গিয়ে সে হাতে কিছু একটা অনুভব করলো। আরেকটু হাতিয়ে দেখতে পেলো ড্রয়ারের উপর-নিচে একটা কার্ড আটকে আছে। টেনে বের করে দেখলো জীর্ণ, মলিন একটা ইনডেক্স কার্ড। পুরনো হলেও কার্ডটা এখনো অর্থোদ্ধারযোগ্য। কার্ডের গায়ে লেখা ছিলো, “রুয়ে দে লা বউতলে ভারতে” অথবা “গ্রিন বোটল স্ট্রীট”।

মার্ক বিস্ময়ে পলকহীন চোখে চেয়ে রইলো কার্ডটার দিকে। এরকম কোন বেখাপ্পা জায়গার নাম সে জীবনেও কোনদিন শোনেনি। নিঃসন্দেহে আধুনিক ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে এই জায়গার পুনরায় নামকরণ করা হয়েছে। সে রাস্তার নামের পুরো লিস্ট আর সব মাস্টার ফাইল এলোমেলো করে ঘেঁটে দেখতে লাগলো। কিন্তু এই জায়গার নাম কোথাও দেখতে পেলো না। সে আবারো সবকটি কেবিনেটে খুব সতর্কতার সাথে, আস্তে আস্তে খোঁজে দেখতে লাগলো। সেখানে এই নামের কিছু ছিলো না। একেবারেই কিচ্ছু না।

আরও একবার সে কার্ডটা পরখ করে দেখলো। কোন ভুল নেই সেখানে। সড়কটা সর্বশেষ নিয়ম মাফিক পরিদর্শিত হয়েছিলো ঠিক পনেরো বছর পাঁচ মাস চৌদ্দ দিন আগে।

যখন ভয়ঙ্কর সত্যটা এসে ভর করলো তাঁর উপর, আতঙ্কে হাত থেকে সে কার্ডটা ছুড়ে ফেলে দিলো। ভঁয়ে ভঁয়ে কার্ডটাকে আবার ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিয়ে চকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। এটা ছিলো একটা হারিয়ে যাওয়া, বিস্মৃত সড়ক। সিটি হল থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে মন্ট্রিয়ালের কেন্দ্রে গত পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সড়কটা এখানেই ছিলো সেটা কেউই জানতো না। জলে পতিত একটা পাথরের টুকরোর মতই সড়কটা সবার দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিলো।

হৃদয়ের গভীরে, মার্ক মাঝে মাঝেই এমন একটা সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতো। শহরে অনেক অজ্ঞাত জায়গা ছিলো— আঁকাবাঁকা গলি আর মিশরীয় গোলকধাঁধার মত এলোমেলো পেঁচানো সব রাস্তাঘাট। কিন্তু এমন কোন জায়গা থাকার কথা না যার নাম তাঁর হাতের সর্বজ্ঞ নথিতে উল্ল্যেখ নেই। অথচ এই একটা সড়কের নাম সত্যিই এখানে নেই। ঘটনাটা যেন একটা বিস্ফোরক।

হতবুদ্ধিকর অবস্থায় মার্কের অস্পষ্টভাবে মনে পড়লো, এখানে কাজ শুরু করার কিছুদিন পরেই কিভাবে তাঁর কেবিনেট অন্য তলায় স্থানান্তরিত হয়েছিলো। পুরনো সব নথিগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নথি বানানো হয়েছিলো। অবশ্যই ঠিক সেই সময়ে “গ্রিন বোটল স্ট্রীট”টা ড্রয়ারের চিপায় আটকা পড়েছিলো।

কার্ডটা পকেটে নিয়ে সে বাড়ি চলে গেলো। সেই রাতে তাঁর ভালো ঘুম হলো না। ভয়ঙ্কর সব দৈত্যাকৃতি তাঁর স্বপ্নে এসে হানা দিলো। সে স্বপ্নে দেখলো তাঁর অফিস প্রধানের বিশাল একটা ছায়ামূর্তি প্রচণ্ড রাগের মাথায় তাঁকে একটা তপ্ত লাল বর্ণের নথির আলমারিতে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।

পরের দিন সে মনস্থির করে ফেললো। অসুস্থতার অজুহাতে বিকেলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুরু দুরু বুকে সে জায়গাটা খুঁজতে বেরিয়ে গেলো।

যদিও সে জায়গাটার অবস্থান সম্পর্কে খুব ভালো ভাবেই অবগত ছিলো, তবুও সে দুই বার জায়গাটা পার হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। বিমূঢ় হয়ে সে চোখ বন্ধ করলো। তাঁর মনে অধিশায়িত অব্যর্থ মানচিত্রটা অনুসরণ করে সে সরাসরি চলে গেলো প্রবেশদ্বারে। প্রবেশদ্বারটা এতই সরু ছিলো যে মার্ক তাঁর প্রসারিত হাত দিয়ে সংযুক্ত দেয়াল গুলোকে ছুতে পারছিলো। ফুটপাত থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো একটা লম্বা, শক্ত কাঠের কাঠামো যার বেশীর ভাগ অংশই ছিলো জর্জরিত। কাঠামোটার মাঝখানে ছিলো একটা সাদামাটা খিড়কি ওয়ালা দরজা। দরজাটা ঠেলে সে ভিতরে ঢুকলো। তাঁর সামনে এখন শুয়ে আছে সেই ‘গ্রিন বোটল স্ট্রীট’।

জায়গাটা ছিলো একেবারেই জলজ্যান্ত। শান বাঁধানো ফুটপাতের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো তিনটে ছোট বাড়ি, সব মিলিয়ে বাড়ি ছিলো মোট ছয়টা। প্রতিটা বাড়ির সামনেই ছিলো একটা করে লোহার বেড়ায় ঘেরা ক্ষুদ্র বাগান। বাড়িগুলোকে মাত্রারিক্ত পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিলো আর তাঁদের গায়ে লেগে ছিলো যত্নের ছাপ। ফুটপাতের পাথর গুলো দেখে মনে হচ্ছিলো সম্প্রতিই কেউ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে। গুদাম ঘরের পুরনো জানালাহীন ইটের দেয়াল গুলো বাড়ি ছয়টাকে ঘিরে রেখেছিলো আর দেয়াল গুলো মিলিত হয়েছিলো রাস্তার ঠিক শেষ মাথাটায় গিয়ে।

প্রথম ঝলকেই মার্ক বুঝতে পারলো কিভাবে জায়গাটার এমন অস্বাভাবিক নামকরণ হয়েছে। গলিটা দেখতে ঠিক বোতলাকৃতিরই ছিলো।
পাথর আর বাগানে প্রতিফলিত সূর্য কিরণ, মাথার উপরের নীল আকাশ এইসব কিছু নিয়ে গলিটা তাঁকে একটা ক্ষণস্থায়ী ভালো লাগা আর প্রশান্তিতে ডুবিয়ে রাখলো। পঞ্চাশ বছর আগের খোদাইকৃত এই দৃশ্যটা ছিলো পুরোপুরি মোহনীয়।

মার্কের হাতের ডান দিকের প্রথম বাড়িটার বাগানের গোলাপ গাছে একটা বয়স্ক মহিলা জলসেচন করছিলো। মহিলাটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে বলে মার্ক অনুমান করলো। মার্ককে দেখে মহিলাটা তাঁর দিকে নিস্পন্দ পলকহীন চোখে চেয়ে রইলো, আর তাঁর হাতের কৌটা থেকে মাটিতে এলোমেলো ভাবে পানি পড়তে লাগলো। মার্ক তাঁর মাথার হ্যাট খুলে বললো, “আমি শহরের প্রকৌশলী বিভাগ থেকে এসেছি, ম্যাডাম।”

মহিলা নিজেকে সামলে নিয়ে তাঁর জলের কৌটা ঠিক করে নিচের দিকে তাক করলো।

“সুতরাং অবশেষে তুমি তাহলে এই জায়গার খোঁজ পেয়েছ।” সে বললো।

মহিলার এই কথা গুলো শুনে মার্কের মনে পুনর্জন্ম নেয়া তাঁর নির্দোষ, হাস্যকর ভুলের ধারণাটা দ্রুত বেগে পালিয়ে গেলো। সে কোন ভুল করেনি।

“দয়া করে আমায় সব খুলে বলুন,” মার্ক নিরাসক্ত গলায় বললো।

গল্পটা ছিলো বিস্ময়কর। অনেক বছর ধরে, মহিলা বললো, গ্রিন বোটল স্ট্রীটের ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার সাথে মিলেমিশে বসবাস করতো। বাড়িওয়ালা এখানকারই কোন এক ছোট বাড়িতে থাকতো। ভাড়াটিয়াদের সাথে বাড়িওয়ালার সম্পর্কটা এতটাই গভীর হয়েছিলো যে মৃত্যুকালে সে তাঁদেরকে একটা ছোট অংকের টাকা সহ তাঁর সম্পদ লিখে দিয়ে গিয়েছিলো।

“আমরা আমাদের কর পরিশোধ করতাম,” মহিলাটা বললো, “আর ফরমের একটা পুঞ্জিকা বানিয়েছিলাম এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর আমাদের সম্পদ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতাম। অতঃপর, কিছুদিন পর থেকে আমাদের কাছে ট্যাক্সের নোটিশ আসা বন্ধ হয়ে গেলো, আমরাও আর কোন কর পরিশোধ করলাম না। কেউ আর আমাদেরকে ঘাটালো না। অনেক দিন পর আমরা বুঝতে পারলাম যে কোন না কোনভাবে ট্যাক্সের লোকজন আমাদের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে।”

মার্ক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অবশ্য, গ্রিন বোটল স্ট্রীট যদি সিটি হলের দৃষ্টি সীমার বাইরে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কোন পরিদর্শক, আদমশুমারি পরিচালক, কর সংগ্রাহক সেখানে যাওয়ার কথা না। কেবিনেটের অব্যর্থ নথি সবাইকে সানন্দে বরং অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাবে।

“তারপর মাইকেল ফ্ল্যানাগান, যে কিনা চার নম্বর বাড়িটায় বাস করত,” মহিলা বলে যেতে থাকলো, “লোকটা বড়ই মজার মানুষ, তাঁর সাথে তোমার দেখা করা উচিত — মি. ফ্ল্যানাগান আমাদেরকে ডেকে বললো, ব্যাপারটা যদি কোন অলৌকিক ঘটনা হয়েই থাকে তাহলে আমাদের উচিত এটাকে সাহায্য করা, উৎসাহ দেয়া। ইনিই সেই লোক যে দরজাটা বানিয়ে প্রবেশ পথে বসিয়েছিলো, যেন কোন পথচারী অথবা অফিসিয়াল যখন তখন ভেতরে ঢুকতে না পারে। আমরা সবসময় দরজাটা তালা মেরে রাখতাম, কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেল কেউ আর এদিকে আসে না। তাই আমরা আর এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না, এখন দরজাটা খোলাই থাকে।”

“ওহ, আরও অনেক ছোট ছোট জিনিস ছিলো যা আমাদেরকে করতে হতো, যেমন পোস্ট অফিস থেকে আমাদের চিঠি পত্র নিয়ে আসা। কারণ আমাদের দরজায় কখনই কেউ কিছু দিয়ে যেত না। এখন শুধুমাত্র খাবার আর কাপড় কেনা ছাড়া বাইরের জগতে যাওয়া আর কোন কারণ আমাদের নেই।”

“আর এতদিনে এখানে আর কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটেনি?” মার্ক জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ, এর মধ্যে আমাদের দু’জন স্বজন মারা গেছে এবং তাঁদের ঘর গুলো কিছুদিনের জন্যে খালি পড়ে ছিলো। তারপর ছয় নম্বর বাড়িতে বাস করা জিন ডেসেলিন মাঝে মাঝে শহরে যায়। একদিন সে মি. প্লন্সকাই নামের একজন শরণার্থী সাথে নিয়ে ফিরলো। ভ্রমণ করে মি. প্লন্সকাই ছিলো বড্ড ক্লান্ত আর জরাগ্রস্ত, সে সানন্দেই আমাদের সাথে থেকে গেলো। তিন নম্বর বাড়িতে বাস করা মিস হান্টার একদিন এক দূরবর্তী আত্মীয়কে নিয়ে আসলো। মানুষটা বড় ভালো লোক বলেই আমার মনে হয়। তাঁরা দুজনেই আমাদের সার্বিক অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারে।”

“এবং আপনি, ম্যাডাম?” মার্ক জানতে চাইলো।

“আমার নাম সারা ত্রুসডেল। আমি এখানে বিশ বছর ধরে বাস করে আসছি। জীবনের শেষ দিন গুলি আমি এখানেই কাটাতে চাই।”
মহিলা মার্কের দিকে তাকিয়ে একটা সন্তোষজনক মুচকি হাসি দিলো। আপাতভাবে সে মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল যে মার্কের পকেটে এমন একটা গ্রেনেড রয়েছে যা তাঁদের এই সুন্দর ছোট্ট প্রশান্তির জগতটাকে উড়িয়ে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে।

এই যে গ্রিন বোটল স্ট্রীট, এই আশ্রয় খানায় নিজেদের খুঁজে পাওয়ার আগে এদের সবার জীবনই জর্জরিত ছিলো সমস্যায়, জটিলতায় আর ব্যর্থতায়। নিজের শোচনীয় অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে মার্কের মনেও এখানে এসে বাস করার ইচ্ছাটা জেগে উঠলো। সে আনমনেই পকেটে আঙুল ঢুকিয়ে কার্ডটা নাড়াচাড়া করতে থাকলো। “মি. প্লন্সকাই আর মি. ফ্ল্যানাগান দুজনের ভিতরে খুব ভাব জমেছে।” মিস ত্রুসডেল বললো, “তাঁরা দুজনই ছিলো ভ্রমণকারী, তাই ভ্রমণ কালীন স্মৃতি নিয়ে কথা বলতেই তাঁরা ভালোবাসে। মিস হান্টার পিয়ানো বাজাতে পারে আর মাঝে মাঝেই আমদেরকে নিয়ে কনসার্ট করে। তারপর আছে মি. হ্যাযার্ড আর মি. ডেসেলিন, দাবা খেলা তাঁদের খুব প্রিয়। তাঁরা আমাদের জন্য চোলাই মদ বানায়। আর আমার কথা বলতে গেলে বলা যায়, আমি আছি আমার ফুল গাছ আর বই নিয়ে। মোট কথা এখানে আমারা সবাই মিলে বেশ ভালোই আছি।”

মার্ক আর মিস ত্রুসডেল দীর্ঘক্ষণ নীরবে বসে রইলো। আকাশের নীল রঙটা ধীরে কালো হয়ে আসলো, গোলাঘরের বাঁ দিকের দেয়ালের পেছনে সূর্যটা হারিয়ে গেলো।

“তোমাকে দেখে আমার ভাতিজার কথা মনে পড়ছে,” মিস ত্রুসডেল হঠাৎ কথা বলে উঠলো, “ছেলেটা বড় ভালো ছিলো। যুদ্ধের পরে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে ছেলেটা যখন মারা গেল, তখন আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিলো। তুমি জানো, আমিই আমার বংশের শেষ ব্যক্তি।”

মার্ক মনে করতে পারলো না শেষ কবে সে এমন সুন্দর বন্ধু সুলভ কথা বার্তা কারো সাথে বলেছে। এই বৃদ্ধ মহিলাটার জন্যে তাঁর হৃদপিণ্ডটা উষ্ণ হয়ে উঠলো। একটা মহৎ নৈতিকতা আবিষ্কারের অস্পষ্ট একটা অনুভূতি তাঁর উপর এসে ভর করলো। পকেট থেকে সে কার্ডটা বের করলো।

“নথির আলমারিতে গতকালকে আমি এই কার্ডটা পেয়েছি,” মার্ক বললো। “এই সম্পর্কে এখনো কেউ কিছু জানে না। জানাজানি হলে বড় ধরনের একটা কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে আর পাশাপাশি আপনাদের সমস্যারও আর শেষ থাকবে না। পত্রিকার রিপোর্টার, কর সংগ্রাহক.........”

মার্কের বাড়িওয়ালীর কথা আবার মনে পড়লো, মনে পড়লো তাঁর ঝগড়াটে প্রতিবেশীদের কথা, তাঁর ঘরটার কথা। সে আস্তে করে বললো, “আমি ভাবছি, আমি একজন ভালো ভাড়াটিয়া এবং আমি ভাবছি......”

“ওহ, হ্যাঁ,” মহিলাটা সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে বললো, “আমার বাড়ির উপরের তলায় তুমি থাকতে পারবে। আমার এখানে এত জায়গা পড়ে আছে তা দিয়ে আমি কি করবো আমি নিজেই জানিনা। আমি নিশ্চিত জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে। তুমি এখনি এসে দেখে যাও।”

নথির কেরানী মার্ক জিরনডিন মনস্থির করে ফেললো সে এখানেই থেকে যাবে। পরিত্যাগের ভঙ্গিতে কার্ডটাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে জলের কৌটার মধ্যে ফেলে দিলো। তারপর যতটুকু তাঁর মনে হলো, এই ‘গ্রিন বোটল স্ট্রীট’ এর কথা আর কেউ কক্ষনো জানবে না, জায়গাটা বিস্মৃতই থেকে যাবে, অনন্তকাল।

মূলঃ প্যাট্রিক ওয়াডিংটন
ভাষান্তরঃ শরিফুল ইসলাম (শরীফ আজাদ)
ঢাকা, মে ১৯, ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৬ সকাল ১০:২৮
৭টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×