বিদেশী বিনিয়োগের ফলে নাকি ভালো ভালো কর্মসংস্থান তৈরী হয় আর সরকার নাকি প্রচুর ট্যাক্স পায় এইসব কোম্পানির কাছ থেকে। আসেন দেখি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদেশী বিনিয়োগকারী কর্পোরেট মোবাইল কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে কি করছে।
কর্মসংস্থান: আউটসোর্সিং/সাবকন্ট্রাক্টিং এর খেলা
সন্দেহ নেই মোবাইল কোম্পানিগুলো অল্প কিছু ভালো কর্মসংস্থান তৈরী করেছে যেখানে প্রকৌশলী, বিবিএ-এমবিএ ধারীদের জন্য কয়েকশ থেকে হাজার খানেক ভালো কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে যারা ২৫/৩০ হাজার থেকে শুরু করে লাখের উপর বেতন, বোনাস, ওভারটাইম ইত্যাদি পায়। এর মধ্যেও বৈষম্য আছে, নিপীড়ন আছে, শ্রম শোষণ আছে- যেমন: তীব্র কাজের চাপ, ছুটি-ছাটা না পাওয়া, বাধ্যতামূলক ওভার টাইম, ওভার টাইম করিয়ে ওভার টাইম না দেয়া, চাকুরির নিরপত্তা না থাকা, মুখের কথায় চাকুরি চলে যাওয়া, যারা মূল ফিল্ড ওয়ার্ক করে তাদের বেতন, সুযোগ সুবিধা সবচেয়ে কম আর যারা ডেস্কজব করে বা যারা ম্যানেজারিয়াল শ্রেণী সেই অল্পকিছু মানুষদের বেতন-সুবিধাদি বেশি থাকা, দেশীয় কর্মীদের তুলনায় বিদেশীদের বেতন/মর্যাদা বেশি থাকা, সংগঠিত হওয়ার অধিকার না থাকা ইত্যাদি। কিন্তু কোম্পানির নিজস্ব কর্মীদের মধ্যকার এই বৈষম্য কিছুই মনে হবে না যদি আমরা আউটসোসিং/সাবকন্ট্রাক্ট এর মাধ্যমে মোবাইল কোম্পানিগুলো যে কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে তার অবস্থা সম্পর্কে খোজ নেই।
মোবাইল কোম্পানি গুলো বেশিরভাগ কাজই করিয়ে নেয় আউট সোর্সিং বা সাবকন্ট্রাক্টিং এর মাধ্যমে যেমন: টাওয়ার তৈরী থেকে স্থাপন, বিভিন্ন ধরণের মেনটেনেন্স, সিকিউরিটি, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, মার্কেটিং, ডিস্ট্রিবিউশান, সিম বিক্রি, ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি। উদাহরণ স্বরপ, গ্রুপ ফোর বা সেন্ট্রি সিকিউরিটিকে বিভিন্ন টাওয়ার এবং অফিস এর নিরাপত্তার কন্ট্রাক্ট দেয়া হয় নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে। এখন গ্রুপ ফোর বা সেন্ট্রি সিকিউরিটির দ্বায়িত্ব সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দেয়া এবং সেই সিকিউরিটি গার্ডদের বেতন কত, ওভারটাইম, বোনাস ইত্যাদি কোন কিছুরই দায় আর কর্পোরেট কোম্পানির থাকলো না। ওদিকে বেচারা সিকিউরিটি গার্ড দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা ডিউটি করে ৩/৪ হাজার টাকা বেতন পায়। অথচ কোম্পানির নিজস্ব স্টাফ হিসেবে রাখতে গেলে কপোরেট কোম্পানিকে হয়তো ন্যূনতম ১০/১২ হাজার টাকা খরচ করতে হতো বেতন-বোনাস-ওভারটাইম মিলিয়ে। একই ভাবে মোবাইল কোম্পানিগুলো সরাসরি কোন ড্রাইভার নিয়োগ না দিয়ে, কোন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর বেতন-বোনাস-ওভারটাইমের দ্বায়িত্ব না নিয়ে সুন্দর চকচকে অফিস, চকচকে দেশ প্রেম, সংস্কৃতি প্রেম আর তারুণ্য ব্যাবাসা ফেদেছে যার আড়ালে বছর বছর চলছে শ্রম শোষণ, ট্যাক্স ভ্যাট ফাকি, মুনাফা পাচার।
কপোরেট কর: কর্পোরেট ফাকি
সুযোগ পেলেই মোবাইল কোম্পানি ওয়ালারা আমাদের শুনিয়ে দেয়- হাজার হাজার কোটি টাকার কর দেয়ার কথা- ভাবটা এমন যেন তারা সেই কর দয়া করে দিচ্ছে, যেন এর আড়ালে বাংলাদেশের শ্রমজীবি সস্তা অবদান নাই। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের এই ধামকির আড়ালে লুকানো থাকে যত টাকার কর দিয়েছে তারচেয়ে বেশী টাকার কর ফাকি দেয়ার কাহিনী যার কিছু উদাহরণ এখানে আমি দিচ্ছি:
১) কর ফাকি দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো মুনাফা কমিয়ে দেখানো। মুনাফা কম দেখানোর জন্য প্রয়ো্জন খরচ বাড়িয়ে দেখানো। খরচ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য এরা ইকুইপমেন্ট ভেন্ডরের সাথে চুক্তি করে এদের কাছ কেনা যন্ত্রপাতি ও সার্ভিসের দাম বাড়িয়ে দেখায়, বিভিন্ন ধরণের অপারেশান ও মেন্টেনেন্স কস্ট বাড়িয়ে দেখায়, মূল কোম্পানিরই মালিকানাধিন নামের সাবকন্ট্রাক্টর কোম্পানি খুলে সেই সাবকন্ট্রাক্টর কোম্পানিকে বেশি দরে কন্ট্রাক্ট দেয়।
২) কাস্টমসে শুল্ক ফাকি দেয়। এক ক্যাটাগরির পণ্য আমদানি করে এমন অন্য ক্যাটাগরির বলে চালিয়ে দেয় যেন শুল্ক কম দিতে হয়।
৩) সিম ট্যাক্স ফাকি দেয়ার জন্য নতুন বিক্রি করা সিমকে পুরাতন, চুরি যাওয়া সিম নবায়ণ হিসেবে চালিয়ে দেয়।
৪) কাস্টমের সংখ্যা, কল/এসএমএস এর পরিমাণ কমিয়ে দেখানো ইত্যাদি।
এরকম বেশকিছু ঘটনা বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় এসেছে যেমন:
গ্রামীণ ফোনের ৭০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাকি
Click This Link
শুল্ক ফাকির দায়ে রবির ৬০ লাখ টাকা জরিমানা
Click This Link
মিথ্যাঘোষণায় পণ্য আমদানী, শুল্ক ফাকির শীর্ষে এয়ারটেল
Click This Link
আজ টাকা জমা না দিলে কাল ব্যাংক হিসাব জব্দ : গ্রামীণফোনকে এনবিআরের ফরমান
Click This Link
জিপিকে ৩০৩৪ কোটি টাকা দিতে বললো বিটিআরসি
Click This Link
৫৩ লাখ গ্রাহকের তথ্য গোপন করেছে রবি!
Click This Link
বাংলালিংক-এনবিআর শীতল লড়াই
Click This Link
এনবিআরের পাওনা পরিশোধ - ২৩৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা দিল গ্রামীণফোন
Click This Link
এনবিআরের দাবি : ১৫৮০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে গ্রামীণফোন
Click This Link
এয়ারটেলের ৯৩ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি
Click This Link
মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ভুলে থাকা মিডিয়ায় বাস্তব পরিস্থিতি’র খুব সামান্যই এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, লোক সংস্কৃতি, দেশ প্রেম, মা, মাটি ইত্যাদি থিমের উপর বানানো বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে মনে হবে এইসব বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক, তারা রীতিমত আমাদেরকে দেশ প্রেমের সবক শিখায়। তারা জাগরণের গান করে, ৩ মিনিটের ভাষা আন্দোলন করে, লালন কিংবা পহেলা বৈশাখ স্পন্সর করে আর তার আড়ালে ঢেকে রাখে দেশের মানুষের শ্রম ও ঘাম নিংড়ে নেয়া অর্থকে মুনাফা বানিয়ে বিদেশে পাচারের নানান অন্ধকার কৌশল। তবে শাক দিয়ে মাছ কিংবা দুধের সর দিয়ে তলার গু ঢেকে রাখা যেমন অসম্ভব, মোবাইল কোম্পানি সহ সকল লুটপাট কারী কর্পোরেটরাও তেমনি বিজ্ঞাপন আর স্পন্সরের চাকচিক্য দিয়ে তলার অন্ধকার বেশি দিন ঢেকে রাখতে পারবে না।