ইউটিউবারদের প্রাঙ্ক ভিডিও মজার, না ভয়ানক এক অসভ্যতা?
প্রাঙ্ক ভিডিও অনেকেই দেখেছেন ইউটিউবে,যারা দেখেছেন তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। যারা দেখেন নাই তাদের বলছি-
“প্রাঙ্ক (PRANK) যার মানে হলো কৌতুক। তবে ইউটিউবাররা বিশেষ করে বাংলাদেশের যারা আছে তারা মানুষকে বোকা বানিয়ে কৌতুক করে। এক্সাম্পল দিচ্ছি
‘আপনি রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছেন,একটা মেয়ে আপনার কাছে হেল্প চাইলো,যখন আপনি তাকে হেল্প করতে গেলেন,মনে করেন টাকা দিচ্ছেন। সে মেয়ে চিল্লায়া উঠল,ভাই ভাই এই লোক আমাকে টাকা দিচ্ছে খারাপ কিছু করার জন্য। আগ থেকেই তাদের কিছু লোক এসে আপনাকে ঝাড়ি,কেউ মারতে আসবে,কেউ টানা হেছড়া করবে,কেউ পুলিশে দিতে চাবে। একপর্যায় যখন আপনি চুড়ান্ত পর্যায় চলেযাবেন,তারা আপনাকে বলবে ভাই এটা একটা প্রাঙ্ক ছিলো ,ঐ যে ক্যামেরা,ঐযে ক্যামেরা। যারা বুঝে ভালই না বুঝলেও ক্যামেরায় হাত তুলে হায় বলতে বলে। আর এই সব বিষয়গুলো হিডেন ক্যামেরায় ধারন করা হয়। তারপর আরও কতগুলা এমন বোকা বানানো লোকদের ভিডিও নিয়ে তারা প্রাঙ্ক ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে ছাড়ে বা টিভিতে প্রচার করে”’
আমি প্রথম প্রাঙ্ক দেখি ইউটিউবে ২০০৮/৯ এ বিদেশীদের,তারপর বাংলাদেশিদের ভিতর মাইটিভিতে। এক পিচ্চি ছেলে কি সব করতেছে হাবিজাবি। সেই পিচ্ছি ছেলে আজকের তৌহিদ আফ্রিদি!
আগে জানতাম যার একটা DSLR ক্যামেরা আছে তার একটা ফেসবুক ফটোগ্রাফি বিষয়ক পেজ আছে। ‘মোখলেস ফটোগ্রাফি, আবুল ফটোগ্রাফি ‘ এই টাইপের। ছবি তুলতে পারুক বা ক্যামেরা বিষয়ে জানুক না জানুক,ফটোগ্রাফার হিসাবে পরিচয় দিবে। কিন্তু ফটো তুলতে পারলেই যদি সে ফটোগ্রাফার হয়ে যায়,তাহলে ত হইছিলই।
আর এখন যার একটা ভিডিও ক্যামেরা আছে,তার একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে।আজেবাজে যত যা কিছুহোক সেটায় আপ দিবে। সবাই টাকা কামানোর ধান্ধা। সবাই ফেমাস হয়েযাবে।
প্রাঙ্ক দেখার পর আমার মনে একটা চিন্তা জাগলো,
”তারা মানুষকে এভাবে বোকা বানাচ্ছে,একদিন ত মানুষ প্রাঙ্ক ভেবে সত্যিই কাউরে হেল্প করতে আসবে না।”
সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে ভিডিও করে,পাবলিক প্লেসে,মেয়েকে প্রপোজ,ছেলেকে প্রপোজ,রাস্তায় ভায়লেন্স তৈরি করে তারা সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট করে। এভাবে যদি মানুষের বিশ্বাস ভাঙ্গতে থাকে কেউ কারো বিপদে এগিয়ে আসবে না। ভাববে প্রাঙ্ক করতেছে।
ধরুন যারা প্রাঙ্ক করে আজ ইউটিউবে পরিচিত,তারা যদি কোনদিন রাস্তায় ছিনতায়ের কবলে বা কিডনাপিং হচ্ছে। সে চিল্লায়াও যদি বলে ভাই হেল্প, হেল্প কেউ এগিয়ে আসবে না ভাববে তারা প্রাঙ্ক করতেছে।
“”একটা নাটকে দেখলাম,ক্যামেরা লাইট নিয়ে ছিনতাইয়ের শ্যুটিং করতেছে কিন্তু তা শ্যুটিং ছিল না,অরিজিনাল ছিনতাই ছিলো। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ৫/৭ জন পুলিশ তা দেখতেছিল,তারাও ভাবল শ্যুটিং। ছিনতাই শেষে পুলিশ ঐ লোকেরে বাহবাহ দিচ্ছে,ভালো অভিনয় করছে বলে,কিন্তু লোকটা কিছুতেই বুঝাতে পারল না,আসলেই এটা ছিনতাই ছিল। আল্লাহ না করুক আপনাদের এমন”
একটা বাস্তব উদাহরণ “‘ আমেরিকার এক বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতার মা মারাগেছেন। মায়ের মৃত্যুর পর লোকটা মায়ের জান্য কান্না করতে ছিলেন কিন্তু বাকিরা হাসতে ছিলো। তরা সবাই ভাবতেছিলো যে সে কৌতুক অভিনয় করতেছে” এই লোক শুধু ভাল কৌতুক অভিনয় করত তাইই এমন হলো, আজকের প্রাঙ্ক সাহেবদের যে এর চেয়ে ভয়ানক কিছু হবে না তার গ্যারান্টি কি?
“রাস্তায় একটা মেয়ে হেটে স্কুল, কলেজে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা লোক মেয়ের গায়ে একটা প্লাসটিকের সাপ ছুড়ে মারল,মেয়েটা ভয়ে চিৎকার দিয়ে দৌড় দিল কিন্তু প্লাস্টিকের সাপ পায়ে প্যাচিয়ে মেয়েটা পরেগেল। হয়েগেল প্রাঙ্গক,এবার ভিডিও এডিট করে,ফানি মিউজিক সহ,স্লো মোশনে দেখানো হলো কিভাবে সে পরল,কেমন ভয় পেল!”
বাহ,মজা আগেয়া! আমরাও এসব ইউটিউবে দেখি আর হাসি। বাহ বাহ তালিয়া। ছোটবেলায় আমাদের টিচার শিখাতো “কেউ রাস্তায় পরেগেলে তাকে দেখে না হেসে তাকে দ্রুত হেল্প করতে হবে” ক্লাস থ্রি,ফোরের ইসলাম শিক্ষা বইয়ে এ নিয়ে একটা হাদিস বা আমাদে নবী(সা র ঘটনাও আমরা পড়ছি।
ধর্মীয় ব্যাপার বাদ দিলাম,আসুন মানবিক দিক নিয়ে। আপনি যে মেয়ের পড়েযাওয়া নিয়ে হাসতেছেন। সে মেয়েকে নিজের বোন মনে করে একবার কল্পনা করেন ত। তাহলে আসল মজাটা বুঝতে পারবেন। আর সেই মেয়েটার অবস্থাই চিন্তা করেন একবার। যদি বড় কোন ইনজুরি হত ত?
পার্কে বসে আছেন বউ,জিএফ,ফ্রেন্ডকে নিয়ে পিছনে পটকা ফুটানো হলো,কানে হঠাৎ বুবুজেলা বাজিয়ে দেয়া হলো। আপনার চমকেগেলেন,দৌড় দিলেন,ভয়ে পরেগেলেন। বাহ মজা আগেয়া। যাদের নার্ভ দুর্বল, অনেক হার্টের রুগী আছে যারা বিকালে পার্কে হাটতে যায়। আপনার এই ফান তার জন্য মৃত্যুর কারন হতে পারে। একবারও কি চিন্তা করেছেন?
মেয়েকে নিয়ে শপিং এ গেলেন। হঠাৎ একজন ফ্লোরে বসে আপনার সামনেই আপনার মেয়েকে প্রপোজ করল,বাবা হিসাবে আপনি কতটা বিব্রত হবেন।আর সেই ভিডিও যদি ইউটিবে সারা বিশ্বের জন্য দেয়া হয়, তাহলে??
ইউটিউবাররা আমাদের বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করে,ভালো। কিন্তু এমন ভয়ানক বিনোদন কেন?? অন্যকে বোকাবানিয়ে কেন??
একটা প্রাঙ্ক দেখলাম
“”স্কুল, কলেজের মেয়েকে যেয়ে প্রপোজ করা,দুজন স্কুলের মেয়ে সেই প্রাঙ্ককারির ভায়ের কথা শুনে দৌড় দিতে যেয়ে পড়েগেল,কোন রকম উঠে দে দৌড়।,আরেকজন পালাতে যেয়ে রাস্তা দ্রুত পার হওয়ার সময় গাড়ির নিচে পরি পরি করেও বেচেগেল”
বাহ কত মজা,আর মেয়েগুলাও কত বোকা,প্রোপজ করছে দৌড় দিতে যেয়ে পরেগেছে,এই ভিডিও আপ দিলেই হিট।
পার্কের কোন এক প্রেমিক যুগলকে তাদের অনুমতি না নিয়ে তাদের ভিডিও করল। কিছুদিন পর মেয়েটার অন্য কোথাও বিয়ে হয়েগেল। মেয়েটা তার অতিত গল্প তার হাজবেন্ডকে বলে নাই,সাধারণত অনেকেই বলে না। অনেকেই মেনে নেয়,পাস্ট থাকতেই পারে কিন্তু জানতে চাই না,জানাতে চাই না। যা হয়েছে বিয়ের আগে এখন আমি আমার সংসার নিয়ে থাকতে চাই। এখন ইউটিউবে যদি এই ভিডিও দেখা হয়, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সন্দেহ নামক ভাইরাস ঢুকবে কি?
তাই ভিডিও করার আগে না হোক পরে অনুমতি নিয়ে নিন যদি দেখাতে চান। আর যদি তাও না পারেন ফেস দেখায়েন না,ফেস ব্লোর করে দিয়েন। আপনারা এতটা এতটা ক্রিয়েটিভ, কিন্তু এতটুকু কমনসেন্স আপনাদের অনেকেরই হয় না!
অলটাইম আমরা বিদেশিদের কপি করি,কপি করেন কিন্তু তা আমাদের সমাজ,আমাদের সাংস্কৃতির সাথে কতটা যায়?? আজকে যে ছেলে বা মেয়েকে বোকা বানিয়ে প্রাঙ্ক করলেন তাদের পরবর্তিতে লাইফে কি সমস্যা হয়েছে খোজ নিয়েছেন?? জেনেছেন??
মেয়েদের প্রশ্ন করা হয়,কত ইঞ্চি লাগবে? কত ইঞ্চি তার জন্য পার্ফেক্ট?,স্বামী অক্ষম হলে কি করবেন? সেক্সে কতক্ষণ টাইম চায়? ভার্জিন কি না? বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেক্স করছে কি না? সহ নানান অশালীন প্রশ্ন! কেন? এটা কি ধরনের ভদ্রতা?
“আপনার বোনকে যদি বলি ‘আপু কয় ইঞ্চি আপনার পার্ফেক্ট? কতক্ষণ সেক্স করতে পারবেন? বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেক্স করেছেন?’ ক্যামেরার সামনে না,রাস্তার পাশেই যদি জিজ্ঞাস করি,ভাই হিসাবে বোনকে এমন প্রশ্ন করার পর আপনি আমাকে আস্থ রাখবেন? যদি ভাই হোন আমাকে আগে রাস্তায় ফেলে পিটাবেন,ইভটিংর জন্য পুলিশে দিবেন। পরের দিন রিলাক্স করে পত্রিকায় আসল ঘটনা জানবেন, এটা একটা প্রাঙ্ক ছিলো ভাইয়া”
এটা আমেরিকা,ইউরোপ না। সেখানে ছেলে,মেয়ের গোপন অঙ্গ প্রেস করে ভিডিও করে প্রাঙ্ক হিসাবে চালিয়ে দিতে পারেন,কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু এখানে সামান্য হাত ধরলেও অনেক কথা শুনতে হয় একটা মেয়েকে,সমাজ, প্রতিবেশীদের থেকে। অমুকের মেয়েটা স্কুল ভার্সিটির নাম করে পার্কে ঘুরে,ছেলেদের সাথে শপিং এ যায়,চরিত্র ভাল না,এই মেয়ের এত ইঞ্চি লাগবে,এই মেয়ের টাইমিং এত,এই মেয়ে ভার্জিন না। আমার ছেলে ওর ভিডিও ইন্টারনেটে দেখাইছে,আন্টিদের গল্পের টপিক হয়েযায়।
আর আপনাদের মানহীন ভিডিওর অশালীন ক্যাপশন,ভিডিওতে অশালীন পিক থ্যাম্বল দেয়ার অভিযোগ ত আছেই।
চেষ্টা করুন অন্যকে কষ্ট না দিয়ে,অন্যকে কোন সমস্যায় না ফেলে,অন্যের ক্ষতি না করে। অশালীন কিছু না দিয়ে নির্মল বিনোদন দিতে।
মনে রাখবেন
“”ভাল কিছু আপলোড করলে সেটার সুফল আপনি মরার পরেও পাবেন,খারাপ কিছু দিলে সেটারও প্রতিদান পাবেন,কারন এই বিষয়গুলা আপনি মরার পরেও ইউটিউব,ফেসবুক যতদিন থাকবে,এগুলাও ততদিন থাকবে। লোকজন যত দেখবে,পড়বে তার প্রতিদানে আপনার কপালেও কিছুটা হলেও জুটবে”
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:৪১