somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সন্ত্রাসের সংজ্ঞা # শ্রুতি বেদি

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭ রাত ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে কতিপয় আন্তর্জাতিক কনভেনশন থাকলেও সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত কোনো সংজ্ঞা নেই। কিন্তু এটা জরুরি ইস্যু, এবং এর দিকে এখনই নজর দেয়া প্রয়োজন।
সরকার, ক্ষিপ্ত জনতা, জঙ্গিবাদী বা অপরাধীদের দ্বারা সংগঠিত যে কোন সহিংস কাজকে সাধারণত সন্ত্রাস হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু নিজেদের রার জন্য যারা সহিংস পন্থা বেছে নেয় তারাও কি সন্ত্রাসবাদীর ক্যাটাগরিতে পড়বে? এখানেই সমস্যা দেখা দেয়, কেননাÑ ‘একজনের কাছে যে সন্ত্রাসবাদী অন্যজনের কাছে সেই মুুক্তিযোদ্ধা’। সেভাবেই সন্ত্রাসবাদের অর্থ তৈরি হয়, যেভাবে একজন ব্যক্তি একে দেখে।
হুইটব্যাক বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের কোনো সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা না থাকা কোনো দুর্ঘটনা নয়। কেননা এটি আপেকি একটি শব্দ এবং এটি তার অর্থগত উৎসকে বর্জন করেছে। একইভাবে শব্দটি চূড়ান্তভাবে বিপজ্জনক, কেননা জনগণ বিশ্বাস করতে চায় এর একটি অর্থ আছে। যৌক্তিক বিচারবোধ নেই যাদের এবং আলোচনার মনোভাব লালন করেন না, এমন ব্যক্তিরা এর ব্যবহার বা অপব্যবহারের যুক্তি খুঁজে নেয়। এমনকি নিজেদের বেআইনি ও অনৈতিক আচরণকে জায়েজ করতেও এ শব্দটি ব্যবহার করে।’
শব্দটির মানে গত দুইশত বছরে দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে। পূর্বে এটি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝানো হতো। যে মুক্তিযোদ্ধারা বিদেশী শাসনের যাঁতাকল থেকে দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধরত ছিলেন। সেসময় একে বিপ্লবী ধারণা হিসেবেই বিবেচনা করা হতো।
সংখ্যালঘু জনতা সংখ্যাগুরুর চাপে থাকলে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমেই নিজেদের শক্তি জানান দিতে চায়। এর পর দেখা মিলল, রাষ্ট্র সমর্থিত সন্ত্রাসের। দেখা গেল কিছু গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রই সমর্থন জোগায় ও প্রশিণ দেয়। এদের কর্মত্রে কোথায় তা সহজেই অনুমেয়।
পরবর্তীকালে, এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত লোকেদের চিহ্নিত করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফরিদ জাকারিয়া যেমনটি বলেছেন, অধুনা সন্ত্রাসবাদ সমাজ সমর্থিত। রাষ্ট্র নয়, সামাজিক ব্যক্তিদের কাছ থেকেই তার সমর্থন মেলে। সন্ত্রাসবাদ শব্দটি এর চৌহদ্দির মধ্যেই গুরুতর আক্রমণাক ও অতিরিক্ত অর্থগত দ্যোতনা সঞ্চয় করেছে। একটি অপরাধ সংঘটিত করার পর আজকের সন্ত্রাসবাদীরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বাসস্থানবিহীন এই এই শত্র“র খোঁজও মেলে না। প্রত্যেক পর্বেই সন্ত্রাসীদের নতুন চেহারা ও নতুন অর্থ তৈরি হয়। তারপরও তাদের ল্য থাকে জনতার মধ্যে ভীতি জাগানো, এবং নিজেদের পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে তাদের প্রতিক্রিয়া তৈরি করা। সন্ত্রাসের বিশ^জুড়ে গৃহীত সচেতন কোনো সংজ্ঞার্থ না থাকাই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ের বড় ফাঁক।
‘টেরর’ শব্দটি প্রচলিত হয় ১৭৩৯-৯৪ সালে, ফ্রান্সে ‘সন্ত্রাসরাজ’ চলার সময়কালে। মূলত, এই শাসনের নেতারা স্বাধীনতাকে সুরা দিতে সন্ত্রাসকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু যখন ফরাসি বিপ্লব তিক্ত হতে থাকলো তখন এই শব্দটি দ্রুত গিলোটিন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিধ্বনি করতে থাকলো। যারা ওই সময় মতাসীন ছিল সেই জ্যাকোবিয়ানরা ছিল বিপ্লবপন্থী। ক্রমশ ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি সাধারণভাবে সহিংস বিপ্লবী কর্মসূচি হিসাবে প্রযুক্ত হতে থাকলো।
সরকার-বিরোধী অর্থে ‘সন্ত্রাস’ শব্দটির ব্যবহার ১৮৬৬ (আয়ারল্যান্ড) ও ১৮৮৩ (রাশিয়া) সালের আগে নথিভুক্ত হয়নি। র‌্যান্ড থিংক ট্যাংকের ব্রুস হফম্যানের মতে, আজকাল বেশিরভাগ সন্ত্রাসবাদীই এই তকমাকে অপছন্দ করে।
‘টেরর’ শব্দটি লাতিন উৎস থেকে উৎসারিত (টেরিরি বা ডিটেরিরি থেকে। অর্থ প্রকম্পিত করা)। ফ্রেঞ্চ অনুসর্গ ‘ইজম’ মানে ‘চর্চা করা’। অর্থ দাঁড়ায়Ñ ‘প্রকম্পিত করার জন্য চর্চা বা অনুশীলন’ বা ‘প্রকম্পিত করার কারণ তৈরি’। প্রকম্পিত অর্থ এখানে অবশ্যই ভীতি, ত্রাস, উত্তেজনা; যাকে আমরা সন্ত্রাস বলে অভিহিত করি। ইংরেজি ‘টেরোরিজম’ শব্দটি ফ্রাঞ্চে ইংরেজদের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতিবাহী।
আধুনিক পশ্চিমা বাচনভঙ্গিতে এর অনুপ্রবেশ ফরাসি ভাষায় মাধ্যমে, চতুর্দশ শতকে। ইংরেজিতে এর প্রথম ব্যবহার নথিভূক্ত হয় ১৫২৮ সালে। সন্ত্রাসের মূল প্রকৌশল নেয়া হয় প্রাচীন চীনা একটি নীতিবাক্য থেকে। এর মর্ম হলোÑ ‘একজনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ভয় দেখাও দশহাজারকে’। এর মানে, সন্ত্রাসবাদীর কাছে সহিংসতা শুধু ধ্বংস নয়, বরং সন্ত্রাসের বাণীকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার উপায়।
সন্ত্রাস সংঘটনের কারণ অনেক। উদাহরণÑ ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা, যা একটি গোষ্ঠী পুরো সামজের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। আর যখন সন্ত্রাস ধর্মীয় বা জাতিগত উন্মাদনার সঙ্গে মেলে তখনই তা নিকৃষ্ট রূপ ধারণ করে।
অযোধ্যার ঘটনা সকল যুক্তিকে ম্লান করে দিয়েছে। আত্মঘাতি সন্ত্রাস অন্য একটি প্রপঞ্চ যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ওয়ার্ল্ড টেড সেন্টার বা লন্ডন হামলা এগুলোরই বর্ধিত প্রকাশ। নিজেকে ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। দিন দিন জৈব, রাসায়নিক ও আণবিক অস্ত্র সম্বলিত সন্ত্রাসের সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে। কম্পিউটারের ওপর আমাদের অধিক নির্ভরতা সাইবার অ্যাটাকের সম্ভাবনাকেও বৃদ্ধি করছে। সাইবার সন্ত্রাস এখন আর কোন কল্পকাহিনী নয়। সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করার উপাদানগুলোতে নানা ধারণা, মতাদর্শ, মূল্যমান ও প্রভাবক যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু, পরিষ্কার সচেতনতামূলক সংজ্ঞা প্রয়োজনী। কেননা সন্ত্রাস বিরোধী আইন প্রণয়নের পূর্বে এটা দরকার।
নির্দিষ্ট সময়ে যেকোন সন্ত্রাসমূলক ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করলে এটির প্রয়োজন পড়ে। এটি ক্রমবর্ধমান ধারণা যে, সরকার বিদ্যমান আইন-শৃংখলা নীতির অপলাপ না ঘটিয়ে এটি করতে পারে না।
টাডা আইনে অভিযুক্ত ১৮ উগ্রবাদীর আপিল নাকোচ করার প্রেক্ষাপটে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ইন্ডিয়ান পেনাল কোড এবং আর্ম অ্যাক্ট অনুসারে সন্ত্রাসবাদ হলোÑ শান্তির সময়ে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নিয়ে একমত হতে পারেনি, কেননা কোথাও কোথাও এটি মুক্তিযুদ্ধ হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে। তাই কোর্ট বলেছিল, এর সংজ্ঞা নির্ধারণ এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের মতে, ‘সন্ত্রাসবাদ হলো ক্রমবর্ধমান আইনহীনতা ও সহিংসতামূলক আচারের ইশতেহার। যা প্রতিষ্ঠিত আইন এবং সভ্য ও আইনভিত্তিক সমাজের প্রতি হুমকি।’ কোর্ট আরও যোগ করেছে, ‘ যদি যুদ্ধাপরাধের ধারণাÑ সাধারণ নাগরিকদের ওপর অপ্রস্তুত আক্রমণ, নাগরিকদের জিম্মি করা, বন্দীর প্রাণসংহার ইত্যাদিকে শান্তির সময়ে টেনে আনা হয় তবে আমরা সন্ত্রাসবাদী কাজকে সংজ্ঞায়িত করতে পারবো শান্তির সময়কালীন যুদ্ধাপরাধ হিসেবে।’
যদি আমরা সন্ত্রাসবাদকে যুদ্ধ বলি তবে ব্যক্তির সমতাকে ছোট করে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যক্তির বদলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। অভিযুক্ত সন্ত্রাসী নয়, শত্রুর প্রকৃত পরিচয়ের দিকে আঙ্গুল তুলতে হবে।
সন্ত্রাসে দ্বিধাহীন ও সচেতনভাবে অর্থ প্রদান করা হয়। এতে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য, সরলার্থে সকল নৈতিক ও মানবিক সম্পদ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ

লেখাটি ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের দি ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×