বিমানবিকীকরণ এক বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এটা বোঝা সহজ নয় যে কিভাবে সকল গর্ব সহকারে প্রযুক্তি ও যোগাযোগ আমাদেরকে তীব্র গতির মুখে ফেলেছে। আমরা সকলেই আমাদের সময়ে দ্রুত চলা ও উত্তেজিত হওয়ার নিকটস্থ সময়ের সন্তাপে তীব্র লালসা আক্রান্ত।
নতুনরা অভিযোগ করেন, সম্পাদকরা তাদের এমন কাজ তিন ঘণ্টার শেষ করতে বলেন যা শেষ করা ছয় ঘন্টার কম সময়েও সম্ভব নয়। তারা দুই কলামের জন্য ম্যাটার রেডি করতে বলেন কিন্তু শেষ সময়ে অর্ধেক কলামের লেখা দিলেও তাড়াহুড়ায় কোনো বিষয় ব্যাখা করার কিংবা একটি শব্দ সংস্কারের সময় থাকে না। বসের কাছ থেকে ফিডব্যাক পাওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। এক নবিশ রিপোর্টার আমাকে বলেছেন, তারা এমনকি আমাদের তিরস্কারও করেন না। নীরব তথ্য-প্রযুক্তির চাপানো ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে যাওয়া একজন সম্পাদকের পক্ষে একাজ করার শক্তি ও সময় কোনোটাই থাকে না। আমার মতে, যাকে আমরা সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস বলে মানি সেই রিপোর্টের আকারও স্থানের অভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে। কিন্তু এটা আরও বেশি সময়, আরও বেশি গবেষণা, আরও তাৎপর্য এবং লেখার কুশলতা দাবী করে। রিপোর্ট হলো বাস্ততার অতি সতর্ক ও যথাযথ পুনর্নির্মাণ। অন্য কথায়, সংবাদ হলো নিজের সামগ্রিকতায় ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে সেভাবেই সেটা পাঠকের প্রত্যক্ষ উপলদ্ধিগ্রাহ্যতায় নিয়ে যেতে চায়।
অনেক সংবাদপত্র সম্পাদকের ক্ষেত্রেই ট্রান্সক্রিপশন এসিড টেস্টের কাজ করে। তারা শব্দের ঝংকারে বিভ্রান্তšহন, বাগার্থগত বিদ্যায় হোঁচট খান, বানানে ভুল করেন ও বাক্যগঠনের ফাঁদে পড়ে যান। সম্ভবত সমাধান হলো : ভদ্র গোছের একটি নোটবুকের শরণাপন্ন হওয়া। সাংবাদিকের কাছে এডিট করার গুন হলো তেমনই, যেমনভাবে রেকর্ডার তার অমূল্য সঙ্গীর কাজ করে। যে কোনো ক্ষেত্রে অনুমান বিপজ্জনক। এটি আধুনিক সাংবাদিকতায় নৈতিক ও অন্যান্য কারণে লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সবসময় এটি নৈতিকতাহীনতার কারণে ঘটে না, ঘটে পেশাগত অদক্ষতার কারণেও।
হয়তো গণযোগাযোগের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পেশার জন্য সহায়ক অনেক কিছুই শেখানো হয়, কিন্তু পেশার বিষয়েই সবচেয়ে কম শেখানো হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষার ন্যূনতা ও স্থিরতা সত্ত্বেও মানবিক শিক্ষাক্রমকে অব্যাহত রাখতে হবে, কেননা এটি ছাত্রদের হাইস্কুলে অর্জন করতে না পারা সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে দিতে পারে। যাই হোক, যে কোনো ধরনের শিক্ষাকে তিনটি মূল এলাকায় আলো ফেলতে হবে: পেশাগত ক্ষেত্রে অগ্রগতি, এটি সর্বজনবিদিত যে, সাংবাদিকতার সঙ্গে গবেষণার সংযোগ নেই। কিন্তু সকল সাংবাদিককেই সংজ্ঞাগতভাবে গবেষণা-নির্ভর হতে হবে। আর সচেতনতা তৈরির এই নৈতিক অবস্থানটি কোনো দৈব ঘটনা থেকে উদ্ভূত হতে পারে না। স্ত্রী মৌমাছির কাছে যেমন পুরুষ মৌমাছি, তেমনভাবেই এগুলোর সঙ্গে লেগে থাকতে হবে সাংবাদিককে। বুনিয়াদী শিক্ষার উন্নতির জন্য বারবার কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে জনসেবার পরিপ্রেক্ষিতেই অর্জিত হবে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বিষয়ক প্রণোদনা।
অন্যকথায়, বিকাল পাঁচাটার আসরে শেখার সেই প্রণোদনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কার্টাজেনা দে ইন্দিয়াস ভিত্তিক স্বাধীন সাংবাদিকদের নিয়ে আমার একটি দল আছে। পরীক্ষামূলকভাবে এই বিষয়গুলোকে ফিরিয়ে আনতে এরা চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফাউন্ডেশন ফর আ নিউ অ্যাপ্রোচ টু জার্নালিজম ইন ইবিরো-আমেরিকাÑএই হলো এ দলের গালভরা নাম। এই পাইলট প্রোগ্রামের লক্ষ্য নতুনরা, যারা সবে তাদের কাজ শুরু করেছেন। তারা রিপোর্টিং, সম্পাদনা, রেডিও-টেলিভিশন সাক্ষাৎকার এসবের যেকোনো একটি ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং নামদার সাংবাদিকদের নির্দেশনা মোতাবেক দায়িত্ব পালন করেন।
জনসম্মুখে সংগঠনের ঘোষণা দেয়ার সময় মিডিয়া সংস্থাগুলো কর্মরত সদস্যদের ভ্রমণ, রেজিস্ট্রেশন ও বাসস্থানগত সহায়তা দিতে চেয়েছে। এর সদস্যদের হতে হবে ত্রিশ বছরের কম বয়সী, থাকতে হবে তিন বছরের যোগ্যতা, আর পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে তাদের শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ঠ কাজের নমুনা দাখিল করতে হবে। কর্মশালার দৈর্ঘ্য নির্ভর করবে অতিথি প্রশিক্ষকদের সময় দেয়ার সামর্থের ওপর। অধিকাংশ সদস্য ব্যস্ততার কারণে এক সপ্তাহের বেশি সময় বের করতেই পারেন না। ওয়ার্কশপের সময় তারা তাত্ত্বিক কচকচানি আর প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি পক্ষপাত এড়িয়ে চলবেন। তারা চাইবেন গোলটেবিল আলোচনায় হাতে-কলমের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে। আর সেটা করবেন, তাদের সঙ্গে নিজেদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমেই। কিভাবে সাংবাদিক হতে হয় সেটা শেখানো লক্ষ্য নয়। বরং যারা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সাংবাদিক হয়েছেন তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিই লক্ষ্য। কোনো ফাইনাল পরীক্ষা নেয়া বা মূল্যায়ন করা হবে না, ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট বিতরণ করা হবে না। তাদের দক্ষতার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমেই স্থানান্তর প্রক্রিয়া নিশ্চিত হবে।
শিক্ষণবিজ্ঞান সংক্রান্তšপাটাতনে দাঁড়িয়ে এর লাভ-ক্ষতি বিচার করা কঠিন। কিন্তু আমরা কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের বর্ধিষ্ণু আগ্রহ দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছি। এই প্রপঞ্চ ইতিমধ্যে মিডিয়া সার্কেলের অনশ্চিয়তাতবাদী, সৃজনশীল বিদ্রোহী এমনকি বোর্ড অব ডিরেক্টর দ্বারাও সমর্থিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে
আসা কুড়িজন সাংবাদিক একত্রিত হয়ে পাঁচদিনের আয়োজনে আলোচনা মধ্য দিয়ে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সাংবাদিকতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে সাক্ষর রেখেছেন।
শেষ পর্যন্ত আমরা সাংবাদিকতা শেখার কোনো নতুন নিয়ম উপস্থাপন করতে যাচ্ছি না, বরং ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছি সাংবাদিকতা শেখার পুরোনো পদ্ধতিকেই। মিডিয়া এই উদ্ধারকর্মে সমর্থন দিলেই ভাল করবে। হোক সেটা নিউজরুমে অথবা তাদের প্রকাশনার মাধ্যমে কিংবা যে কোনো উপায়েই। কেননা এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রকৃত সংকটে পড়ার আগেই শিখবে কী করে সংকটকে মোকাবেলা করা যায়। সাংবাদিকতা হলো সেই দুর্বার আকাঙ্ক্ষা যাকে বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েই পুনর্বিন্যস্তকরণ বা মানবিকীকরণ সম্ভব। যার রক্তে এটা নেই সে জীবনের অভূতপূর্ব ক্ষেত্র থেকে উৎসারিত চৌম্বকত্ব অনুভব করতে পারবে না। যার এই অভিজ্ঞতা নেই সে হয়তো বিশেষ উত্তেজনা থেকে সংবাদের দ্বারা আক্রান্তšহবে, এর পেছনে ছুটে ক্লান্তšহবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৈতিকভাবে পরাজয় বরণ করবে। এর জন্য যার জন্ম হয়নি, যে এর জন্য জীবনকে প্রস্তুত করেনি তার জন্য এটা অসাধ্য। যেখানে কাজ শেষ হয় প্রতিটি খবরের পেছনে ছুটবার পর, খবরের সমাপ্তিøঘটেছে বলে মনে হয়, কিন্তু তার পরমুহূর্তেই শুরু হয় আরেকটি সংবাদের। আর এতে নেই কোনো শান্তির অবসর।
৯ অক্টোবর ২০০৫ এর আউটলুক ম্যাগাজিন থেকে
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০০৭ দুপুর ১:৩৪