ইসলাম ও মুসলিম জাতিগুলো গণমাধ্যম মারফত ছড়ানো এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এর ভিত্তি সচেতনভাবে তৈরি করা এক ধরনের ডায়ালেক্টিক। এগুলোকে অবশ্যই যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে মোকাবেলা করা দরকার। আমরা, মুসলমানরা অনুগত ও আত্মরক্ষামূলক কিংবা উগ্র-হিস্টিরিয়াগ্রস্থ অবস্থায় যুক্তি হারিয়ে ফেলি। অথচ এগুলোর মধ্যে ব্যবধান বিপুল। আমাদের এটা প্রমাণ করা দরকার যে, বিকল্প সব রাস্তাই বৈরী নয়।
এটা কৌতুকপূর্ণ যে, বিশ্বাস নিয়েই আমেরিকান ও মুসলমানদের মধ্যে এতো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ তৈরি হচ্ছে। কেননা এরাই বিশ্বাসীদের শেষ প্রতিনিধি।
এই বছরের শুরুর দিকের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬০% আমেরিকান দিনে একবার প্রার্থনা করেন, ৭০% মনে করেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতির দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাস থাকা উচিত এবং ৬১% গর্ভপাতের মতো নৈতিক ইস্যুগুলোতে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের পক্ষপাতি। মুসলমানদের নিয়ে এই রকম পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কিন্তু তাদের বেলাতেও প্রতিটি ব্যাপার অনুপাতে সমান বা কিছু বেশি হবে। একজন মুসলমান প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতি শুক্রবারের নামাজে নিয়মিত দর্শন দেয়া একটা পালনীয় ব্যাপার বটে।
অন্যপক্ষে ইউরোপ যুক্তিবাদের বিনিময়ে ধর্ম হারিয়েছে এবং এর উপজাত হিসেবে সেখানে জন্ম নিয়েছে কমিউনিজম। দুই ইউরোপীয় নাস্তিক মার্কস ও লেনিনের এমনই প্রভাব যে, তারা এশিয়ার অর্ধাংশে তাও, কনফুসিয়াস, বুদ্ধের এবং ইউরোপের অর্ধাংশে খ্রিষ্টের প্রভাবকে খর্ব করেছেন।
ধর্ম মানবিক কারণের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বাস বিষয়টি নৈতিক, নান্দনিক, তাত্ত্বিক ও অনুপ্রেরণামূলক। ইসলাম এক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ক্ষমতা ও সৌন্দর্যের স্বীকৃতি দেয়, এবং বিশ্বাস করে। আমরা কিভাবে জন্ম লাভ করি এবং মৃত্যুবরণ করি তা জানলেও, আমরা জানি না কেন তা ঘটে। মুসলমানরা মৃত্যুর আগের এবং পরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না লিল্লাহে রাজেউন’ (আল্লাহর নিকট থেকে আমরা এসেছি, আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব। ভেবে দেখলে, খৃষ্টীয় বা ইহুদী বিশ্বাস অপেক্ষা ইসলামের বেহশত-দোজখের ধারণা অনেক বেশি ‘অযৌক্তিক’।
সমস্যা তৈরি হয় যখন পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘটনাক্রমে বিশ্বাস ধর্ম এবং বিশ্বাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এরকম বিশ্বাস মতে, প্রত্যেক আত্মঘাতি হামলাই বেহেশতের দিকে অভিযাত্রার এক বিদ্রুপাত্মক মহড়া। যদিও তা সব সময় ঘটে না, পরিণত হয় নৈরাশ্যের কান্নায়। এমনকি ইসলামী কেতাবকগুলোর নিবিড় পাঠে বোঝা যায়, মৃত্যুর পর আমরা আমাদের মানবিক শরীর ফিরে পাব না। এই জীবনের প্রয়োজন ও আনন্দের সঙ্গে পরের জীবনের রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। কিন্তু উৎপ্রেক্ষা মারাত্মক বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়। কেননা এটি উৎসর্গকে, বিশেষত জীবনের উৎসর্গকে উৎসাহিত করতে চায়।
সত্য হলো, মুসলসমানদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক নিপীড়নের শুরু ৯/১১ এর অনেক আগেই। ফলে বলা যায় না এটি নাইন ইলেভেনের প্রতিক্রিয়া। হান্টিংটন সভ্যতার একটি আশঙ্কাজনক সংঘর্ষ নিয়ে লিখেছিলেন ৯/১১ এর সাত বছর আগে। এটা ছিল সেই সময় যখন প্রায় প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র আমেরিকাকে আফগানিস্তান ও কুয়েত মুক্ত করতে সহায়তা দিয়েছিল। নিও কনজারভেটিভদের দোষারোপ করাই যথেষ্ট নয়। বরং তাদের সমালোচনার যথাযোগ্য উত্তর দিতে হবে।
কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এক মেরুর বিশ্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আত্মঘাতি হামলা মুসলমানদের উদ্ভাবন। আত্মঘাতি হামলা সব সময়ই যুদ্ধকৌশলের অংশ ছিল, যারা জীবন উৎসর্গের মধ্য দিয়ে অধিকাংশের জীবন বাঁচায় তাদের জন্য বিশেষ শ্রদ্ধা সংরক্ষিত। গার্ডিয়ানের এক ভাষ্যকার সম্প্রতি লিখেছেন, স্যামসনই বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত আত্মঘাতী মিশনারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী বিমান বাহিনী কামিকেজকে যুদ্ধের উপকরণে পরিণত করেছিল। তখন আমেরিকার প্রতিক্রিয়া ছিল কৌতুহল উদ্দীপক এবং তা এখনও প্রাসঙ্গিক। মার্কিন তৃতীয় নৌবহরের কমান্ডার অ্যাডমিরাল উইলিয়ম ফেরড্রিক হেলসে (১৮৮৪-১৯৫৯) ২৫ অক্টোবর ১৯৪৪-এ মার্কিন বাহিনীর ওপর কামিকেজ আক্রমনের পর বলেছিলেন ‘কামিকেজের ধারণা আমাদের ভতের একেবারেই নেই। আমেরিকানরা বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করে। তাদের জন্য সেই লোকদের বোঝা কঠিন যারা কিনা মরার জন্য যুদ্ধ করে।'
জাপানিরা কামিকেজকে আত্মঘাত হিসেবে দেখতো না, যারা সুখ কেড়ে নেয় তাদের বিরুদ্ধে নৈতিক বিজয় হিসাবেই বিবেচনা করতো। তারা পাইলটদের বলতো, ‘জীবনের দুঃখ ও আনন্দকে তোমার পেছনে রেখে দাও, কেননা তুমি যতটা মৃত্যুর দিকে যাত্রা করছো ততোটাই যাত্রা করছো স্বর্গের দিকে।' অ্যাডমিরাল তাকিরো ওনিসি পাইলটদের জন্য একটি হাইকু রচনা করেছিলেন,
ঝরে গেলে আজ
কালই উঠবে ফুটে
দীপ্ত জীবনের ফুল
তোমার সুগন্ধের অপেক্ষায় থাকবে সকলে।
সবচেয়ে কার্যকর আত্মঘাতি হামলা চালিয়েছিল শ্রী লংকার ‘হিন্দু’ তামিল টাইগাররা, যাকে বলা চলে অনিয়মিত যুদ্ধ। এ ধরনের একটি হামলায় প্রাণ হারান ভারতের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে চালু একটি ভ্রান্তি হলো, সন্ত্রাসবাদ ইসলামেরই তৈরি। এ ধরনের অপবাদ হলো, বিশ্বাঘাতকতার শামিল।
আমাদের অবশ্যই ৯/১১ ও লন্ডন হামলার প্রতি সহানুভূতি ব্যক্ত করতে হবে। আমি আত্মঘাতি হামলার সঙ্গে একমত নই, কিন্তু মানতে হবে যে আত্মঘাতিরা সবাই এক রকমের নয়। কিছু ক্ষেত্রে বিদেশী শক্তির দ্বারা অধিকৃত দেশে আত্মঘাত হলো তারুণ্যের হতাশা ও চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আত্মঘাতি হামলার শেষ দেখতে হলে অবশ্যই এই হতাশার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের অবশ্যই অসমর্থিত সন্ত্রাস ও প্রয়োজনের লড়াইয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে হবে। ইতিহাসে কোনও কালই নেই যখন সমস্যা বা বিচারহীনতা ছিল না। কিন্তু বিচারহীনতা শান্তিপূর্ণ সংলাপের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হলে কোনো সশস্ত্র যুদ্ধ বা আত্মঘাতি হামলার প্রয়োজন পড়ে না। এটাই হতে পারে আমাদের বিশ্ববোধের কেন্দ্রীয় বিষয়।
কয়েক সপ্তাহ আগে, মধ্য আগস্টে বার্লিনে ‘ইউরোপ ও আধুনিক ইসলাম’ শীর্ষক একটি সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম। একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যরা ছিলেন আমার মেজবান। এখন তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন। তারা পূর্ব ধারণা বা বিশ্লেষণ বোধ কোন কিছুর দ্বারাই তাড়িত ছিলেন না। সাম্প্রাতিক চেতনার মধ্যে প্রবিষ্ট অবজ্ঞার স্রোতের ওপর সেতু তৈরি করতে তারা খানিকটা উদ্বিগ্ন। কিন্তু, মুসলমানদের সম্পর্কে সকল পূর্বধারণাই তৈরি হয়েছে অবচেতনভাবে। একটি সেশনের সভাপতি নারীদের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির অব্যাহত সমালোচনা করছিলেন, যতক্ষণ না আমি বললাম এটা আফ্রিকান উৎস থেকে এসেছে। হিজাবের কথাও স্বাভাবিকভাবে উঠেছিল। আমি যুক্তি দিয়েছিলাম, ধর্মীয় বিধিনিষেধে নির্বিশেষে প্রাচ্যে হিজাব হলো নারীর সাধারণ ভব্যতার প্রকাশ। খৃষ্টানদের আঁকা কুমারী মেরির এমন কোন মূর্তি বা চিত্র আমি এখনও দেখিনি যাতে একধরনের হিজাব নেই। এবং এখনও প্রত্যেক ক্যাথলিক নান ঐতিহ্যবাহী মস্তক আবরণী পরিধান করেন। এটা একটা অদ্ভূত বৈপরিত্য যে, একটি চামড়ার আবরণকে সভ্যতা আর সামান্য স্কার্ফকে বর্বরতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায়শ উচ্চারিত একটি কথার মুখোমুখি হতে হয় আমাকে যে, মুসলমানদের কোনো রেনেসাঁ নেই। রেনেসাঁ থাকে তখনই যখন একটা অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব থাকে। চীন, ভারত ও অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন এলাকাগুলোর এ ধরনের কোন সংকট ছিল না। যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আরও ২০০ বছর দূরের ব্যাপার তখন বাগদাদে ছিল হাজারও বইয়ের দোকান।
একজন মহিলা ডক্টরেট বলছিলেন, মুসলমানরা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছে। আমি যখন বললাম যে, না গডসে নামের এক ব্রাহ্মণ তাকে হত্যা করেছে তখন তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।
অন্য অনেক মুসলমানের মতোই আমি বলেছিলাম, বলতে প্রলুদ্ধ হয়েছিলাম, আমার ধর্ম ‘জিহাদ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার বিশ্বাসের মৌল বিষয়ে আমি আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে নই। ইসলাম শান্তির ধর্ম, কিন্তু এতে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনি যুদ্ধ করতে বাধ্য। এতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় যুদ্ধকে বৈধতা দেয় হয়েছে। জিহাদ হলো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নবী দীর্ঘকাল মক্কায তার ওপর চলা নির্যাতন ও নিপীড়ন সত্ত্বেও অস্ত্র হাতে তুলে নেননি। যুদ্ধ বিষয়ক আয়াত তখনই নাজিল হয় যখন মুসলমানদের বিশ্বাস ভঙ্গ করার জন্য নির্যাতন শুরু হয়। নবী বাধ্য হন অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে। জিহাদের পরিষ্কার বিধিবিধান আছে। এতে বলা হয়েছে, জিহাদে নারী শিশু ও নিস্পাপদের হত্যা করা যাবে না। এমনকি তালগাছ পর্যন্ত ধ্বংস করা যাবে না। অর্থাৎ, প্রত্যেক জিহাদই মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধ জিহাদ নয়।
বার্লিন সেমিনারের শিরোনাম ‘ইওরোপ ও আধুনিক ইসলাম’ কার্যত কোনো অর্থ বহন করে না। প্রথমত, ইসলাম ইসলামই। কোন আধুনিক, মধ্যকালীন বা প্রাচীন ইসলাম নেই। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম হলো ভূগোল আর ইসলাম ধর্ম। কিভাবে এ দুটির তুলনা চলে? আপনি পশ্চিমের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার বা দক্ষিণ এশিয়ার আলোচনা করতে পারেন। অথবা খৃষ্টধর্ম ও ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। পশ্চিম বনাম ইসলামের আলোচনার সঙ্গে একটি পূর্বধারণা জড়িত। যাতে রয়েছে আরও কিছু অন্তর্গত সূত্র। সূত্র অনুসারে, পশ্চিম হলো আলোকদীপ্তি, প্রগতি এবং আধুনিক, ভালত্বের প্রতিভূ। আর ইসলাম মানে, অন্ধকার, উগ্রতা এবং অসহিষ্ণু সকল কিছু।
একটি বর্বর ধর্ম হিসাবে ইসলামের পরিচয় ক্রসেডের কাল থেকেই বাহিত হয়ে আসছে। ডিসকোর্সটি থেকে একে কখনও আলাদা করে দেখা হয়নি।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৫-এর এশিয়ান এজ থেকে নেয়া।
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ