somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেলিম আল দীনের সাক্ষাৎকারের বাকী অংশ

১৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সময়
আমি প্রসঙ্গ ধরে খানিকটা অন্য দিকে গেলাম।
‘আমরা একটা সময়ে সাহিত্য চর্চা করছি আপনাদের সঙ্গে আমাদের সময়ের দূরত্ব প্রায় ২৫/৩০ বছর। আপনারা একটা বিশেষ সময়কে অতিক্রম করে এসেছেন, আপনাদের সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে সাহিত্য নাটক কবিতাকে নতুন স্থানে স্থাপন করতে হবে- এই প্রেরণা আপনাদের মধ্যে ছিল। একটা বিশেষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আপনারা এই স্থানে উপস্থিত হয়েছেন। আমাদের অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালিত্ব, নতুন দেশকে গড়া, নতুন দেশের শিল্প সাহিত্যকে গড়া ইত্যাদির যে তাড়না- সেটাও আমাদের মধ্যে নেই। এই জেনারেশন এবং আপনাদের জেনারেশন এ দুই জেনারেশনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো কেমন হয়?
‘আমার মনে হয় যে, আমাদের জেনারেশনেও প্রচুর অনড়তা আছে, ভ্রান্তি আছে। অজ্ঞতা প্রচুর আছে। আবার বৃহৎ একটা গণযুদ্ধে আমরা অংশগ্রহণ করেছিলাম বলে পৃথিবীকে দেখার, বোঝার এবং স্বদেশের মাটিকে অন্বেষণ করার স্পৃহা আমাদের ছিল। পৃথিবীর সেই রুদ্র মূর্তিটা আমরা দেখেছি, যখন আমাদের মায়েরা, বোনেরা ধর্ষিত হচ্ছিল, কন্যারা ধর্ষিত হচ্ছিল তখন পুজিবাদী দেশগুলো নির্বিকার। আমরা দেখেছি হাসতে হাসতে একটা বাচ্চা ছেলেকে পাথরের ওপর আছড়ে মারা হচ্ছে। কি করে একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি আনসাকসেসফুল স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের কথা বলবো, সেখানে ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা করলো, সে সময়ে স্পানিশ লিটারেচারে, ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে একটা তীব্র আলোড়ন এলো, যেমন নেরুদার একটি কাব্যগ্রন্থ বেরুলো মার্চেন্ট সোলজারদের জন্য কাগজের কারখানায় জুতা কাপড় যা ফেললো তা দিয়ে মণ্ড তৈরি হলো, কাগজে ছাপা হলো। মিগুয়েলের কথা বলতে পারি, সিভিল ওয়ারে সরাসরি অংশগ্রহণ করা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথা বলতে পারি, কল্ডওয়েলের কথা বলতে পারি। একটা নতুন জেনারেশন কিন্তু রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা বহু বছর পর আবার নতুন করে চর্চিত হলো নতুন পথ খুজে পেল। কিন্তু আমাদেরটা সাকসেসফুল যুদ্ধ, প্রচুর রক্তক্ষয় এবং প্রচুর মূল্য দিয়ে আমরা স্বাধীন ভূমি অর্জন করেছি। আমাদের ভেতরে বোধটা একটু আলাদা। আমার তো মনে হয় না যে, আমাদের এ কাজ দেখে তোমাদের মনে করা উচিত যে তোমাদের দায়িত্ব নেই। ভেবে দেখা দরকার যে, আত্মতৃপ্তির অবকাশ আছে কিনা। কবিতার ক্ষেত্রেও তো ভয়ানক একটা নৈরাজ্য চলছে আমি কলকাতার কথা বলবো না, কেননা সেখানে উত্থান-পতন পরিবর্তনের সম্ভাবনা আরো কম। আমাদের এখানে প্রতি মুহূর্তেই আমাদের রাজনৈতিক মেঘ যেমন রঙ বদলাচ্ছে, আমাদের সমুদ্র যে রকম নতুন করে ফুসে উঠছে আমাদের ভেবে দেখা দরকার যে, কোন পর্যায়ে লিটারেচারকে নতুন করে রিনোভেট করতে হয়। নতুন করে নির্মিতি কিভাবে হবে এবং তোমাদের কাজ হবে রিলে রেসের মতো। আমরা এতোদূর এগুলোম তোমরা এতোদূর। তোমাদের কবিতার দিকে তাকালে আমি হতোদ্যম হয়ে পড়ি- প্রথমত বোধ এবং বিষয়ের একটা আইকোনোকাস্টিক অবস্থা দেখতে পাই। এখনকার কবিতা পড়ে আমি ঠিক কনভিন্সড হই না। জীবনানন্দ, বিষ্ণুদের কবিতা পড়ে যে প্রচণ্ড মোহ এবং আবর্তের তৈরি হয় এখনকার কবিতা পড়ে ক্বচিৎ আমার সেটা হয়। মনে হচ্ছে যেন ওদের ভেতরে বলার একটা প্রচণ্ড তাগিদ আছে। কিন্তু ভেতরে সেই পরিমাণ আর্জ নাই, কবিতাকে একটা শিল্পরূপ দেয়ার যে শ্রম সেই জায়গাটায় তারা খাটতে রাজি নয়। অবশ্য সেটা নির্বিশেষ মন্তব্য নয়। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনাময় কবি-লেখক আছেন বিশেষ করে ছোট কাগজগুলোতে, অফ দি ওয়ে ম্যাগাজিনগুলোতে, এ পত্রিকাগুলোকে কেন্দ্র করে অনেক কবি-গদ্যকার উঠে আসার চেষ্টা করছেন। আমি এ কথা মনে করি না যে, একজন তরুণ কবি বা তোমাদের জেনারেশন খারাপ লিখলেই আমাদের সম্ভাবনা বেড়ে যায় বড় হওয়ার এ রকম কোনো নেগেশন কিন্তু শিল্পে নেই। বরং তোমরা ইয়াংরা যতো প্রচণ্ড বড় হবে আমাদের মূল্যায়নের ক্ষেত্র ততোটা স্পষ্ট হবে, আমাদের সঠিক মূল্যায়ন ইতিহাসে হবে। অন্ধকার যতো ঘনাবে ততোই অতীত আরো বেশি অন্ধকার হয়ে যাবে। আমরা এখন চলমান কিন্তু আমাদের জীবনের অধিকাংশ কাজ এখন অতীতের মধ্যে। বর্তমানে যেটুকু আছে সেটুকু আয়ুর জোরে; কলমের জোরে, কিন্তু তোমাদের ঘুরে দাড়াতে হবে একটা জায়গায়। সেটা হলো সৎভাবে খাটনি যেটা সেই খাটনিটা করতে হবে। আমি নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি, ‘কেরামত মঙ্গলের’র রাফ কপি দাড়িয়ে ছিল মোট পৌনে তিন হাজার পৃষ্ঠায়। অথচ নাটকটি ছিল দেড়শ পৃষ্ঠার। শকুন্তলা আমি লিখেছি আঠারবার। সব লেখকেরই তিন-চারটা যুগ থাকে লেখার প্রত্নপ্রস্তর যুগ, প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ তারপরে লৌহ যুগের লেখকের কবির ভাষাটা দাড়ায়। ইস্পাতের যুগে যে ঢুকতে পারবে সে অমর। মনে হয় আমি শকুন্তলায় ব্রোঞ্জ যুগে নিশ্চয়ই ছিলাম।’
‘কবিতার কথা যখন তুললেন এখানে আমি আপনার একটা কথা খুব ফিল করি সেটা হলো- অ্যাজ অ্যান আর্ট মিডিয়া কবিতা একটা ক্ষয়ীমান বিষয়। আমরা কবিতা লিখছি সেটা শুধুমাত্র আমি মাহবুব মোর্শেদ কবিতা লিখছি বিষয়টা এ রকম নয়। বিশ্ব কবিতার কিংবা বাংলা কবিতার ইতিহাসের মধ্যে বসে আমাকে লিখতে হচ্ছে। টোটাল বিষয়টা যখন আমি মাথায় রেখে লিখি- যে কোন আর্ট মিডিয়াতে কাজ করতে গিয়ে আমি তো চাই স্বকীয়তাকে তুলে আনতে। আমি আমার কথাটা কেন বলছি তার চেয়েও বড় কথা হলো আমি কিভাবে বলতে পারছি। কবিতার ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা আমার ধারণা আমাদের সবারই আছে। আমরা দেখছি, নাটকে আপনি যেসব নতুন নতুন কাজগুলো করছেন এখানে ফর্ম হয়তো খুব চেঞ্জ হচ্ছে না, দুই-তিনটা ফর্মে এটা আবর্তিত হচ্ছে। এটাও বড় একটা পাওয়া। কিন্তু আপনার সাফল্যের পেছনে আরো একটা কারণ আছে। সেটা হলো ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তন। হয়তো দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চলের একটা প্রেক্ষাপট আবার মানিকগঞ্জে আরেকটা প্রেক্ষাপট অথবা নোয়াখালীর একটা ঘটনা লিখছেন। পাশাপাশি এই যে আপনার মানুষের ভূমিরেখা ধরে আবর্তন এটা কিন্তু আপনার কাজকে বেশি নতুনত্ব দিয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে আমি সমস্যাটা বললাম যে সমস্যাটা আমি ফিল করি, আমাদের মুক্তিটা সম্ভবত কবিতায় আর নেই- আমি এটা ফিল করছি। সেটা হয়তো গদ্য অথবা অন্য কোনো আঙ্গিকে।
‘আসলে বিশ্বব্যাপী কবিতার ক্ষয় বা ধস নেমেছে। এটার কারণ কিন্তু পাশ্চাত্যের পুজিবাদী সভ্যতা। সে মানুষকে মানুষের জায়গায় আর তিষ্টোতে দিচ্ছে না। খুব হাস্যকর বিষয় এটাকে আমরা কমপিউটারের যুগ বলছি। তার মানে এখন মানুষ নেই। কমপিউটার ব্যবসায়ীদের বানানো কথায় যারা পা দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই খুব বোকামি করেছে। মানুষকে অবমূল্যায়ন করেছে। মানুষকে কেটে ছেটে কমপিউটারের মাপ দিয়ে দিয়েছে। পৃথিবী সব সময় মানুষের। কবিতার ক্ষেত্রে ইওরোপিয়ান চিত্তের বিকাশটা যখন এমন স্থানে পৌছালো, একটা লোক ফ্রম ডন টু ডাস্ক মানি আর্নিং-এর কাজে ব্যস্ত। জীবনের কতো ডাইভারসিফাইড পণ্যের সঙ্গে তার উৎপাদন সংশ্লিষ্টতা রয়ে গেছে। গ্যেটের আমলে সেটা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের আমলে এটা ছিল না। এই জায়গাগুলো নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে পণ্য সভ্যতা। দিচ্ছে বলে বিত্তের ভারে চিত্তের অভাব ঘটছে। বিত্ত মানে পণ্য সভ্যতা। ধরো একটা ঘড়ি কিনতে বেরুলে- ইউ হ্যাভ এভরি রাইট টু সি দি ইচ অ্যান্ড এভরি ওয়াচ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ঘড়ি দেখতে দেখতেই একটা জীবন তুমি কাটিয়ে দিতে পারো। একটা কাঠ পেন্সিলের এতো ভেরিয়েশশন পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে। পণ্য সভ্যতা তিলে তিলে মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে মানবীয় মূল্যবোধগুলোকে ছেটে সেখানে প্রোডাকশনের চিন্তাটাকে ভরে দেয়া হচ্ছে। আমার যে মেয়েটি যে কন্যাটি শত শত বছর আগে মসলিন বুনতো, একটা জাদুকরি মসলিন- কাপড়, বস্ত্র- সে এখন বিদেশিদের জন্য গার্মেন্ট সেলাই করছে। সেই হাত। মসলিন বুনতে বুনতে যেটুকু রূপকথা শুনতো তার সঙ্গে মসলিন বুনতে বুনতে সম্পর্কটা আরো নিকটতর হতো। এখন সেটি আর নেই। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে, প্রোডাকশন সংখ্যার সঙ্গে জড়িয়ে সে কিন্তু আর ভাবে না সেভাবে। কাজেই কবিতার স্থান সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য পৃথিবী দায়ী কবিতার কোনো দোষ নেই। এটাও ঠিক যে, পৃথিবীর সর্ব শিল্পেরই ক্ষয় আছে। কবিতারও ক্ষয় এসেছে। প্রথমত, ইওরোপে কবিতার যে আধুনিকতা-সে ইওরোপ এমন এক জায়গায় পৌছে গেছে সেখানে কবিতার কথা, চিত্তের কথা, মানুষের নানা ঐশ্বর্যের কথা ভাবা এটির প্রয়োজন সেখানে আর নেই। ফুরিয়ে আসছে। মানুষের তো অবসর লাগে অবসরটা কোথায় মানুষের? এটা উপন্যাসের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে না। নাটকের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে না। অ্যামেরিকানরা এখনো ৫ থেকে ৬ পারসেন্ট নাটক দেখে, অতো কোটি লোকের মধ্যে। জার্মানি, ইংল্যান্ডে আরো বেশি। আমার কথা হলো, কালের ক্ষয়ে কবিতা লোপ পাবে, নাটকও লোপ পাবে। নাটকও লোপ পেতে বসেছে। যে জন্য আঙ্গিককে আমি ঃৎধহংভড়ৎস করতে চাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী ডিরেক্টরের প্রবল দৌরাত্ম্যে নাটক এখন ডিরেক্টরের খেলার বিষয় হয়ে গেছে। ডিরেক্টর নিজেই শিল্পীর জায়গা দখল করে নিচ্ছে। সে জন্য আমাকে স্ক্রিপ্ট এর জায়গায় এতোটা স্ট্রং হতে হচ্ছে। উপন্যাসেও, ইওরোপে কি উপন্যাস লেখা হচ্ছে, ভালো? বিশাল, সাংঘাতিক মহৎ কিছু। ল্যাটিন আমেরিকায় সেটা হচ্ছে।
‘কুন্ডেরা লিখছেন, উমবের্তো একো লিখছেন।’ বললেন রাইন।
‘লিখছেন। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার মতো এতো বিশাল এতো ব্যাপ্তি সেখানে নেই। আফ্রিকান উপন্যাসেও এই বিশালত্ব আমরা দেখি। কবিতার আধুনিকতার জন্ম যেখানে সেখানটা রুদ্ধ হয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, কালের ক্ষয় লেগেছে। আমি মনে করি যে, কবিতার মৃত্যু নেই। সে অন্য কর্মে টিকে থাকবে। এখন যদি কেউ কবিতার আকারে একটা বৃহৎ উপন্যাস লেখে, তাতে উপন্যাসের কোনো ক্ষতি হবে না। কবিতার লাভ হবে।’
‘প্রিন্টিং মিডিয়ার অস্তিত্বই তো সামনে আর থাকছে না। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে প্রবেশ করছি আমরা।’ বললেন রাইন।
‘যখন টেলিভিশন বেরুলো তখন সকলে ভাবলো চলচ্চিত্র আর থাকছে না। এখন দেখা যাচ্ছে চলচ্চিত্রই শিল্প মাধ্যম। ৫০/৬০ বছরে টেলিভিশন সেখানে পৌছাতে পারেনি। কাজেই কমপিউটার যতো দৌরাত্ম্য করুক, মানুষই সেই শক্তি যে এটার বিরুদ্ধে দাড়াবে। মানুষ যখন দেখবে সে নিজেকে হত্যা করছে। শিল্পের স্থান যতো সঙ্কীর্ণ হবে এ পৃথিবীতে মানুষের স্থানও ততো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
সেলিম আলম দীন বললেন, পণ্য সভ্যতার বিরুদ্ধে দাড়াতে হবে ব্যক্তিকেই নিজের নিজের জায়গা থেকে। এই স্পন্দন প্রথমে ব্যক্তির মধ্যে জাগবে পরে ব্যক্তি এটা সমষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে দেবে। ইনডিভিজুয়ালের প্রতিবাদটা ইউনিফায়েড প্রতিবাদে পরিণত হবে। তিনি বললেন, এই প্রতিবাদের ধরনটা কেমন হবে সেটা কারো পক্ষে নির্ধারণ করে দেয়া উচিত নয়। পণ্য সভ্যতার পাশাপাশি যে শিশ্ন সভ্যতার বিকাশ এ সম্বন্ধেও বললেন তিনি। শেষ পর্যন্ত মানুষই এর বিরুদ্ধে দাড়াবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।

মৃত্যু
সাক্ষাৎকারে লেখকের মৃত্যুবোধ প্রসঙ্গে কথা ওঠে। সে প্রসঙ্গেই আমি বললাম, ‘আমরা কামনা করি আপনি একশ’ বছর বাচুন। কিন্তু জীবন প্রতি মুহূর্তেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষয় অর্থাৎ মৃত্যু বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
‘মৃত্যু বিষয়টা নিয়ে আগে খুব ভাবতাম এখন আর ভাবি না। বিশেষ করে ‘হরগজ’ লেখার পর আমার মনে হয় এ বিষয়ে আমার বলা হয়ে গেছে। ‘হরগজ’ অনেকটা আত্মজৈবনিকও বটে। ওর ভেতরে আমার নিজস্ব মৃত্যুভাবনাও আছে। মৃত্যু বিষয়টা আমাদের তাড়িত করে বলেই আমরা লিখছি, কাজ করছি। অনুপ্রাণিত হচ্ছি। তুমি যখন আমাকে দেখছ, সেলিম আল দীন বিশ বছর বাচবেন ম্যাক্সিমাম। তারপর তো তার সঙ্গে এই আড্ডাটা আর হচ্ছে না। আমি যদি অনন্তকাল বেচে থাকতাম তবে তোমরা আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসতে না। আমাদের সমস্ত কাজকেই নির্ধারণ করে দিয়েছে মৃত্যু। অমরত্বের আকাক্সক্ষা তীব্র হয়ে মৃত্যুভয় লেখককে লেখক করে। এই দুটো থেকে লেখক তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন শেষের দিকে বলেন- শিশুকাল থেকে প্রত্যেক মুহূর্তে আমি মৃত্যুভয়ে থেকেছি।
‘যারা আত্মহত্যা করে তারা মৃত্যুকে এক হাত দেখে নেয়ার চেষ্টা করে?’ বললেন রাইন।
‘হ্যা, তারা মৃত্যুকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ করে। এটা এক ধরনের বোকামিও বটে। এ জন্য যে, তুমি না মরলেও তুমি এমনি মরবে। তুমি ভাবো যে, রবীন্দ্রনাথ আত্মহত্যা করেছেন, মৃত্যুভয়ে। তাহলে আমাদের মৃত্যুটা কতো কঠিন হয়ে যায়। আমরা দেখছি মৃত্যুর মুহূর্তে এক অসীম ধৈর্যের মধ্য দিয়ে তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। গ্যেটের মৃত্যুও তাই। আমাদের প্রফেটের মৃত্যুও তাই।’
‘লালন সাই’র মৃত্যুও।’ যোগ করলেন সাইমন।
‘আমাদের এখানে বেচে থাকাই যেখানে সবচেয়ে কঠিন, সেখানে আত্মহত্যা করা অর্থহীন।’ রাইন বললেন।
‘হ্যা, রাইন চমৎকার বলেছো।’
‘লেখক জীবনের শুরুতে আপনিও আত্মহত্যা করতে গিয়েছেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘এটা সম্পূর্ণ সত্য। এটা আমি চেষ্টা করি ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে। পরে আমার কাছে মনে হলো, আমি আর কয়টা দিন বেচে লিখে দেখি না। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাও একই রকম অ্যাটেমপ্ট নিয়েছিলেন। হয় গান শিখবেন, নইলে আত্মহত্যা করবেন’। ‘আবার যখন টলস্টয়, গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথের মানসিক প্রস্তুতি দেখি তাতে মনে হয় সম্মুখে শান্তির পারাবার। টলস্টয় তো বলেছেন, কে বললো যে মৃত্যু কষ্টের। মৃত্যু তো সুখেরও হতে পারে’।
‘তখন কি আপনার আত্মহত্যার বাসনা জেগেছিল এই কারণেই যে লিখতে পারছিলেন না?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘না আমার কাছে মনে হচ্ছিল যে আমি খুব বড় লেখক বোধহয় হতে পারবো না। বিশাল কিছু হতে পারবো না। আমি অষ্টম শ্রেণীতেই শান্তি নিকেতনে পালাতে চেয়েছিলাম। নবম-দশম শ্রেণীতে রবীন্দ্রনাথের মেজর লেখা আমি পড়ে ফেলেছি। গ্রামে বসে। ফলে জীবন সম্পর্কে, শিল্পকৃতি সম্পর্কে আমার যে কৈশোরক ধারণা- যৌবনের শুরুতে সেটা তুঙ্গে পৌছেছিল। আমি দেখলাম আমি এটার একেবারেই উপযুক্ত না। তখন থিয়েটার আমাকে বাচিয়েছে। নাটক আমাকে বাচিয়েছে। ধীরে ধীরে আমি দেখলাম নাটক আমার অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতো। অর্থাৎ আমি জীবন সম্পর্কে যা বলতে চাই সবই বলা যায় নাটকের মধ্য দিয়ে। আমার আঙ্গিকে বলা যায়।
‘সফলতা আপনাকে বাচিয়ে দিল?’ বললাম আবার।
‘সফলতা আসলে কি? সফলতা সম্পর্কে জীবনানন্দের একটা কথা আছে। সফলতা কি আসলে সফলতা? এটা হয়তো এই জন্য যে, আঙ্গিকের দিক থেকে আমি আমার দেশের মানুষকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়ে কিছুটা হয়তো সফল হয়েছি। সেটাকে আমি ভাবছি সফলতা। কিন্তু আমার লেখা সফল নাও তো হতে পারে। সময় কোনগুলো নেবে না নেবে। রুক্নবর্ণে তো সে কথাই বলা হলো যে, আমার অমরত্বের আকাঙ্ক্ষাটাকে আমি খুব ঘৃণার সঙ্গে দেখি। খুব উপহাস করেছি নিজেকে।’ বললেন সেলিম আল দীন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ দুপুর ২:৫১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×