somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙলা কবিতা ও দশক বিভাজন-১

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
আধুনিক বাঙলা কবিতার দশক-ভিত্তিক আলোচনা বা আঙ্গিকগত বিভাজন, সাহিত্য সমালোচনায় যে এক বিশেষ ধারা সৃষ্টি করে নিয়েছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের কোলে লালিত যে তিরিশের কবিতায় ব্যক্তি তার জাগ্রতসত্ত্বার উপলব্ধিবোধকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করেছিল সেই তিরিশের কবিতাও আধুনিকতা নামক বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হয়েছিল দশক হিশেবে। তাই আমরা যখনই আধুনিক কবিতার আঙ্গিক বা ভাবগত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করি স্বাভাবিকভাবেই দশক-ভিত্তিক চিন্তা বা এর বিভাজন আমাদের লীলা-চৈতন্যে মুখ্য হয়ে ওঠে। দশক বিভাজনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কিংবা এর ভাব বা রূপগত চিন্তা কবিতার ক্ষেত্রে কতটা ফলপ্রসূ অথবা কবিতার মৌলিক ভাব নির্ণয়ে দশক বিভাজন কতোটা সঠিক -সে প্রশ্নে আমরা যাচ্ছি না। তবে দশক-ভিত্তিক চিন্তা চেতনা কবিতা সমালোচনার ক্ষেত্রে যে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে, সে বিষয়েও আমরা সন্দেহ করি না। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ বিংশ শতকের শুরুর দিকে কবিতা যেমন তার প্রবাহিত স্রোতের গতি পরিবর্তন করেছে, হয়তবা আধুনিকতার প্রভাবে সে স্রোতের গতিতে দশক-ভিত্তিক সমালোচনা কবিতার রূপ বা মান বিচারে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সেটা অস্বাভাবিক নয়। বরং কবিতার বোধ উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে আর আধুনিকতার প্রভাবে এটি ঘটে স্বাভাবিকভাবে।

বিংশ শতকের শুরু থেকেই কবিতার রূপ, ছন্দ এমনকি ভাবের যে বিবর্তন ঘটে তড়িৎ গতিতে, তাতে প্রতিটি দশকের কবিতাকে এনে দিচ্ছিল নতুন নতুন রূপ ও আঙ্গিক নির্মাণের নানান কৌশল। একদিকে যেমন কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তিত হচ্ছিল খুব দ্রুত গতিতে, অন্যদিকে এর প্রভাবে প্রতিটি দশকের শুরুতে ভাব প্রকাশের মধ্যেও উঁকি দিচ্ছিল অন্য এক স্বতন্ত্র রূপ। এই আলাদা রূপ বাঙলা কবিতার ভাষার ক্ষেত্রে যেমন বৈচিত্র্য এনে দিয়েছিল, তেমনি কবিতার প্রচলিত বিষয়-বস্তুকে অনেকটা পালটে দিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের মতো পাশ্চাত্য থেকে আগত আধুনিক নামক মতবাদের নানা উপকরণকে হাজির করলো নতুন মোড়কে। তাই বাঙলা কবিতায় দশক বিভাজনের আলোচনা করতে গেলে আধুনিকতার কয়েকটা রূপ লক্ষণীয় বা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতা নামক ধারা বিশেষ কতগুলো চিন্তা-চেতনা বহন করছিল, তবুও ভাষা, শব্দ-কৌশল, ছন্দ বা অলংকারের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। আধুনিকতার প্রশ্নে তিরিশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশক পর্যন্ত কবিতাকে আধুনিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ বলা হলেও, এই কবিতাগুলোয় ভাবের প্রকাশ আর শিল্পের বিকাশ একইভাবে ঘটেনি। প্রায় প্রতিটি দশকের কবিতা যেন এর আলাদা স্বতন্ত্র রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল সাহিত্যে। তাই আমরা লক্ষ্য করি, তিরিশের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম চল্লিশের কবিতা।
ভাবগত দিক থেকে চল্লিশের কবিতা ছিল পূর্বপর তিরিশ আর পরবর্তী পঞ্চাশ বা ষাটের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। শুধু কবিতার রূপ বা ভাবগত দিক থেকেই যে ভিন্ন তা নয়; এই দশকের প্রধান কবিদের ব্যক্তিগত আদর্শ, কবিতার ভাব বা আঙ্গিকগত চিন্তা-চেতনা ছিল অন্যদের থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র। বলা যায়, আদর্শভিত্তিক সৃষ্টিকর্মের এক সচেতন প্রয়াস ছিলো চল্লিশের কবিতা।

বাঙলা কবিতায় তিরিশের পর সবচে প্রভাব বিস্তারকারী দশক হিশেবে পঞ্চাশের কবিতাকে বিবেচনা করা হয়। আঙ্গিক বা ভাবগত দিক থেকে তিরিশের সঙ্গে এর মিল থাকলেও কবিতার ভাষা ছিল কিছুটা আলাদা। চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের কবিতায় ভাষার সরলতা ও প্রকাশ ভঙ্গিমায় সামান্য তারতম্য হলেও, বিষয়বস্তুর দিক থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ অনেকটা প্রভাবিত করেছিল পঞ্চাশের কবিদের। একদিকে সাতচল্লিশের দেশ ভাগ এবং পরপর কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেমন সামাজিক মানবিকতাকে আঘাত করেছিল প্রচণ্ডভাবে, অন্যদিকে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও রাজনৈতিক পরিবেশ পঞ্চাশের কবিতার বিষয়বস্তুকে অনেকটা পালটে দিলো। এছাড়া কাঠামোগত দিক থেকে মোহিতলাল মজুমদারের পরবর্তী সময়ে ১৮মাত্রা সনেটের আঙ্গিক নির্মাণে ক্ষেত্রেও এই দশকের কবিরা নতুনত্ব দেখিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের চিত্র ও গ্রামীণ আবহ নির্মাণ করতে গিয়েও আঞ্চলিক ভাষা ও শব্দের একটা মিশ্র উপাদান হাজির হয়েছিল এই দশকের কবিতায়।

তিরিশ আর পঞ্চাশের এক মিশ্রণ ঘটে ষাটের কবিতায়। বিষয়-বস্তুর দিক থেকে ষাটের কবিতা যতোটা না প্রেমের মূর্ছনা ছড়িয়েছে তার চেয়ে বেশি ছড়িয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক মুক্তির অগ্নিদগ্ধ বাণী। জাগ্রত হৃদয়ই যে ব্যক্তির মুক্তির শাশ্বত পথ নির্ধারণ করে বা অঙ্কন করে ভবিষ্যৎ মানচিত্র, সে ধারণাকে নতুন রূপে তুলে ধরেন ষাটের কবিরা। হৃদয়ের মুক্তির জন্য তারা যেমন একদিকে প্রকৃতিকে বেছে নিয়েছেন, অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের মতো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও শাণিত করে তুলেছিল। তবে ষাটের দশকে নৈরাশ্যবাদের আবছা ভাব প্রতিফলিত হয়েছে কবিতায়, যা ষাটের প্রধান কবিদের কিছুটা হলেও দ্বান্ধিকতায় ভাবিত করেছে।

বলা যায়, বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের মতো যে উপকরণগুলো কবিতায় হাজির হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে, তিরিশে অলৌকিকতার মতো হঠাৎ করেই সেটি নাজিল হয়নি বাঙলা কবিতায়। এর ভ্রূণ সৃষ্টি হয়েছিল তারও শতবছর পূর্বে হিন্দু কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অনুরাগী কিছু ছাত্রের হাতে। প্রথম দিকে ধর্মীয় পরিচয়ে তারা প্রত্যেকে ছিলেন উচ্চবর্ণীয় হিন্দু। পাশ্চাত্যের মানবিকতা, যুক্তিবাদ, উদারনৈতিকতা, সংশয়বাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের যে উপলব্ধি ইংরেজি শিক্ষার ফলে জাগ্রত হলো তাদের মনে, তাতে অনেকেই প্রচলিত ধর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করলেন। সংশয় ও যুক্তির আলোকে ধর্মকে নতুন করে দেখার প্রয়াস পেলেন, যা প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো। কেউ কেউ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম বা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেন। এমনকি মদ্যপান করা, হোটেলে গিয়ে নিষিদ্ধ খাদ্য খাওয়া, ইউরোপীয় পোশাক পরা, ইউরোপীয় জীবনযাত্রার অনুকরণ তাদের ফ্যাশনে পরিণত হলো। পাশ্চাত্য সেক্যুলার শিক্ষার ফলে তাদের চিন্তা ও মূল্যবোধের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটলো, তার প্রভাব অনেকটাই পড়লো বিংশ শতকের কবিতায়। উনিশ শতকে চলতে থাকা এই ধর্ম সংস্কারের আন্দোলনগুলো বাঙলা কবিতাকে যেমন একদিকে প্রভাবিত করেছে, অন্যদিকে উদারনৈতিকতা, যুক্তিবাদ, মানবতা, সংশয়বাদের মতো আধুনিক উপাদানগুলো কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে শিল্প নামক বস্তুর মোড়কে।


সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:১৪
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×