চৈত্র মাসের ভয়ানক খরা আর প্রচণ্ড দাবদাহ তখন। মাঠঘাঠ, উঠোন ফেটে চৌচির। নদী শুকিয়ে মরুভূমি, খালবিল মরে শাপের মতো শুয়ে আছে। বৃষ্টি বিহনে এ যেন প্রকৃতির হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। চারিদিকে বৃষ্টির জন্য গগনবিদারী চিৎকার, প্রার্থনা আর আহাজারি। এমন শোকের মাতম উপলব্ধি করার চেষ্টাটাও যন্ত্রণার। মসজিদে, মসজিদে আল্লাহর কাছে মোনাজাত, শুধু বৃষ্টির জন্য।
এমনই রুক্ষ প্রকৃতির ভয়ঙ্কর সেই রূপে যখন অস্থির আর পাগল প্রায় সবাই ঠিক তখনই ছেলেটির জন্ম। গর্ভবতী মাকে সেই প্রকৃতির বিরুদ্ধতার মাঝে ভয়ানক কষ্ট দিয়ে জন্ম ছেলেটির। নাড়িছেঁড়া ধনের মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে অবশ্য মায়ের আর কোন কষ্টের কথাই মনে থাকেনি। ফুটফুটে দুধের মত ছেলেটি ভূমিষ্ঠ হয়ে যখন প্রথম কেঁদে উঠে তখন নানাজনে নানাকথা বলেছিলো বাইরে।
কেউ বলছে ছেলেটি একটা বিশ্রী সময়ে দুনিয়ায় এসেছে, ভালো হবেনা। কেউ বলেছে একটা অপয়া, না হলেকি এমন অভাব, অনটন এর মাঝে দুনিয়ায় আসে?
ছেলেটির বাবা মা আর ঘরের মানুষেরা তখন ভুলে গেছে কি অবস্থায় দিন কাটছে তাদের কিংবা কিভাবে এই অতিষ্ঠ গরমে নিশ্বাস নেবে শিশুটি? তারা শুধু একে অন্যের কোল থেকে কোলে স্থানান্তরিত করছিলো আর নবজাতকের নিষ্পাপ চেহারার মায়ায় মেতেছিলো তখন। শিশুটি যেন তাদের বৃষ্টির কথা ভুলিয়ে দিলো ক্ষণিকের জন্য।
ঠিক সেই সময়টায় ঘটে গেলো অবিশ্বাস্য আর ভেলকিবাজির মতো এক কাণ্ড! আকাশের বুক চৌচির করে হলো ভয়ানক এক বজ্রপাত। বিষ্ময়ে সবাই স্তম্ভিত তখন। কয়েকটা মুহূর্ত নির্বাক, অচল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঘরে বাইরে যে যেখানে ছিলো। তারপর সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো সবাই।
বৃষ্টি হবেরে, বৃষ্টি হবে এই আনন্দধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো চারপাশ। প্রকৃতি হয়তো নিষ্পাপ নবজাতকের উদ্দেশ্যে দেয়া অপবাদ সহ্য করতে পারেনি কিংবা বৃষ্টির এতদিনের অভিমান শেষ হয়েছে প্রকৃতির সাথে তাই ফিরে আসছে।
নবজাতকটি মায়ের পাশে বিছানায় ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে চারিদিকে। বিধাতাই বলতে পারবেন সে কিছু বুঝতে পারছিলো কি না।
এরপরই শুরু প্রকৃতির সুমধুর সে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন রিমঝিম সুর। যে সুরের ঝংকার আলোড়িত করে তুললো ঘরে বাইরে প্রতিটা কোন। প্রকৃতি তখন অমিয় সুধার মতো বৃষ্টিকে বুকে টেনে নিচ্ছে। প্রকৃতি আর বৃষ্টির এ ভালোবাসা সৃষ্টির সে শুরু থেকেই ছিলো, হয়তো অভিমান কিছুদিনের জন্য বিচ্ছেদ ঘটিছিয়েছিলো হয়তো তাদের।
বৃষ্টির শীতলতা অশান্ত প্রকৃতিকে শান্ত করেছিলো বহুদিন পরে। পিপাসায় কাতর চাতকের তৃষ্ণা মিটিয়েছিলো, অবসান ঘটিয়েছিলো অধীর অপেক্ষার অন্যদিকে অনিশ্চিয়তার মাঝে পৃথিবীর আলোয় আসা, অপবাদগ্রস্ত শিশুটিকেও বসিয়ে দিয়েছিলো দেবদূতের আসনে। শিশুটিকে, তার মা বাবাকে তখন সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিলো। মুহূর্ত আগেই যে পেয়েছিলো অপবাদ সেই এখন তাদের কাছ থেকে পাচ্ছে আশীর্বাদ আর বড় বড় ভবিষ্যতবাণী।
যাকে নিয়ে এতকিছু সে তখনো ফ্যালফ্যল করে তাকাচ্ছে আর একটু পর পরই মায়ের মুখে সে চাহনি স্থির হচ্ছে। মা, বাবা তখনো মুগ্ধ হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে নবজাতকের নিষ্পাপ সৌন্দর্য অবলোকন করছেন।
আজ বহুবছর পর ছেলেটির আরেকটি জন্মতারিখ। এভাবে দুই যুগ বসন্ত পার করে এসেছে সে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, যে বৃষ্টি তার জন্মশত্রু এখন। আকাশের কালো মেঘ দেখেই সে বৃষ্টির আগমনের কথা ভেবে দাতমুখ খিচিয়ে বৃষ্টিকে গালি দেয়। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ অসহ্য মনে হয় তার, তাড়াহুড়ো করে জানালার কাচঁটা টেনে দিয়ে পর্দা ছড়িয়ে দিলো সে। এখন ভাল্লাগছে, বৃষ্টির শব্দ কিংবা দৃশ্য সবই এখন আড়ালে। সিগ্রেটের প্যাকেট টা হাতে নিলো ছেলেটা, টেবিলের উপর গরম চায়ের কাপ থেকে ধোয়া উড়ছে। সামান্য সময়ের জন্য সে এখন হারিয়ে যাবে তার দুই প্রিয় এবং দীর্ঘস্থায়ী সঙ্গীদের সাথে। অনেক প্রিয় জন এসেছে গেছে, যায়নি এই চা আর সিগ্রেট। মৃত্যুর আগে যাবার সম্ভাবনাও নেই।