somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুমের স্বপ্ন পূর্ণ হলো

২৫ শে নভেম্বর, ২০১১ সকাল ৮:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে একটা সিট পাওয়া যে কত কষ্টের তা ভুক্তভোগি মাত্রই জানেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে এই সংকট সবচেয়ে প্রকট। এই হলের একজন আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে আমার নিজের সিট পাওয়ার কাহিনীটাই বলার প্রয়াস চালাচ্ছি।

২০০৬-২০০৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মতই ভর্তি কার্যক্রমের সময় আমাকে জানানো হলো আমি এসএম হলে এটাচ। তৎক্ষনাৎ হলে আসলাম। দেখেতো আমি অবাক, কারণ এসএম হল এমন একটা হল যে কাউকে এর সৌন্দর্য, স্থাপত্য-নকশা মোহিত করবে। আমার কাছে আনন্দ আরেকটু বেশি, যেহেতু এই হলেই আমি থাকবো।

ভর্তি কার্যক্রম শেষ। আমাদের ক্লাস শুরু হবে। হলে উঠবো কখন এই নিয়ে টেনশনে আছি। সমস্যাটা হলো তখনও আমার পরিচিত কেউ নেই। আগে শুনতাম বড়ভাই থাকলে হলে ওঠা সহজ। ক্লাস হচ্ছে। ইতিমধ্যে জানলাম আমাদের বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে উঠেছে। কিভাবে উঠলো, কোথায় থাকে এসব জানিনা। একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, সে উঠেছে। বললো আমরা আছি তুই আজকে রাতে জিনিস পত্র নিয়ে চলে আয়। আমি তো আনন্দে আতœহারা।
বলে নিচ্ছি, তখন ছিলো ফখরুদ্দিনের আমল, তত্তাবধায়ক সরকার ২০০৭ এর শেষ দিক, ফলে তখন রাজনীতি ঠান্ডা। এখন যেমন যে দল ক্ষমতায় তারা ছাত্র ওঠাতো , ওই সময় আমি সেটা দেখিনি। ছাত্রদল-ছাত্রলীগ সবাই নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত, রাজনীতি করার সাহস ছিলো না। তো ওইদিন রাতে বালিশ, মশারি, কাঁথাসহ একটা ব্যাগ নিয়ে আসলাম। তখনও বলাচলে সন্ধ্যা। প্রথম বর্ষের ছাত্রের সঙ্গে ঘুরছি। দেখলাম এরা টিভি দেখে, ঘুরে ফিরে সময় কাটাচ্ছে। হলে কোনো বড়ভাই নেই, কারও রুমে দেখার জন্য ঢুকারও সাহস পাচ্ছি না।
যাহোক রাত প্রায় এগারোটা বাজবে। এবার ঘুমের পালা। জানি না কোথায় ঘুমাবো। ছেলেটা আমাকে কিছুই বলেনি। তবে আামার ব্যগটা একটা রুমের পাশে রাখলাম। খুব সম্ভবত: ১৫৬ নং রুম। ছেলেটা আমাকে বললো, মাহফুজ চল ঘুমাবো। বললাম কোথায়। বললো ব্যাগটা নিয়ে আয়, দেখাচ্ছি। তার পিছু পিছু হাটলাম। দেখলাম সে আমাকে একটা রুমের পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। স্বভাবসুলভ কিছুই বলিনি।
হঠাৎ থামলো, বললো ব্যাগটা এখানে রাখ। রাখলাম। বললো এখানেই ঘুমাবো। দোতলায় রুমটা ১৬৮ হবে, তার পেছনে। বললো এখানেই ঘুমাতে হবে। কেন? প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বারান্দা ছাড়া কোনো রুম নেই। খুবই অবাক হলাম। কষ্টও পেলাম। কি আর করবো, আজতো ঘুমাতেই হবে। সে আর আমি একই মশারির নিচে বিছানা করে শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। খুবই কষ্ট হচ্ছিলো, পাকার ওপর ঘুমাচ্ছি বলে নয়, বারান্দায় বলে, মানসিক কষ্ট। এই কষ্টটা বেশি হওয়ার কারণটা হলো বড়ভাইরা রুমে ঘুমাচ্ছে আর আমরা বারান্দায়।
ঘুম যে খারাপ হয়েছে তা বলবো না। কিন্তু মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি হেরে গেলাম। বিশেষ করে যখন জানলাম, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এভাবে ন্যুনতম একবছর বারান্দায় থাকতে হবে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, না এভাবে হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম এত যুদ্ধ করে, এখানকার শিক্ষার্থী হয়েও এভাবে বরান্দায় কিভাবে থাকবো। ফলে পরদিন ভোরে উঠেই চলে গেলাম। যদিও ওই ভোরেই দেখলাম আমার মত এরকম আরও ২৫ জনের মত বারান্দায় ঘুমাচ্ছে।
ওই দিন চলে আসা মানে এসএম হলে সিটের স্বপ্নের দৌড়ে একধাপ পিছিয়ে গেলাম। তবুও মনে মনে হলে ওঠার পরিকল্পনা করছি। প্রথম কাজ আমাদের এলাকার বড়ভাই খুঁজে বের করা। দু’একজন পেলাম। তারা যা বললো সেটাও হতাশ করা কথা- ‘হলে রুম পেতে বারান্দায় থাকা ছাড়া গতি নেই’। এদিকে প্রথম বর্ষে যারা আছে তারা দেখলাম এখনও বারান্দায়। এভাবে একবছর পেরিয়ে গেলো কিছুই করতে পালাম না। দ্বিতীয় বর্ষে উঠলাম।
সামনে নির্বাচন, ২৮ ডিসেম্বর ২০০৮, অনেক দিনের বন্ধে বাড়ি আছি। ঢাকায় ফিরলাম নির্বাচনের পরে। আওয়মীলীগ জিতলো। এর আগেই আমাদের এলাকার ছাত্রলীগের এক নেতার নাম্বার পেলাম, তারেক ভাই। ঢাকায় এসে শুনলাম ছাত্রদলের সবাই হল থেকে চলে গেছে, ছাত্রলীগ হল দখল করেছে। ফলে আমাদের বর্ষের সবাই তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রুমে সিট পেয়ে গেছে।
এবার তারেক ভাইকে ফোন দিলাম। ভাই দেখা করতে বললো। করলাম। ভাইয়ের সঙ্গে কয়েকদিন ঘুরলাম, কয়েকটা প্রোগ্রামেও যোগ দিলাম। কিন্তু, সিটের কিছু হচ্ছেনা। ভাই আশ্বাস দিচ্ছেন। জানলাম, ভাই একটা রুম নিয়েছেন। ১৫৯ নং রুম। রুম নিয়েছেন মানে। তার রুমে আগে যারা ছিলো তাদের মধ্যে তিনি এবং আরও দুইজন আছে। অন্যরা বের হয়ে গেছে সরকার পরিবর্তনে। এসএম হলে স্বাভাবিক রুমে চারটা খাট থাকে চারকোনায় প্রত্যেকটায় দু’জন করে মোট আটজন এক রুমে থাকে।
দেখলাম তারেক ভাই তার রুমে আরও দুইটা খাট ঢুকিয়েছে, সেখানে আমাদের বর্ষের ছয়জন উঠেছে। আমার উঠার জায়গা নাই। ভাই বললেন, অপেক্ষা কর আরেকটা রুম পাবো। সে আর হলো না। এভাবে কেটে গেছে পাঁচ মাস। জুনের দিকে বিশ্বকিদ্যালয় একমাস বন্ধ। ভাইয়ের রুমে আসলাম। ভাই বললো এখন থাকতে পারিস। ক’দিনের জন্য, যারা বাড়িতে আছে তাদের বেডে থাকলাম। একমাস ভালোই থাকলাম। কারণ সবাই আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয় খুললো। সবাই আসলো।
কোথায় ঘুমাবো? এমনিতেই এক বেডে দু’জন করে। ফলে এমন অনেক দিন গেছে, ছোট্ট বেডে আমরা তিনজন থেকেছি। কোনো দিন মশার কামড় খেয়ে আমি নিচে ঘুমিয়েছি। তবুও হল আর ছাড়া যাবেনা। কারন, পরে সিট পাওয়ার আর চান্স নাই, এসময়টা পার করতে রুমমেটদের সাহায্য ছিলো। আটজনের রুমে বারোজন আছি। খাট চারটার জায়গায় ছয়টা। এমন কষ্টের মধ্যে এক বড় ভাইকে, একটা সমস্যার কারণে তারেক ভাই রুম থেকে বের করে দিয়েছেন। এবার দুশ্চিন্তা কিছুটা কমলো। ছয়টা সিটে এগারোজন ঘুমাচ্ছি। তারেক ভাই একা এক বেড থাকতেন। ছয়মাস এখানে শেষ। অর্থাৎ আমার দ্বিতীয় বর্ষ শেষ। তৃতীয় বর্ষে। দেখলাম এভাবে হলে থেকেও বেশ শান্তি পাচ্ছি। আশ্চর্য হলাম, যারা বারান্দায় থাকে তাদের অবস্থা দেখে। তাদের সংখ্যাটা একশ তো হবেই। কিন্তু, অসন্তোষ নাই। বুঝলাম হলের বারান্দায় থাকা মানেই হলে থাকা। আর হলে থাকার মজাই আলাদা। কষ্ট করে থাকলেও লেখালেখি কিছুটা চালিয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা লেখালেখির বিষয়ে আরেকদিন লিখবো।
তৃতীয় বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে রুমমেট এক বড় ভাই সিঙ্গেল রুমে সিট পেলেন, আর এর আগেই আমাদের বর্ষের একজন রুম ছেড়ে চলে গেছে তার টিউশনি, প্রাইভেটসহ অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে। এবার রুমের বেড একটা কমলো। পাঁচ বেডে আমরা নয়জন। তারেক ভাই একটাতে, আমরা আটজন চারটাতে। আরেকটু শান্তি হলো তবুও পুর্ণাঙ্গ রুম কিন্তু এখনও হয় নি।
সে স্বপ্ন পুরণ হলো ২৪ নভেম্বর ২০১১। ইতিমধ্যে অনার্স শেষ করে ফেলেছি। মাস্টার্সও শুরু হয়ে গেছে। তার আগের খবর হলো তারেক ভাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন, ভাইয়ের পুরো নাম- হাসানুজ্জামান তারেক। ১৩ নভেম্বর ছাত্রলীগের ২২০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষনা হয়। এতদিন ভাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, এখন হলেন কেন্দ্রিয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ভাই পদ পেয়েই সিঙ্গেল রুমে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তারেক ভাই রুম ছাড়লেন ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যা পোনে সাতটায়। রুমবাসি সবাই তাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য অনেক দিন থেকেই জল্পনা কল্পনা করছে। তার নামে হলের সামনে ব্যানার দেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে, এছাড়া তাকে দাওয়াত দিয়ে খাইয়ে ক্রেস্ট দেয়ারও কথা রয়েছে। জানিন না সবাই যা করে আছি, যেকোনো কাজে পেছনের সারিতে আমার স্থান, টাকা লাগলে দিই, কিন্তু উদ্যোগের যথেষ্ট শৈথিল্যতা আছে।
যাহোক, তারেক ভাই- আপনার প্রতি আমি আজীবনের জন্য ভীষণ কৃতজ্ঞ, আপনি আমার এসএম হলে একটা রুমের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন। আপনি রুম ছেড়ে চলে গেছেন। আপনাকে আমি কখনোই ভুলবো না। আপনার প্রতি আমি অন্যায় করেছি, তেমন কোনো কাজ করে দিতে পারিনি। আমার স্বভাবজাত কারণে আপনার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলিনি। আমি জানি আপনি আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন।
আরও লিখতে কষ্ট হচ্ছে, আমার গলাটা ধরে আসছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তারেক ভাই আপনি ভালো থাকবেন।


ব্যক্তিগত সাইট হতে দেখতে পারেন
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×