আমি জানতাম না আমার বাবা কে? আমার মায়ের কাছেই আমি মানুষ হয়েছি। মা আমাকে আদর যত্ন করে মানুষ করেছেন। তিনি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। এত পরিশ্রমের পরও মা আমার সমস্ত অন্যায় আবদার মেনে নিতেন। কিছু বলতেন না। নিজে না খেয়ে আমার জন্য খাবার রেখে দিতেন।
মা বলেছেন বাবা আমার রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। জন্মের আগেই। এরকম একটা কপাল নিয়েই আমার জন্ম হয়েছিল। জীবনে কখনই আমি বাবা বলে ডাকতে পারিনি।
স্কুলে আমি প্রায়ই মারামারি করতাম। অভিযোগ যেত বাড়িতে। মা আমাকে পেটাতেন সবার সামনে যাতে অন্যরা আমার কোন ক্ষতি করতে না পারেন। এভাবেই আমি বড় হয়েছি। মায়ের প্রতি একসাথে ভক্তি,সম্মান ও ভয় ছিল সর্বদাই।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম আমি। গ্রামে কোন কলেজ নেই তাই একটু দূরে মফস্বল এ চলে আসি আমরা। আমি প্রাইভেট পড়াতাম। আর মা একটা গার্মেন্টস এর টাকা, এই দিয়েই হয়ে যেত দুজনের সংসার।
এরমধ্যে আমার একটা পাবলিক ভার্সিটিতে হয়ে যায়। অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করত নিজের মাঝে। মনে হচ্ছিল যেন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। মাকে আমি টাকা পাঠাতাম। বাড়িতে মা থাকতেন আর তার দুঃসম্পর্কের এক খালা থাকতেন।
নতুন ক্যাম্পাসে এসে কিছু নেতা ভাইদের সংস্পর্শে আসি। ফ্রি খাওয়া ঘোরা,কাউকে ইচ্ছে হলে যা কিছু বলা যায় বলতাম। নিজেকে রাজা মনে হত। একসময় মনে হলো এরকম একটা জীবনই আমার যোগ্য।
সারারাত আড্ডা,তাস পিটানো ও গাঁজা, ফেন্সিতে চলে যেত আরামসে। কোথাও গন্ডগোল হলে আমরা চলে যেতাম সাইজ করতে। এর মধ্যেই আমার সমমনা কয়েকজনকে হাত করে নিয়েছি। এবং আমাদের যিনি নেতা তাকেও একসময় সরিয়ে দেই। এবং অন্যপক্ষের উপর দোষ চাপিয়ে দেই। এরপর এই নেতার মৃত্যুকে পুঁজি করেই নির্বাচনে আমার দল নির্বাচিত হয়। আমি নেতা হই। আমি অন্যতম একটা পলিটিকাল মাস্টারমাইন্ড হয়ে যাই। সমস্ত ক্যাম্পাস এখন আমার দখলে।
মফস্বলে একটা ভাল দেখে বাড়ি করে দেই মা'কে। একজন বুয়া ঠিক করে দেই। টাকা আসতে শুরু করে আমার। এক অন্যরকম লাইফ স্টাইল শুরু হয় আমার।
মদ,নারীসঙ্গ, জুয়া, টেন্ডারবাজি আমার নিত্যদিনের কাজ হয়ে ওঠে। একসময় আমার দল বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমরা নতুন কিছু ট্রাই করার প্লান করি। ভালবাসা দিবস সহ আরো কত দিবস আছে সামনে। নতুন কিছু করব আমরা। বিড়ির পর বিড়ি নষ্ট হয় রাতের পর রাত চলে যায়,অবশেষে বুদ্ধি করি আমরা।
আমাদের দেশের প্রত্যেকটা দিবসই তো ভ্যালেন্টাইনস ডে। তাই কাপলরা একসাথে থাকবেই। আমরা বেছে নেই পহেলা বৈশাখের দিনটাকে।
প্লানটা সুন্দর। সাহসের সাথে একসঙ্গে করলে ফল পাওয়া যাবে। আর পুলিশরা তো ভোঁদাই। আমার যে হায়ার লেভেলের নেটওয়ার্ক এক রাতও জেলে কাটাবো না।
আমরা কয়েকজন প্রথমে জড়ো হয়ে কোন মেয়েকে ভীড়ের মাঝে ঘিরে ফেলব। কেউ বুঝবে না যে আমরা একসাথে। এরপর আমরা মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে এ ওর গায়ে,ও এর গায়ে ফেলবে। আস্তে আস্তে সবাই মজা উপভোগ করব। যদি কারও ইচ্ছে হয় নাহলে একটু বেশিই মজা নিব। আমরা ঘিরে দাঁড়ালে কেউ কিছু করতে পারবে না। যে আসবে তাদের আটকানোর জন্য ও আমরা প্রস্তুত থাকব।
এরপর এল পহেলা বৈশাখ। আমরা কিছু মজাপ্রিয় পুরুষ ভাগ হয়ে ভীড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগলাম টার্গেট। পেয়েও গেলাম। সুযোগ মত কাজেও লাগালাম। বেশ হইচই হল,মারামারি হল। এগুলা তো আমাদের পছন্দ। মজা নেওয়া শেষে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এক মেয়েকে আমরা কয়েকজন মিলে তুলে নিয়ে গেলাম। জীবনে বহু গ্যাংব্যাং দেখেছি বাট বাস্তবের মত তার তুলনা হয় না। পরে মেয়েটাকে বেহুঁশ অবস্থায় একটা সিএনজিতে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। যাক মেয়েটার শেষমেশ একটা উপকার করলাম।
সবই ঠিক ছিল কিন্তু পরে ধরা পড়ে গেলাম। মেয়েটার বাবা বিশাল বড় নেতা। আমাকে কোন চিপা দিয়ে ধরে আনলো। থানায় ইচ্ছামত মারা হল কিন্তু আমি জানি আমি বের হয়ে যাবই।
কে যেন মাকে খবর দিয়েছে। মা পরদিন সকালে থানায় হাজির। পুলিশ কিছুতেই ঢুকতে দিবে না। মা বারবার বলছেন, "আমার ছেলে এরকম করতে পারেন না,আপনারা ওকে এভাবে নির্যাতন করবেন না। "
পেছনে সেই মেয়ের বাবা এসেছেন দলবলে,পুলিশ উঠে দাঁড়িয়েছেন, মা পেছনে ফিরলেন, লোকটি যেন মায়ের দিকে তেড়ে আসছিলেন কিন্তু হঠাৎ করে থেমে গেলেন।
"আফনে বাইচা আছেন?????!!!! "
লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকিয়ে আছে যেন সামনে ভূত দেখছেন।
"তুমি রহিমা না!!!!"
"আফনের ছেলে আফনের মতই হইছে। আফনে আমারে বিয়া করার কথা কইয়া কি করছিলেন আমার লগে তার ফল আজকে আল্লায় আফনেরে বুঝাইয়া দিছে। আমারে লোক পাঠাইয়া কইছিলেন যে আফনে মরছেন। আমি সেই ভালবাসার ধন আগলায়ে রাইখা এই পর্যন্ত নিয়া আসছি!!!!"
প্রেস রিপোর্টার,পুলিশ সকল মানুষের সামনে এই লোকটার মুখোশ খুলে গেল। সবাই যেন স্তম্ভিত হয়ে আছেন।
আর আমি,
আমার বাবাকে সামনে দেখেও আজ মনে হচ্ছে খুবলে চটকায়ে থেঁতলে দেই!!! এই লোকের রক্তই আমার শরীরে ভাবতেই ঘৃণা। সাথে সাথে এই ভেবে ঘৃণা ধরে বমি চলে আসছে পেট মুচড়িয়ে যে আমি আমার নিজের বোনের ইজ্জত নিজেই নিয়েছি!!!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫২