বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমেই জিজ্ঞেস করলেন, ওরা আমার চোখের ডাক্তারকেও কি মেরে ফেলেছে ?
সেই ডাক্তারের দুটো মেয়ে ছিল ! দুজনের বয়সের মধ্যে পার্থক্য মাত্র এক বছর ! বড় মেয়েটা অসুস্থ থাকার কারনে তার মা, ছোট মেয়েটাকে খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না ! সারাদিনের ব্যাস্ততা শেষ করে সেই ডাক্তার যখন বাসায় আসতেন, তখন তার ছোট মেয়েটাকে তিনি বুকের উপর রেখে ঘুমাতেন ! মেয়ে বুকে থাকার কারনে ডাক্তার সাহেব পাশ ফিরতে পারতেন না, কাঁত হয়ে ঘুমাতে পারতেন না ! এই ডাক্তার লোকটাকে তারা ধরে নিয়ে গেল ১৫ডিসেম্বর বিকেলবেলা ! তারপর তাকে বাংলার আরো অনেক সূর্যসন্তানদের সাথে ময়মনসিংহ ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিউটে রেখেছিল !
ডাক্তার সাহেবের লাশ তার পরিবার পেয়েছিল ১৮ তারিখে ! তারা দেখলো তার বুকটা ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছে, কপালে বেয়নেট ঠুকিয়ে কপালটা ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়েছে !
কথাগুলো বলছিলেন, ডাঃ নুজহাত চৌধুরী, সেই ডাক্তারের গর্বিত সন্তান ! কথাগুলো শেষ করে প্রশ্ন করলেন, আমাদের বাবারা কেনো হাসিমুখে জীবন দিয়েছিলেন জানেন ? তাদের আশা ছিল, আপনাদের হাতে দেশটা দিয়ে গেলে আমার দেশটা আরো ভালো থাকবে ! শুধু এই আশায়, শুধু এই আশায় তারা তাদের জীবনটা দিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে কি তাদের স্বপ্ন পুরন হয়েছে ?
পরবর্তীতে স্বাধীন দেশেও সেই সব মানুষগুলোই যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, যারা নিজ হাতে এইসব সূর্যসন্তানদের খুন করেছিল বা ধরিয়ে দিয়েছিল তারাই দীর্ঘদিন দেশের মূল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল ! ওদেরকে কারা বসিয়েছিল ক্ষমতার আসনে ?
আচ্ছা, ওই ডাক্তারের সম্পর্কে সবই তো প্রায় বলে দিলাম, ওই ডাক্তারের নামটা কি বলতে পারবেন এখন ?
মার্চের প্রথমের দিকে যখন আপনাদের সামনে এইসব ইতিহাস জানানোর ক্ষুদ্র চেস্টা শুরু করেছিলাম, তখন থেকেই দেখি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের বয়সীদের আগ্রহ কম ! যেখানে ৮০-৯০ লাইনের লুতুপুতু গল্প হাজার হাজার ছেলে মেয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ে, তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধর উপরে লিখা ২৫-৩০ লাইনের পোস্ট পড়তে চায় না ! সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি আমরা তরুন থাকতাম তবে কি আমরা দেশের জন্য এতোটা করতে পারতাম ?
একজন মজা করে বললেন, সেই সময়ে আমাদের জন্মগ্রহন না করে সৃষ্টিকর্তা খুব বড় ভালো কাজ করেছেন !
আসলেই তাই ! আমরা যদি আমাদের অতীত ইতিহাস না জানি, আমাদের প্রজন্মকে না জানাই, তাহলে আবারো হয়তো আরেকবার দেশকে স্বাধীন করতে হবে, সেদিন আর কেউ যুদ্ধে যাবে না ! ঘরে বসে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবে, "বাইরে খুব গোলাগুলি হচ্ছে, আমার খুব ভয় করছে, প্লিজ সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন" সবাই সেখানে কমেন্ট করবে, 'আল্লাহ আপনার সহায় হোন, আমীন' ! আর কিছু মানুষ খাকী পোশাক ওয়ালাদের সাথে অন্তরঙ্গ সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিবে, ক্যাপশন হবে...... থাক আর না বলি !
এখনো আমরা একেবারে হারিয়ে যাই নি বলেই, এখনো শাহবাগে গনজাগরন মঞ্চ তৈরি হয়, তবে কথাগুলো খুব অভিমান নিয়ে বলা, কেউ ব্যাক্তিগত ভাবে নিয়েন না প্লিজ ! আমি যুদ্ধ দেখি নি, কিন্তু আমি "ওরা ১১জন", "আমার বন্ধু রাশেদ"...... মুভি দেখেছি, আনিসুল হকের লিখা "মা"...... পড়েছি ! যদিও সেখানে তাদের অত্যাচারের বর্ণনা খুব কমই উঠে এসেছে !
রাত জেগে যখন আপনাদের জন্য এইসব পোস্ট লিখি তখন আমার রুমে থাকা ছেলেটা তার প্রেমিকার সাথে গল্প করা থামিয়ে বলে, পিয়াস তোর এতো ধৈর্য আসে কই থেকে ভাই ? তখন তার উত্তরে একটা ছোট্ট হাসি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না ! কেননা সে হয়তো ভেবেই নিয়েছে, তার পুরো পৃথিবী ফোনের ওপ্রান্তে, সেটাই সব ! বাইরে সব পাগলেরা থাকে !
এই পাগল হয়ে থাকার যে কতটা আনন্দ, আমার রুমে থাকা ছেলেটা যদি জানতো.........
আসুন আমরা সচেতন হই, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা করি, পরের প্রজন্মকে চিন্তা করতে শেখাই, তবেই হয়তো সেই ডাক্তারদের আত্মারা শান্তি পাবে !
শুভকামনা নিরন্তর !
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:৪৮