দলীয় নেত্রীকে গ্রেফ্তারের (?)প্রতিবাদে কিছুদিন আগে কয়েকজন একটি ক্যাব আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থে অন্ধ এসব কর্মীদের মানসিক বন্ধাত্ব এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে ঐ ক্যাবের চালক বা মালিকের যে এই গ্রেফতারে কোন হাত নেই তা অনুধাবনের শক্তি নেই, আর থাকলেও এই কাজটি যে ঘৃণ্য তা বুঝার ক্ষমতা নেই। সরকারের কোন কাজের (!)প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাধারন মানুষের ধন সম্পদ, ঘর বাড়ি ধ্বংসের যে অসুস্থ, অমানবিক চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলছে তার সমাপ্তি কবে, কিভাবে জানিনা!
কিছুদিন আগে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা দুজনেরই অত্যন্ত সুন্দর একটি বক্তব্য দলমত নির্বিশেষে সবার মন ছুঁয়েছে। তাঁরা বলেছেন, "আমার বিরুদ্ধে যে কোন অভিযোগ আনলে আমি তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত, দেশের মাটিতে বিচার করে যা শাস্তি হবে মাথা পেতে নিবো তবে আমাকে দেশ থেকে করে দিবে বা দেশে ফিরতে দিবেনা তা মানবোনা।" আমরা সবাই তাঁদের সাথে গলা মিলিয়ে একই দাবী তুলেছি, সরকার তার নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। একটি ন্যয্যদাবী সমর্থনে বাংলাদেশের মানুষের কখনও কোন কার্পণ্য নেই।
আজ যখন তাঁদের সেই সুযোগ এসেছে নিজেদের নিদোর্ষ প্রমান করার, তখন কিছু মানুষ জল ঘোলা করতে চাইছে। আমাদের দেশের সাবেক দুই নেত্রী শুধু দেশবাসী নয় বিশ্ব নেত্রীবৃন্দের কাছে বড় মুখ করা যা বলেছেন, তাঁদের সেই কথার মর্যাদা রাখার সময় এবং সুযোগ যখন এসেছে তখন এসব স্বার্থান্বেসী মানুষের মায়া কান্না কতোটুকু যৌক্তিক! খালেদা জিয়া শেখ হাসিনা দুজনেরই ভালো মন্দ দোষগুন আছে। তাঁরা ক্ষমতাসীন ছিলেন মানে এই নয় যে তাঁরা সকল আইন বিচার, জবাবদিহিতার উর্দ্ধে।
সেই বাবা যিনি সন্তানের মুখে দুবেলা খাবারের নিশ্চয়তা দিতে, শত প্রতিকুলতার মাঝেও চাকুরী রক্ষার্থে হরতালের কারণে পায়ে হেঁটে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার অপরাধে তাঁর কাপড় খুলে উলঙ্গ করা হয়েছিলো, আমি তার বিচার চাই।
প্রাইভেটে কারের বিলাসিতা করতে অক্ষম যে মানুষগুলো জিবীকার প্রয়োজনে, অর্থের অভাবে সেদিন বাসে উঠে পেট্রল বোমা হামলার স্বীকার হয়েছিলেন, আমি তার বিচার চাই
যে সকল অসুস্থ বাবা মা হরতালের কারণে সময় মতো হাসপাতালে পৌছুঁতে না পারায় বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন, আমি তার বিচার চাই, আমি স্বচক্ষে তাঁদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছি।
রংপুর দিনাজপুর সহ বিভিন্ন স্থানে আশ্বিন কার্তিক মাসে ভয়াবহ মঙ্গায় বছরের পর বছর আমার মা বাবা ভাই বোন যখন না খেয়ে অমানবিক কষ্ট করেছেন, প্রান হারিয়েছেন আর ঠিক সে সময় ক্ষমতায় বসে আমার কষ্টার্জিত অর্থে যারা নিজেদের ভারী পকেট কে আরো ভারী করার বিকৃত নেশায় লিপ্ত ছিলেন, দেশের অসহায় মানুষকে অভুক্ত রেখে তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, আমি তাদের বিচার চাই।
তীব্র শীতের প্রকোপে দরিদ্র মানুষ শীত বস্ত্রের অভাবে যখন নির্মম কষ্ট করেছেন, প্রান হারিয়েছেন, তখন এই দরিদ্র জনগনের অর্থে যারা দামী স্যুট পড়ে দামী প্রাসাদ গড়েছে, আমি তাদের বিচার চাই।
রাজনীতি করা মানে দাসখত লিখে দেয়া নয়, রাজনীতি করা মানে দলের প্রতি অন্ধ সমর্থন নয়। আমরা যখন কোন দলকে সমর্থন করতে গিয়ে নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে অন্ধ ভাবে তাদের তোষামোদে, পক্ষপাতিত্বে লিপ্ত হই তখন তা রাজনীতি করা বলে না, হয়ে যায় দাসত্ব।
রাজনীতি করতে পথে নামবো আমি, তোমাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে অহত হবো আমি, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় আমার বাবার বহুকষ্টার্জিত পয়সায় কেনা কলম ছিনিয়ে আমার হাতে তুলে দেবে অস্ত্র, মিছিলে মারমারিতে রক্তাক্ত হয়েছি আমি, তোমাদের ক্ষমতার নিশ্চয়তা রক্ষায় মিটিংএ মারা মারি করে পঙ্গু হয়েছি আমি, তোমাদের সমর্থনের অপরাধে প্রতিপক্ষের আঘাতে মাথায় আঘাত পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে আমার ভাই, আর আজ যখন সময় এলো, তখন ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হবে দুধে ভাতে বড় হওয়া তোমার অযোগ্য সন্তান? এ যদি হতো কোন রাজতন্ত্র, যেখানে নীল রক্তের জয় যুগে যুগে তাও মানা যেত। কিন্তু আমাদের লড়াই গনতন্ত্রের জন্য, এখানে তোমাদের রক্ত তো নীল নয়, আমার রক্তের মতোই লাল!
আমাদের চোখে ঘষা কাঁচের চশমা পরিয়ে অসচ্ছ করা হয় দৃষ্টি, আমরা সেই ঝাপসা চোখে শুধু অন্ধের মতো গেয়ে যাই নির্দিষ্ট দলের বন্দনা সঙ্গীত। আমরা যারা সাধারণ মানুষ চশমাটি পড়তে অস্বীকরা করি তাদের ঘাড়ে নেমে আসে যতো অপবাদ। কারো বিরুদ্ধে কথা বললে হয়ে যাই "ভারতের দালাল", একটি দলের সমালোচনা করলে নাম দেয় "রাজাকার" আর আরেকজনের সাথে সহমত না হলে চোখ রাঙিয়ে ঘোষনা করে "মুরতাদ"। আমরা গত ৩৭ বছর ধরে শুধু ক্ষমতা বদলের যাঁতা কলে পরে একটির পর একটি অপবাদ কাঁধে নিয়ে জিন্মি হয়েছি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাতে, অন্যায় ভাবে শোষিত হয়ে এসেছি।
দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীদের দেবদেবীর আসনে বসিয়ে তাদের উপাসনায় লিপ্ত, তাদেরকে সকল দোষত্রুটির উর্দ্ধে মনে করেন। তাদের দেয়া শাস্তি কে প্রসাদ মনে করেন, আশির্বাদ ভেবে নিজেকে ধন্য মনে করেন। এসব অন্ধ তোষামোদকারীরা বুঝতে অক্ষম যে তাদের ঠিকানাবিহীন পশুর মতো মৃত্যু বরণ করার জন্য মিছিলে এগিয়ে দিয়ে নেতা নেত্রীরা আড়ালে নিজেদের মধ্যে হাত মিলাচ্ছেন। এরা সামান্য কিছু আর্থিক সুবিধার লোভে মেনে নেয় দলীয় নেতার সকল কুকর্ম, অন্যায় ভাবে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশবিক আঘাত হানতে দ্বিধা বোধ করেনা, অতি সহজে বিকিয়ে দেয় নিজের বিবেক, নিজের আত্মা।
২৮ শে অক্টোবরের মিছিলে লগী বৈঠা হাতে কেন সজিব ওয়াজেদ ছিলোনা? লগী বৈঠার জবাব যারা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দিয়েছিলো, তাদের মাঝে কেন গোলাম আযম বা নিজামীর সন্তানেরা ছিলোনা? হিরক রাজার দেশের সেই প্রজাদের মতো মগজধোলাই করা এদের বন্ধ্যা মস্তিষ্কে এসব ভাবনা আসেনা। এসব নেতা নেত্রীদের পুজো করেই এই অন্ধ পূজারীরা আত্মতৃপ্তি লাভ করে।পথের কুকুরের দিকে উচ্ছিষ্ট রুটি ছুঁড়ে দেয়ার মতো, এসব নেতা নেত্রীরা এদের দিকে দুই পয়সার অন্যায় সুবিধা, সামান্য কটি কালোটাকা, অথবা সীমিত কিছু ক্ষমতা ছুঁড়ে এদের কৃতদাস বানিয়ে নেয়।
এই যে দাসত্ব. এই যে বিশ্বস্ততা, তারপরও দলীয় সর্বোচ্চ পদটি কখনও তাদের নয়, সেটি বরাদ্দ পরিবারের কোন সদস্যের জন্য। একে গনতন্ত্র বলে? গনতন্ত্রের নামে এমন অনাচার চলবে, এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষ দেশের জন্য শহীদ হয়েছিলেন?
এই অন্ধ কৃতদাসেরা এমন কান্ডজ্ঞান শুন্য হয়ে পড়ে যে নিজের বিবেক, রুচীর সাথে সাথে মনুষত্ব হারিয়ে ফেলে। রাজনৈতিক ভাবে যে দলেরই সমর্থক হোক, বাংলাদেশি হলে এই দেশের মাটি ও মানুষের জন্য শেখ মুজিবর রহমান ও জিয়াউর রহমানের অবদান অস্বীকার করা যাবেনা। গত ৩৭ বছরের ইতিহাসে আমাদের এই ছোট্ট গরীব দেশটি কোন রাষ্ট্র প্রধানের সত্যিকারের ভালোবাসা পেলে তা পেয়েছে এই দুজনের কাছ থেকে। রাজনৈতিক দোষ হয়ত তাঁদের কিছু ছিলো তবে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁদের ছিলো নিখাদ ভালোবাসা, গভীর মমতায় তাঁরা এই দেশটিকে বুকে ধারন করেছিলেন সেকথা সত্যবাদী মাত্রই স্বীকার করবে।
এই দুজন দেশ প্রেমিককে অকালে নির্মমভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় করেই ক্ষ্যান্ত দেয়নি অনেকে, সুযোগ পেলেই নির্মম ভাবে এই মৃত মানুষদের চরিত্র আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে। ভাবখানা এমন, যেন এক জনের সম্পর্কে ভালো কিছু বললেই আরেকজন কে হেয় করা হয়। এরা ভুলে যায় জীবিত অবস্থায় তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কথা, ভুলে যায় তাঁরা এক আরেকজনকে সন্মান করেছেন অপমান করেননি কখনও সেকথা। এক জনকে ভালো, মহান প্রমান করতে আরেকজন কে ছোট করতে হবে কেন?
খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ত্রুটি করে থাকলে তাঁদের সমালোচনা হতেই পারে। তবে প্রতিহিংসাপরায়ন অন্ধ সমর্থকেরা ছিনিমিনি খেলে প্রতিপক্ষের ব্যক্তি জীবন নিয়ে। কারো সন্তান নিয়ে, চরিত্র নিয়ে কুৎসিত ঈঙ্গিত করে অশ্লীল অপবাদ দিতে এদের নোংরা রুচিতে বাঁধেনা। তাঁদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষ করে।
স্বামী স্ত্রী হাত ধরে রিক্সা ভ্রমনের অপরাধে স্বামীটিকে কান ধরে উঠবসা করানো যেমন একটি অন্যায় ধৃষ্টতা, নিজের মাকে গ্রেফতারে দেশের কিছু মানুষ আনন্দিত হলে তাঁদের "রাজাকার" সম্বোধন করাও তেমনি একটি ঘৃণ্য স্পর্ধা, ধৃষ্টতা। একটি অন্যায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা অনেকেই আরেকটি অন্যায় কে সমর্থন করছি কেন?
আমাদের মাঝে ব্যতিক্রম আছেন, কেউ কেউ অবশ্যই অন্ধত্ব থেকে দুরে এসে নিজ দলের সমালোচনা করতে জানেন। এই ব্লগেই দেখেছি, একটি নির্দিষ্ট দলের সমর্থক অথচ সেই দলের নেতৃ স্থানীয়দের বিরুদ্ধে দুর্নিতীর অভিযোগ এলে, "অপরাধ করলে এদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া উচিৎ" বলার মতো সৎ সাহস রেখেছেন। দলের সমর্ধক হওয়ায় সেই দলের সাতখুন মাফ মনে করছেননা।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলে সৎ, নিষ্ঠাবান নেতা কর্মী আছেন বলে আমার বিশ্বাস। তাঁরা সাদা কে সাদা আর কালো কে কালো বলতে জানেন, আত্মসমালোচনা, নিজের দলের সমালোচনা করতে ভীত নন।
জ্ঞানে অথবা অবচেতন মনে করা "দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি" এই অসুস্থ মতবাদের অন্ধ চর্চা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। সবার উপরে দেশ, আমাদের বাংলাদেশের স্বার্থের উপরে ব্যক্তি বা দল শুধু নয়, প্রয়োজনে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা কেউ আইন বিচারের উর্দ্ধে নই। দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে সবাইকে বিচারের সন্মুখীন হতে হবে। খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, নিজামীদের অন্যায়ের যেমন বিচার হবে, বর্তমান সরকার অন্যায় করলে তাঁদেরও বিচার হবে। ১৯৯০-২০০৬ এদের বিচার হয়নি আজ হচ্ছে, তেমনি অন্যদেরও হবে, কখনও কোন এক সময়। আর তাই বর্তমানের সমালোচনায় অন্ধ হয়ে আমরা অতীতের অপরাধীদের ক্ষমা করতে পারিনা।
রাজনীতি করতেই পারি, কোন দলকে সমর্থন জানাতেই পারি, তাই বলে আমরা অন্ধ হবো কেন!
*** এই লেখাটি কোন নির্দিষ্ট দল সম্পর্কে নয়***
***জানানোর প্রয়োজন মনে করছি, শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিযোগ সত্বেও ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের সৎগুনগুলো পছন্দ করি। তাঁদের সম্পর্কে বা কারো সম্পর্কে আক্রমন করে এখানে মন্তব্য না করার অনুরোধ রইলো ***
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৯