নান্দোসের একটি চিকেনের প্লেটারের দাম নাকি এগারো হাজার টাকা! এই নিয়ে ফেসবুকে কত লেখালেখি! বেশির ভাগই নিন্দাসূচক।
সবার মোটামুটি একই মন্তব্য, "বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশে কেন একটি মুরগির দাম এগারো হাজার টাকা হলো? ফাইজলামির একটা সীমা আছে!"
কথা সত্য।
তবে এও সত্য যে আমরা বাঙ্গালিরা যখন কিছু পাইনা, তখনই কেবল কমিউনিস্ট হয়ে যাই। গরীবের জন্য তখন আমাদের বুক ফেটে চৌচির! আর যখন সেটা পেয়ে যাই, তখন আমাদের চেয়ে বড় ক্যাপিটালিস্ট আর কেউ হতে পারেনা। তখন আর সেই গরীব দুঃখীদের কষ্ট আমাদের স্পর্শ করেনা।
উদাহরণ সহ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে।
রাস্তার পাশের ভাতের দোকান এবং নান্দোসের মধ্যে যে কিছুটা পার্থক্য আছে, তা নিশ্চই আমাদের সবার চোখে পড়ে। যদি না পড়ে তাহলে একবার নান্দোসে ঢুকে পড়ুন এবং কাস্টমারদের ভাল করে লক্ষ্য করুন।
কাউকে কি পাবেন যিনি লুঙ্গি পড়ে খেতে চলে এসেছেন?
কাউকে পাবেন চেয়ারে পা তুলে বসে হাত দিয়ে আয়েশ করে হাপুস হুপুস করে খাচ্ছে?
যদি পান, প্লিজ ছবি তুলে সেখানে আমাকে ট্যাগ করে দিন। কারন আমি নান্দোসে কখনও এই শ্রেণীর কাস্টমার দেখিনি।
নান্দোসের একটি প্লেটারের দাম এই কারনেই এগারো হাজার টাকার চেয়ে একটাকা কম কারণ তাঁদের কিছু কাস্টমার এই টাকা দিয়ে মুরগি খাবার সামর্থ্য রাখেন।
ঠিক যেমনটা ওয়েস্টিনের এক কাপ চায়ের মূল্য টংয়ের দোকানের এক কাপ চায়ের মূল্যের চেয়ে সামান্য একটু বেশি হয়ে থাকে।
এইটা নিয়ে এত হইচই করার কিছু নেই।
আমার দেশে এমন অনেক মানুষই আছেন যারা প্রতিদিন নিয়ম করে একবেলা উপোস থাকেন। কারন খাবার সামর্থ্য নেই। যখন ভাত খেতে বসেন, তখন সেই ভাতে পানি ঢেলে তাতে লবণ কচলে মুখে দেন। সাথে একটা কাঁচা মরিচ পেলে আনন্দে তাঁদের চোখে পানি আসে! সুষম খাদ্য তাঁদের কাছে বিলাসিতার নাম।
অনাদিকাল থেকেই আমাদের দেশে এইসব মানুষের বাস। এমনও না যে আমরা কেউ জানতামই না।
এখন আমরা কয়জন বাজারে একটা বড় কাতলা মাছ বা গলদা চিংড়ি কেনার সময়ে তাঁদের কথা চিন্তা করেছি?
পোলাও কোর্মা রেঁধে খাওয়ার সময়ে কয়বার ভেবেছি তাঁদের কথা?
গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে খেতে যাবার সময়ে একবারও কি খেয়াল করি রেস্টুরেন্টের পাশেই হয়তো একটি পরিবার না খেয়ে বসে আছে?
গরুর মাংসে স্বাদ ঊনিশ বিশ হয়েছে বলে অভিমানে কতদিন খেতে বসিনি, অথচ সেই গরুর মাংসই যে তাঁদের কাছে বেহেস্তের খাবার! এই জীবনে খাবার আশাও তাঁরা করেননা!
অনেক বছর আগে আমাদের বাসায় দাদির মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে পাড়ার দুই মসজিদের দুই ঈমাম এবং মুয়াজ্জিনদের দাওয়াত করে এনেছিলাম।
নতুন মসজিদে যেতাম বলে তার মুয়াজ্জিনের সাথে আমার সহজ সম্পর্ক ছিল। সে বেচারা আমার কম্পিউটার ডেস্কের চেয়ারে বসে খুব মজা পেল। নরম, রিভলভিং চেয়ার! তিনি বারবার দোল খেতে লাগলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার বাসা থেকে বেরিয়েই তিনি বাজারে গিয়ে এই চেয়ার কিনে বাড়ি ফিরবেন। সৌখিনতার দাম লাখ টাকা কিনা!
"এই চেয়ারটাতো খুব আরামের! কত দাম এর?"
"চার হাজার টাকা।"
আমি সরল মনে বলে ফেললাম। দাম শুনে হুজুর নড়ে চরে বসলেন। মিলিটারীতে "সাবধান হওয়া" টাইপ বসা।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করলেন।
"কত বললে?"
"চার হাজার টাকা।"
তিনি ঈমাম সাহেবের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, "শুনলেন? এই চেয়ারের দামই চার হাজার টাকা!"
যখনকার কথা বলছি, তখন মুয়াজ্জিন সাহেবের বেতন ছিল পনেরোশো টাকা। এবং ঈমাম সাহেব পেতেন আঠারোশো টাকা। এবং অবশ্যই তা মাসিক। এই টাকার সাথে উপরি যা কামাই হতো, তা দিয়েই তাঁদের সংসার চালাতে হতো।
নিজেকে সেদিন এত ছোট মনে হচ্ছিল!
তাঁদের দৃষ্টিতে আমার সেই চেয়ার ছিল 'এগারো হাজার টাকার চিকেন প্ল্যাটার।'
আমার কথা হচ্ছে, কারও যদি সামর্থ্য থাকে, তাহলে সে দশ-এগারো হাজার কেন, কয়েক লাখ টাকার মুরগি খাবে। আমার কি? আমাকেতো আর তার বিল পে করতে হচ্ছে না।
আপনি ওয়েস্টার্ন গ্রীলে গিয়ে চিকেন ললিপপ খাননা? কেএফসিতে গিয়ে খাননা? পিৎজা হাটে যানতো? বিল কত আসে? পাঁচশো? এক হাজার? দুইহাজার? সেটাই গ্রামের দিকে কিছু পরিবারের একমাসের সংসার খরচ। এখন বলবেন না যে আপনি সেটা জানেন না।
যদি এখন বলেন যে আপনি ফ্যান্সি রেস্টুরেন্টে খেতে যান না। খুবই উত্তম! কিন্তু ফ্যান্সি অ্যাপার্টমেন্টেতো থাকেন? একবার বস্তিতে গিয়ে দেখেন, এককামড়ার বস্তি ঘরেই সন্তান উৎপাদন, লালন, পালন সবকিছু করে জীবন চক্র কাটিয়ে দিচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। তাঁদের কাছেও আপনার অ্যাপার্টমেন্ট "চিকেন প্ল্যাটার নম্বর সাত!"
অন্যকে কিছু বলার আগে নিজের দিকে তাকিয়েছেন কখনও? যেখানে একই কাজ আপনি সবসময়েই করে যাচ্ছেন, সেখানে অন্যকে কেন গালাগালি করছেন?
শুধু এইদিকটা খেয়াল রাখবেন যে কেউ অপচয় করছে নাতো!
দেখা গেল দশ হাজার টাকার চিকেন নিলাম, অথচ তার একটা রানও ঠিক মত চিবিয়ে খেতে পারলাম না। বাকিটা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হলো। এবং তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই। এই সমস্ত পাবলিককেই কেবল রূপসা হাওয়াই চপ্পল দিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত পেটানো উচিৎ।
এদের নিয়েই তখন মন্তব্য করা যায়, "ফাইজলামির একটা সীমা আছে!"
অপচয়ের ব্যপারেই আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। বলেই ফেলি। এখন গল্প বলার মুডে আছি।
আমার মেজো চাচা খুব সৌখিন ধরনের মানুষ ছিলেন। জমিদারের বংশধর, কাজেই নাকটা ছিল একটু উঁচু।
ভাত খাবার সময়ে তাঁর থালা থেকে যদি কখনও কিছু ভাত গড়িয়ে পড়ে যেত, তিনি কখনই তা তুলে খেতেন না।
খাবার শেষে সবসময়েই কিছু না কিছু অপচয় করতেনই।
একবার তিনি আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলেন। সেই আত্মীয় ছিলেন তখনকার সময়ে সিলেট শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন। তাঁর প্লেট থেকে যখন ভাত গড়িয়ে টেবিলে পড়ে গেল, তখন তিনি সেটা তুলে খেলেন।
এই দৃশ্য দেখে চাচা ভাবলেন, "যদি এই লোক টেবিল থেকে ভাত তুলে খেতে পারেন, আমি তাহলে কোন ছাড়?"
এই অপচয় নিয়েই আমার সাথে আমার বেশ কিছু 'কাছের মানুষের' অনেকবার মনোমালিন্য হয়ে গেছে।
দেখা গেছে অ্যামেরিকা থেকে দেশে গেছি বেড়াতে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি। এক ফাজিল যা পারবেনা তার চেয়েও বেশি খাবার নিয়ে প্লেট ভর্তি খাবার নষ্ট করে আসলো।
তখন অনেক কষ্টে দাঁত মুখ চিবিয়ে টাইট হয়ে বসে থাকতাম। যদি নাই পারিস, তবে নিলি কেন? এর চেয়ে রেখে দিলেওতো অন্য কেউ খেতে পারতো।
অপচয়ের আগে শুধু এইটা খেয়াল রাখবেন, আপনি যা ফেলে দিচ্ছেন, সেটাই হয়তো কারও কারও জন্য রাজভোগ!