"অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক।"
কুরআন শরীফের সুরাহ তাওবার পঞ্চম আয়াতের একাংশ। আয়াতটি অতি বিখ্যাত। কারন আস্তিক এবং নাস্তিক দুই সম্প্রদায়ই কথায় কথায় এই আয়াতটি ব্যবহার করে থাকে।
অতি আস্তিক বা যারা অতি মৌলবাদী, তারা সুর করে আরবিতে এই আয়াত পাঠ করে অত্যন্ত আবেগঘন কন্ঠে ঘোষণা দেন, "এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ পাক বলেছেন, ইহুদি নাছারারা আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। যেখানেই তাদের পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের কতল করতে হবে। আল্লাহর আদেশ পালন করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য! ঠিক কিনা বলেন?"
হাজার হাজার মূর্খ শ্রোতা এক বাক্যে আওয়াজ দেন, "ঠিক! ঠিক!!"
কেউ এতটুকু চিন্তা করবেন না আল্লাহ কেন এমন কথা বললেন। যেহেতু আল্লাহ বলেছেন, তাই ঠিক। কোন পরিস্থিতির জন্য কথাটি প্রযোজ্য সেটা ভাবার টাইম আছে? কুরআন শরীফ বুঝে পড়ার সময় কোথায়?
জনসভা শেষে তারা বাড়িতে ফিরে চা নাস্তা খেয়ে রান্নাঘরের দা বটিতে ধার পরীক্ষা করেন। কোন এক দাঙ্গা বাঁধলে প্রথমেই প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়িতে "আল্লাহু আকবার" রব তুলে আক্রমন করেন। কারন, আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ আছে!
নাস্তিকেরা এই আয়াতটি ব্লগে অথবা ফেসবুকে লিখে বলেন, "ঈশ্বরের সিংহাসন কাঁপছে।"
একদল 'চিন্তাবিদ' তরুণ ছেলেপিলে লেখাটি পড়ে যাচাই বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত নিবে, "যদি আল্লাহ এমন বলে থাকেন, তাহলেতো আসলেই ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম! আমি এর সাথে নাই। আমি আজ থেকে 'মুক্তচিন্তাবিদ।'"
তারপর সে কুরআনের পাশে সিগারেট ধরিয়ে ভিডিও করে অ্যাটেনশন পাবার আশায় ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়।
মজার ব্যপার হলো, আয়াতটি কিন্তু অসম্পূর্ণ। মূল আয়াতটির শেষে লেখা আছে, "কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" (সুরাহ তাওবা, আয়াত ৫)
তারচেয়েও বড় কথা, আয়াতটিতে যুদ্ধক্ষেত্রের কথা বলা হচ্ছে। আর মুশরেক বলতে এখানে শত্রুদের বলা হচ্ছে। কারন ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে মুশরেকদের সাথেই মুসলমানদের যুদ্ধ হতো। এবং আল্লাহ যুদ্ধে শত্রুকে বধ করার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি এও বলেছেন, কেউ যদি 'সারেন্ডার' করে, তাহলে তাকে ছেড়ে দিতে।
নবীজি (সঃ) সাথে এও যোগ করেছেন, "যুদ্ধে নারী, শিশু, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এমনকি গাছ পালারও যেন কোন ক্ষতি না হয়।" ইসলামে "কোলাটেরাল ড্যামেজ" বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।
এখানে "সন্ত্রাসের" কি হলো সেটাই আমি বুঝতে পারছিনা। যেকোন দেশের সেনাবাহিনীতে একই নিয়ম চালু আছে। শত্রুপক্ষ যখন বুলেট ছুড়ে, কোন জেনারেল আপনাকে বলেননা তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে। বরং বলেন যে শত্রুকে না মেরে যুদ্ধে জেতা যায়না।
শত্রু যদি সারেন্ডার করে, তবে অবশ্যই জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাঁর সাথে আচরণ করার নির্দেশ থাকে।
মজার ব্যপার হলো, জেনেভা কনভেনশন হলো এই সেদিন, আর কোরআনের এই আয়াতটি নাযেল হয়েছে চৌদ্দশো বছর আগে। তারপরেও ইসলাম একটি মধ্যযুগীয় বর্বর ধর্ম! দারুন মজা! দে তালি!
আস্তিক নাস্তিক দুই পক্ষ্যই কুরআনের আয়াত নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে কুরআন অবমাননা করছে। যে লোক কুরআনের উপর কফি রেখে ভিডিও করে, সে যেমন দোষী, তেমনি যে লোক একহাতে কুরআন ও অন্য হাতে রাইফেল নিয়ে ছবি তুলে, সেও সমান অপরাধী।
অতিরিক্ত যেকোন কিছুই খারাপ। অতি উগ্র নাস্তিকতা যেমন খারাপ, তেমনি অতি মৌলবাদী জঙ্গিবাদও খারাপ। দুইটাই সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ছাড়া আর কোন কিছুই করতে পারেনা।
উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ইরাকে, সিরিয়ায় এবং এইরকম অনেক অনেক মুসলিম দেশে, যেখানে মুসলমানেরাই একে অপরকে "আল্লাহু আকবার" বলতে বলতে জবাই করে। কারন কি? কারন হচ্ছে আমরা যেভাবে নামাযে দাঁড়াই, তারা সেভাবে দাঁড়ায় না। এরচেয়ে হাস্যকর যুক্তি আর একটাও হতে পারে?
ওস্তাদ নোমান আলী খান একটা লেকচারে বলেছিলেন, "মদ্যপ অবস্থায় নামাজে দাঁড়ানো হারাম। কুরআন পাঠ হারাম। কারন মাতাল মানুষ ১০০% নিশ্চিত থাকেনা সে কি বলছে। আল্লাহ চান যখন তাঁর সামনে দাঁড়ানো হবে, যখন তাঁর কুরআন পাঠ করা হবে, তখন যেন মানুষ ১০০% জানে সে কি পাঠ করছে।"
মদ্যপান আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। আমরা মদ্যপ অবস্থায় নামাজে দাঁড়ানোর ভয় করিনা। কিন্তু যেটা ছিল মূল উদ্দেশ্য, কুরআন ১০০% বুঝে পাঠ করা, সেটাইতো আমাদের দিয়ে কখনও হয়না। তাহলে লাভটা কি হলো?
উল্টা অমুক হুজুর কি বলল, আর তমুক ব্লগার কি বলল সেটা পড়ে বেহুদা ফালাফালি করি। এই কারনেই এদের মূর্খ বলেছি। মাইন্ড করলে করতে পারেন।
দুই পক্ষের জন্যই "সুরাহ কাফিরুনের" কিছু অংশ তুলে ধরলাম। জানি তারা চুপ হবেনা, তারপরেও নিজের মনের শান্তির জন্যই লেখা -
"বলুন, হে কাফিরগণ!(এখানে বিধর্মীদের কথা বলা হচ্ছে) / তোমরা যার উপাসনা কর, আমি তার উপাসনা করিনা। / এবং আমি যার উপাসনা করি, তোমরাও তার উপাসনা করোনা। / তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্যে।"
এই সূরাহর মধ্য দিয়ে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, কেউ যদি আল্লাহতে বিশ্বাস করতে না চায়, না করুক। এবং কেউ যদি করতে চায়, তাহলে সে করুক। যার যার কর্মফলের জন্য কেবল সে নিজেই দায়ী হবে। আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিতে।
আরও সহজভাষায় বললে, "Take it easy. Chill!"
কথা প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় বলে লেখা শেষ করা যাক।
নাস্তিকগুরুরা আল্লাহ বা নবীজিকে(সঃ) আক্রমণ করে কথা বলে। সাধারণ মুসলমানদের বুকে বিঁধে, এবং রিঅ্যাকশন হিসেবে তারাও মুখ থেকে বুলেট ছুড়ে। কেউ কেউ তলোয়াড় নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ওদের মাথা ফেলে দেয়ার জন্য।
আপনি যদি আল্লাহকে মানেন, এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ মেনে চলেন, তাহলে কিন্তু এই কাজটি আপনি করতেন না।
আল্লাহ নিজেই বলেছেন, কাউকে তার দেবদেবী বা ধর্ম নিয়ে গালাগালি না করতে। এতে করে তারাও অজুহাত পাবে আল্লাহ এবং নবীজিকে (সঃ) গালাগালি করার। ধর্মে অবিশ্বাস করাটাই নাস্তিকদের 'ধর্ম।' কাজেই তাদের গালাগালির ব্যপারে সেই আল্লাহরই নিষেধ আছে।
আপনারা অবশ্যই হযরত উমারকে (রাঃ) চেনেন। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদের একজন, এবং জীবিত অবস্থাতেই বেহেস্তের সুসংবাদ পাওয়া দশজন সৌভাগ্যবানদের একজন।
তিনি ইসলাম গ্রহণের আগে যৌবনে কি ছিলেন সেটা কি কেউ জানেন? তিনি মূর্তিপূজক ছিলেন। তিনি অ্যালকোহলিক ছিলেন। এমনকি একজন 'womanizer'ও ছিলেন। একদিন তিনি হযরত মুহাম্মদকে(সঃ) খুন করতে তলোয়ার হাতে বেরিয়েও পড়েছিলেন।
নবীজির(সঃ) সাহাবীগণ ভয়ে ছিলেন আজকে বুঝিবা উমরের (রাঃ) হাতে মহা সর্বনাশ ঘটতে চলেছে। উমরের (রাঃ) মুখোমুখি দাঁড়াবার ক্ষমতা যে তেমন কারও ছিল না।
তাঁদের আশ্বস্ত করে হযরত হামযাহ (রাঃ) বলেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি, "যদি তাঁর উদ্দেশ্য সৎ হয়ে থাকে, তবে তাঁকে স্বাগত জানানো হবে। আর যদি উদ্দেশ্য অসৎ হয়ে থাকে, তবে তাঁর তলোয়ারেই তাঁকে বধ করা হবে।"
হযরত উমর (রাঃ) তলোয়ার হাতে ঘরে প্রবেশ করতে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর দিকে এগিয়ে যান। তাঁকে হাসিমুখে সালাম দেন। হযরত উমর (রাঃ) তাঁর তলোয়ার নবীজির (সঃ) পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে শাহাদাত পাঠ করেন।
এই সেই হযরত উমর (রাঃ) যাঁর জন্য মুসলমানেরা পরবর্তিতে প্রকাশ্যে আযান দেয়ার সাহস পেয়েছিল। এই সেই হযরত উমর (রাঃ) যিনি প্রতিদিন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন শুধু এই ভেবেই যে তাঁর রাজত্বে একটি কুকুর না খেয়ে মারা গেলেও যেখানে দায়ভার তাঁর উপরে বর্তায়, এবং কেয়ামতের দিন সেই কুকুরের মৃত্যুর জন্যও আল্লাহর কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে বলে!
এত লম্বা উদাহরণ টানার একটাই উদ্দেশ্য। আমরা জানিনা কার ভাগ্যে কি আছে। শুধু শুধু খুনাখুনি করে, গালাগালি করে নিজের গুনাহর ভাগ বাড়িয়ে লাভ কি?
ভিডিও দেখে আমি নিজেও একটা লেখা লিখেছিলাম। একটি পত্রিকা সেটা ছাপিয়েও ফেলেছে। সেই লেখাতেই দেখলাম কয়েকজন পাঠক তাদের উদ্দেশ্যে গালাগালি করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্যেই আজকের লেখা লিখলাম। তাঁদের মনে রাখা উচিৎ, ইসলাম হচ্ছে সেই ধর্ম যা রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহ স্বয়ং তুলে নিয়েছেন। দুই চারলাইন ফাজলামি কথাবার্তা এবং কুরআনের উপর কফির মগ রাখা ভিডিওতে তাঁর কিছুই হবেনা। বরং আল্লাহর নাম ভাঙ্গিয়ে মানুষ হত্যা করলে এর বেশি ক্ষতি হবে।
ভুলে গেলে চলবে না পবিত্র কুরআনের বাণী, লাকুম দ্বীনুকুম ওয়াল ইয়া দ্বীন। যার যার কর্মফল, তার তার উপরে।
সহজ কথায়, let's take it easy. Chill!
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৫৬