somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি অসমাপ্ত প্রেমের গল্প

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অসমাপ্ত কবিতা
- মঞ্জুর চৌধুর

"জোরসে বল!"
"হেইও!"
"আরও জোরে!"
"হেইও!"
একজন মহিলা বলে উঠলেন, "এই! পালকিওয়ালাদের ডাক কিন্তু এটা না।"
পালকিবাহক যুবকদলের একজন জানতে চাইলো, "তাহলে কী?"
মহিলা হাসতে হাসতেই বললেন, "জানিনা।"
"তাহলে এটাই সই! আরও জোরে!"
যুবক দ্বিগুণ উৎসাহে আওয়াজ দিল। তার দলও জোরে বলে উঠলো, "হেইও!"
সবাই খিলখিল করে হাসছে। যুবকদল কাঁধে পালকি তুলে নিয়েছে। যতটুকু ভেবেছিল, কাঠের পালকি আসলে তারচেয়েও ভারী। কাজেই তোলার সাথে সাথে টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল। লোকজন হায় হায় করে উঠতে না উঠতেই অবশ্য টাল সামলানো গেছে।
পালকির ভিতরে নববধূর সাজে নাতাশা বসে আছে। বিয়ের সাজে শাকচুন্নি পেত্নিকেও যেখানে সুন্দর দেখায়, নাতাশা সেখানে এমনিতেও রূপসী।
লাউড স্পিকারে উচ্চ ভল্যুমে গান বাজছে। লেটেস্ট কোন হিন্দি সিনেমার গান। একটা সময়ে আমার খুব হিন্দি গান শোনা হতো। এখন সেভাবে শোনা হয়না। তাই বুঝতে পারছি না কোন সিনেমার গান।
হিন্দি গানের সাথে পাল্লা দিচ্ছে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ।
ডজনখানেক তরুণ যুবক ডিএসএলআর ক্যামেরা হাতে নানান অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলে যাচ্ছে। ক্যামেরার সাথে ফ্ল্যাশ লাগানো। কারও কারও ফ্ল্যাশে আবার ডিফিউজারও আছে। একেবারে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার সব!
একটা সময়ে সব ছেলে হয়ে যেত কবি। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ, সেখানে কবিতার ডায়েরি। উদাস ভাবভঙ্গি। উরাধুরা কথাবার্তা। এমনকি একটা কথা পর্যন্ত চালু হয়ে গিয়েছিল যে, "ঢাকা শহরে কাক এবং কবির কোন অভাব নেই।"
মেয়েরা তখন কবিদের প্রেমে খুব পড়তো।
এরপর মেয়েরা ব্যান্ড শিল্পীদের প্রেমে পড়তে শুরু করে। দেশ ভরে যেতে থাকে ব্যান্ডশিল্পীতে। চুলতো লম্বা ছিলই, শুধু পাঞ্জাবি বদলে জিন্স টিশার্ট পড়তে হয়েছে। একটু গলার সাধনাও করতে হয়েছে। একটা গিটার, একটা কিবোর্ড ম্যানেজ করতে পারলেই হলো। খুলে ফেলা হতো ব্যান্ড দল। দেশের পাড়ায় পাড়ায় তখন ব্যান্ডদল। বেশিরভাগেরই দৌড় অবশ্য জন্মদিন বা গায়ে হলুদে কাভার সং গাওয়া পর্যন্তই ছিল।
এরপরে এলো মোবাইল ফোনের যুগ। সবার হাতে দামী দামী মোবাইল ফোন না হলে যেন চলেই না। মেয়েরাও দামী হ্যান্ডসেটওয়ালা ছেলে ছাড়া প্রেমে পরে না।
এবারে দেখি সবার হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা। সবাই ফটোগ্রাফার। মেয়েদের কি আবারও রুচীর পরিবর্তন ঘটেছে? তাঁরা আজকাল ফটোগ্রাফারদের প্রেমে পড়ছে? বেশ কিছু চ্যাংড়া ছেলেদের দেখি ক্যামেরা হাতে সুন্দরী মেয়েদের ছবি তুলতে শুরু করে দেয়। এই বাহানায় প্রেম হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিকতো কিছু নয়।
অনেকেই মোবাইল ফোন বের করে ফেলেছেন। মোবাইলে কেউ কেউ ছবি তুলছেন। কেউ কেউ ভিডিও। সবগুলোই স্মার্ট ফোন!
বাহ্ চমৎকার! এই ভিড়ে যদি কোন ছিনতাইকারী লুকিয়ে থাকে, তবে সে অনায়াসেই জেনে গেল আজকে রাতে কাদের কাদের রিকশা বা সিএনজি আটকাতে হবে।
মূল হলঘরে পালকিতে চড়ে নববধূর প্রবেশ ঘটতেই অতিথিরা হইহই করে উঠলো। বর নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কোন এক বন্ধু তাঁর কানে কানে কিছু একটা বললেন। তিনিও জবাব দিলেন। দুজনেই খুব হেসে দিলেন। কোন রসিকতা নিশ্চই। অশ্লীল হবার সম্ভাবনাই বেশি। এমন প্রাণখোলা হাসি কেবল অশ্লীল রসিকতাতেই আসে।
পালকিবাহকেরা ভিড়ের মধ্যে আবার টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল। সবাই আবার হায়হায় করে উঠার আগেই তারা সামলে ফেলে। আবারও সবার খিলখিল হাসি।
একজন বলে উঠলো, "সাবধানে বাবারা! খুব সাবধানে! দশটা না, পাঁচটা না, একমাত্র মেয়ে!"
তিনি সোবহান আঙ্কেল, নাতাশার বাবা। বরাবরই তাঁকে ভীষণ রাশভারী লোক হিসেবেই জানতাম। আজকে তাঁকে দেখছি ভিন্ন রূপে। আজকে তাঁর চেহারায় একই সাথে আনন্দ এবং বিষাদ খেলা করছে। সেখানে গাম্ভীর্য তেমন সুবিধা করতে পারছে না।
পালকিবাহকদের একজন বলল, "এই আস্তে! খালুর একমাত্র কইন্যা! কয়েকটা থাকলে ‘ইটা ইটি’ (ছোড়াছুড়ি) খেলা যাইতো।"
এমন কোন রসিকতা না। কিন্তু সবাই হোহো হেসে দিল। আজকে সবার মনেই খুব আনন্দ। শুধু হাসার জন্য অজুহাত খুঁজছে।
নাতাশার মাকেও দেখলাম ভীষণ ব্যস্ত। আমার সাথে যখনই দেখা হচ্ছে, তখনই তিনি বলছেন, "বাবা, একটু দেখোনা সব ঠিকঠাক আছে কিনা! আমার একার পক্ষ্যে সবটুকু দেখা কি সম্ভব? তোমাদের সাহায্য না পেলে যে আজকে কি হতো!"
আমি তখন তাঁকে আশ্বস্ত করি, "কোন টেনশন করবেন না আন্টি, আমরা আছি কিসের জন্য? আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে শুধু এঞ্জয় করুন।"
তাঁকে "এঞ্জয়" করতে দেখছি না। এই খাবারের খোঁজে ছুটছেন, তো একটু পরেই পাত্রপক্ষের খোঁজ নিতে ছুটে যাচ্ছেন। মেয়েবাড়ির অতিথিদেরও তাঁকেই সামলাতে হচ্ছে। পাত্রপক্ষের লোকজনদের চেয়েও এরাই তাঁকে বেশি প্যাড়া দিচ্ছে।
এইসব বিয়ে বাড়িটারির লোকজন সামলে আমি অভ্যস্ত নই। একটাই কারন। মানুষজনের কর্মকান্ডে অতি দ্রুত আমার মেজাজ খারাপ হয়।
আজকেও যেমন হলো।
একটি দুই বছরের শিশু খেতে গিয়ে বমি করে দিয়েছে। বাচ্চার মা বেচারী খুব শখ করে দামী শাড়ি পড়ে এসেছিলেন। শিশুর বমিতে সেই শাড়ি এখন মাখামাখি।
তিনি বাথরুমে গিয়ে যে শাড়ি ধুবেন, সে কাজটিও করছেন না। কারন ধুলে নাকি শাড়ি দ্রুত নষ্ট হয়। ড্রাইক্লিনার্সে পাঠাতে হবে।
আপাতত তিনি টিস্যু পেপার দিয়ে বমি পরিষ্কার করতে ইচ্ছুক। কিন্তু টিস্যু পেপার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে শাড়িতে বমি শুকাতে শুরু করেছে। একবার শুকিয়ে গেলেই দাগ বসে যাবে।
ভিডিও ক্যামেরাওয়ালাও এমন বদ, এই সময়েই তাঁর সামনে এলো ভিডিও করতে। মহিলা তীব্র ঝাড়ি দিয়ে তাকে বিদায় করলেন।
তিনি তাঁর পুরো রাগটাই ঝাড়ছেন কন্যাপক্ষের ম্যানেজমেন্টের উপর।
"এটা একটা কথা হলো? এইভাবে কেউ অনুষ্ঠান আয়োজন করে? একটা 'ন্যাপকিন' নেই কোথাও! যতসব কান্ডজ্ঞানহীন!"
ভদ্রমহিলা বোধয় অ্যামেরিকা ফেরৎ। টিস্যুকে 'ন্যাপকিন' তাঁরাই বলেন। বাঙ্গালি 'ন্যাপকিন' বলতে একটাই বস্তু চিনে - সেটাও কেবল মেয়েরাই ব্যবহার করেন।
আমি দ্রুত একটি রুমাল হাতে এগিয়ে গেলাম। অতি ভদ্রভাবে বললাম, "আন্টি! আপাতত এটা দিয়ে মুছতে থাকুন। আমি 'ন্যাপকিনের' ব্যবস্থা করছি।"
মহিলা আমার কথায় বিষ্ফোরিত হলেন। বয়সে তিনি আমার চেয়ে খুব বেশি হলে দুইতিন বছরের বড় হবেন। তাঁকে কিনা আমি "আন্টি" ডাকছি! এই অপমান তিনি হজম করতে পারলেন না। আবার প্রকাশও করতে পারলেন না।
তিনি রাগে আগুন হয়ে বললেন, "এই রুমাল দিয়ে কি হবে? রুমাল দিয়ে বমি পরিষ্কার করা যায়? ফাজিলের মত কথাবার্তা!"
তিনি রুমাল ছুড়ে দিলেন। আমি চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপাতত মনে মনে ভীষণ সংগ্রাম করতে হচ্ছে যেন কোনভাবেই আমি কোনরকম বেয়াদবি না করে বসি।
আমাকে উদ্ধারে নাতাশার মা দ্রুত ছুটে এলেন। তিনি কাচুমাচু করে বললেন, "কি হয়েছে ভাবী?"
মহিলা এবারে তাঁর উপরে রাগ ঝাড়তে লাগলেন। আমার রাগ চড়তেই লাগলো। যেকোন সময়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারি। তাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম।
পালকি থেকে নামিয়ে নাতাশাকে মঞ্চে উঠানো হলো। জামাইবাবু স্বয়ং হাতে ধরে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। বেচারা মঞ্চে উঠার সময়ে এক ফাঁকে জুতা খুলেছিলেন। সেই জুতা গায়েব হয়ে গেছে। তিনি যখন জুতা খুঁজছিলেন, তখন মেয়েপক্ষ্যের একদল তরুণ তরুণী খিলখিলিয়ে বলে উঠলো, "জুতা খুঁজে লাভ নেই। জুতা পেতে হলে ক্যাশ লাগবে!"
বরের হয়ে তাঁর বন্ধু বলে উঠলেন, "চুরি করা মহাপাপ! মেয়ের বান্ধবীদের জুতা চুরির স্বভাব আছে, এটা জানা ছিল না।"
"আমরা চুরি করিনি, বাজেয়াপ্ত করেছি। এখন ক্যাশ দিয়ে জুতা ছাড়িয়ে নিয়ে যান!"
"কত দিতে হবে?"
"পঞ্চাশ হাজার!"
লোকটা কৃত্রিম হার্ট অ্যাটাকের অভিনয় করে বলল, "বাবারে! এই টাকায়তো আরও পাঁচটা বিয়ে করা যায়! শুধুশুধু জুতা ছাড়ায়ে লাভ কি?"
"তাহলে খালি পায়েই থাকেন।"
"আপনারা আপনাদের দুলাভাইকে খালি পায়ে রাখবেন? এই আপনাদের আতিথেয়তা?"
কথা এগুতে থাকে। ভিডিওম্যান ভিডিও করতে থাকেন। ক্যামেরাম্যান নানান অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলতে থাকেন। লোকজন আনন্দ করছে খুব। আজকে আনন্দেরই দিন।
আমি শাহীনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার ছোটবেলার বন্ধু। নাতাশার ফুপাতো ভাই।
পালকি বহন করে বেচারা খুব হাপিয়ে উঠেছে বুঝা যাচ্ছে। দম নিচ্ছে দ্রুত।
"তুই ঠিক আছিস?"
আমার প্রশ্নে সে খুব দ্রুত উত্তর দিল, "অবশ্যই ঠিক আছি। আমার আবার কি হবে?"
"না, এত ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছিস।"
"হ্যা, পালকিটা খুব ভারী ছিল কিনা।"
"ও আচ্ছা।"
শাহীন আবার বিড়বিড় করলো, "আমি ঠিক আছি। একদম ঠিক আছি।"
অনেক আগে একটা সিনেমায় শুনেছিলাম যে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তুটি হচ্ছে পিতার কাঁধে সন্তানের জানাজা। শাহীনকে দেখে বুঝলাম প্রেমিকের কাঁধে প্রেমিকার পালকিও কম ভারী নয়। নাতাশাকে যে সে এখনও ভালবাসে!
সেই ছোটবেলা থেকেই শাহীন আমার সাথে একই স্কুলে পড়ে।
আমরা যখন একই ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী ললনাটিকে ক্লাসের সব ছেলেরা ভালবেসে ফেলেছি, তখন শাহীন সেই মেয়েটির ব্যপারে ছিল চরম উদাসীন। তাঁর নাকি ভালবাসার মানুষ আছে; আরেকজন। আমরা যতই জিজ্ঞেস করি, সে কিছুতেই তার নাম বলে না।
সেই ক্লাস থ্রী থেকে শুরু। কিছুতেই জানতে পারলাম না মেয়েটির নাম। শাহীন সেই শৈশব থেকেই ভীষণ চাপা স্বভাবের।
অবশেষে ক্লাস নাইনে উঠার পর তার পেট থেকে কথা বের করা সম্ভব হলো। মেয়েটির নাম নাতাশা। সম্পর্কে তার মামাতো বোন।
মেয়ে আমাদের পাড়াতেই থাকে। একেবারে আমাদের পাশের বাড়ির। আমি তাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। দেখতে শুনতে আমার ক্লাসের প্রেমিকার মত সুন্দরী না হলেও নিতান্তই মন্দ না।
ওরা ভীষণ বড়লোক। শুনেছি ইংল্যান্ডে তাদের দুই তিনটা রেস্টুরেন্ট আছে। দেশেও বিভিন্ন জায়গায় তাদের ব্যবসা আছে। সেই সময়েই তাদের বাড়িতে টেলিফোন ছিল, এয়ার কন্ডিশনার ছিল, তিন তিনটা গাড়ি তাদের গ্যারেজে পড়ে থাকতো। এমনকি পার্সোনাল কম্পিউটারও ছিল!
আমরা বিপুলভাবে বন্ধুকে উৎসাহ প্রদান করলাম। ক্লাসের অন্যান্য ছেলের মত আমার প্রেমিকাকে যে সে পছন্দ করেনি, এতেই আমি খুশি! কম্পিটিটর একজনতো কমলো!
শাহীনের ছিল ভীষণ চাপা স্বভাব। আমাদের কাছেই যেখানে প্রেমের কথা স্বীকার করতে ছয় বছর লাগিয়ে দিল, সেখানে মেয়েটিকে বলতে সময়তো নিবেই।
আমি রসিকতা করে বলতাম, “মেয়েটাকে সময় মত না বললে কিন্তু অন্য কোথাও প্রেম হয়ে যাবে।”
আমার নিজেরই তখন হৃদয়ে দগদগে ক্ষত। আমার স্বপ্নের প্রেমিকা তখন আমাদেরই ক্লাসের আরেক ছেলের সাথে প্রেম করছে! প্রতিদিন তাদের দুইজনকে ইশারায় কথা বলতে দেখাটা যে কতটা বেদনাদায়ক সেটা কিছুতেই বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
শাহীন চাপা হাসি হেসে বলতো, "সময় আসুক, ঠিকই বলবো।"
"সময় আসতে আসতে না আবার পাখি উড়ে চলে যায়।"
"ভয় নাই। নাতাশা কোথাও প্রেম করার মত মেয়ে না।"
শাহীন কেন সময় নিচ্ছিল পরে বুঝতে পেরেছিলাম।
যে ভুলটা আমিও করেছিলাম। তার ভয় ছিল নাতাশা না তাকে "না" বলে দেয়!
ভয়ের যথেষ্ট কারণও ছিল।
আগেই বলেছি, নাতাশারা ভীষণ ধনী। সেইদিক দিয়ে শাহীনরা মধ্যবিত্ত বললেও বাড়িয়ে বলা হবে। বেচারার বাবা চারটি সন্তান জন্ম দেয়া ছাড়া জীবনে তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেননি। টুকিটাকি ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন, সবগুলোতেই ভীষণভাবে মার খেয়েছেন।
“প্রেম ধনী-গরীব ব্যবধান মানেনা” - এসব কথা নাটক-সিনেমা-কিংবা গল্পের বইয়েই বেশি দেখা যায়। শাহীন এসব রূপকথায় বিশ্বাস করতো না।
তার বোধয় একটি আশাই ছিল, কোন একদিন তারা বড়লোক হবে, কোন একদিন সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, কোন একদিন সে গিয়ে নাতাশার বাবার কাছে গিয়ে বলতে পারবে "আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।"
বড়লোক হবার ইচ্ছে শাহীনের বাবারও ছিল। আন্টি একবার বলেছিলেন, আঙ্কেল নাকি তাঁর স্বল্প বেতনের চাকরির শুরু থেকেই প্রতি মাসে বেতনের টাকা পেয়ে একটি করে লটারি কিনতেন। তাঁর আশা ছিল কোন একদিন তাঁর ভাগ্য ফিরবে। লটারিতে তিনি লক্ষাধিক টাকা জিতবেন। তাঁর সংসারের হাল ফিরবে।
ভাগ্যও মাঝে মাঝে মানুষের সাথে খুব নিষ্ঠুর রসিকতা করে।
অফিসের এক কলিগের ছেলের জন্মদিনে তিনি উপহার হিসেবে তাঁর সংগ্রহ থেকে কিছু প্রাইজবন্ড দিয়েছিলেন। ভাগ্য কতটুকু খারাপ হলে সেই প্রাইজবন্ডেই কলিগ পঞ্চাশ হাজার টাকা জিতে গেলেন!
অফিসের সবাইকে লাঞ্চ খাওয়াতে খাওয়াতে সেই কলিগ উৎফুল্ল স্বরে বলছিলেন, "উপহার সবাই দেন, কিন্তু কিছু উপহার মানুষের মাথা নষ্ট করে দেয়। যেমন আমার হয়েছে! হাহাহা।"
বাবার মত শাহীনেরও হয়তো কোন লটারী জেতার আশা ছিল। চাপা স্বভাবের ছেলেতো, কখনই আমাদের বলেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা বেশ কিছু বন্ধু চলে গেলাম বিদেশে। শাহীন দেশেই থেকে গেল। পড়াশোনায় সে যে খুব মেধাবী ছিল, তা বলা চলে না। সে ভাগ্য মেনেই নিয়েছিল। সাধারণ কোন এক বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে সাধারণ কোন এক পদেই সে চাকরিতে যোগ দিবে।
একটা চাকরি পেয়ে নাতাশাকে গিয়ে বলবে, "আমি তোমাকে ভালবাসি, সেই শৈশব থেকেই। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিছুতেই নয়। তুমি আমাকে বিয়ে করলে আমার জীবন ধন্য হয়। একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিয়তা দিতে পারি, জীবনেও তোমাকে কখনও ভালবাসার ঘাটতি অনুভব করতে দিব না।"
আশেপাশের কিছু প্রেম কাহিনী তখন সে দেখে ফেলেছে।
অতি ধনীর দুলালী কিছু মেয়ে অতি সাধারণ চাকরিজীবি কিছু ছেলের সাথে দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে। এসব ঘটনাই তার মনে ধীরেধীরে সাহস দিচ্ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই সে শেয়ার মার্কেটে যোগ দিয়েছিল। কম দামে কিছু শেয়ার কিনে কয়েকদিন পরেই বেশি দামে বিক্রি করে ফেলা!
বাহ্! দারুন লাভের ব্যবসাতো!
দ্রুত উপার্জনের নেশা তাকে পেয়ে বসে। শেয়ারের দাম যতই বাড়তে থাকে, ততই তার পুঁজির পরিমানও বাড়তে থাকে। এমনকি একটি সেমেস্টারের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে সেটাও শেয়ার বাজারে খাটিয়ে ফেলে। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে নাকি সে অনুমতি নিয়ে রেখেছিল, ফাইনালের আগে টাকা পরিশোধ করতে পারলেই হবে।
আমাদের তখন বলতো, "আরে দারুণ লাভ হচ্ছে ব্যাটা! সেমেস্টার শেষ হতে হতে এই টাকা দুই তিনগুণ বেড়ে যাবে!"
একই সাথে তখন দেশে এমএলএম কোম্পানিরও ব্যবসা রমরমা। এতটাকা দাও, এত দিন শেষে এত টাকা বুঝে নাও। শাহীন সেখান থেকেও বেশ কিছু টাকা কামাতে শুরু করলো। শেয়ার মার্কেটে তখনই ধ্বস নামে। সেমেস্টারের টাকা গচ্ছা যায়। তার ফাইনাল দেয়া হয়না। তবু তার কোন টেনশন নেই। আমাদের বলতো, "আরে এমএলএম কোম্পানি আছে না? শেয়ার মার্কেটের লস তুলে আনা ওয়ান টুর ব্যপার হবে! আর পড়ালেখা করে শুধুশুধু চাকরি করে কিই বা হবে? আসল ইনকাম ব্যবসায়! খুব দ্রুতই আমি গাড়ি-বাড়ি কিনতে যাচ্ছি, তোরা দেখে নিস।"
পকেটে ক্যাশ টাকা মানুষের কনফিডেন্স বাড়াবার অব্যর্থ ওষুধ।
একটা সময়ে সরকার এমএলএম কোম্পানিতেও তালা ঝুলিয়ে দিল।
শাহীন তারপরেও আশাহত হয়নি। বলতো, "আরে ব্যপার না। আদালতে কেইস চলছে। অতিদ্রুত রায় হবে। আমরা আমাদের টাকা ঠিকই ফেরত পাবো।"
সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া হয়না।
পরে জানতে পারলাম সেখানে নাকি নাতাশার বাবারও বেশ কিছু টাকা লগ্নি ছিল। শাহীনই আঙ্কেলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিনিয়োগ করিয়েছিল।
সাগর থেকে এক বালতি পানি সরিয়ে নিলে কিছুই ক্ষতি হয়না। কিন্তু যার সম্বলই এক বালতি পানি, তার সর্বস্ব হারিয়ে যায়। আঙ্কেল নিজের লোকশানকে উপেক্ষা করে উল্টো শাহীনকে সান্তনা দেন। মনে সাহস আনতে বলেন। কিন্তু সে যে ততক্ষণে হবু শ্বশুরের কাছে একটা 'গুড ফর নাথিং' প্রমাণিত হয়ে গেছে! সেটার পরিবর্তন হবে কিভাবে?
শাহীন শুকনো মুখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যায়। একটা সময়ে সাধারণ গ্রেড নিয়ে পাশও করে। কোথাও চাকরি হয়না। টিউশনিই তখন ভরসা।
যেদিন একটি বেসরকারী ব্যাংক থেকে চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পায়, সেদিনই নাতাশার বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে জার্মানিতে থাকে। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেছে। পিএইচডি। সেখানেই হেনকেল কেমিক্যাল কোম্পানিতে কাজ করছে। জগৎখ্যাত কোম্পানি!
এই ছেলের মাথায় চুলের অভাব থাকলেও বিদ্যা এবং অর্থবিত্তের যে অভাব নেই সেটাতো প্রমাণিতই।
সে হিসেবে শাহীন সম্পূর্ণ ব্যর্থ এক যুবক। নাতাশাকে তার মনের কথা বলার সাহস করেনা।
নাতাশার বিয়ের কথা যখন পাকাপাকি হতে চলেছে, তখনও আমি শাহীনকে বলি, "এখনও সময় আছে। বলে ফ্যাল।"
শাহীন তার স্বভাবসুলভ বলে উঠে, "বাদ দে। এখন কিছুই হবার নেই।"
আমি আঙ্কেলের সেই লটারির উদাহরণটা টানি, "প্রাইজবন্ডের পঞ্চাশ হাজার টাকার লটারির কথা মনে আছে? এবারও জীবনের সবচেয়ে বড় লটারীতে তোর নাম উঠতে পারে, কিন্তু এইবারও যদি সেটা অন্যের হাতে থাকে, তাহলে চলবে?"
শাহীন খুবই বিরক্তভাবে বলল, "তুই টুকিটাকি লেখালেখি করে সাহিত্যিকদের মতন কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছিস। জীবন গল্প না বন্ধু। লটারিতে মানুষের নাম একবারই উঠে। বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই উঠেনা। আমি সেই দুর্ভাগাদের দলে।"
"চেষ্টা করে দেখ। ক্ষতিতো নেই। হয়তো নাতাশাও তোকে ভালবাসে। হয়তো সব ছেড়ে তোর হাত ধরে বেরিয়ে আসবে।"
"ওকে ওর বাড়ি থেকে বের করে এনে আমি কোথায় তুলবো?"
শাহীনের গলা জীবনে এই প্রথম চড়তে দেখলাম।
সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "আমার পুরো বাড়িও তার বেডরুমের চেয়ে ছোট। সে পারবে আমার বাড়িতে এসে থাকতে? আমি পারবো তাকে সুখী করতে? গরীবের ছেলের স্বপ্নে রাজকন্যাদের স্থান দিতে নেই। আমি বেকুব, আমি বুঝিনি।"
আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই হুল্লোড় করে উঠলো।
আমি তাকিয়ে দেখি বরের জুতা হাতে উল্লাস হচ্ছে। তাহলে জামাই বাবুকে আরেক দফা ‘ছিল’ দেয়া সম্পন্ন হলো? আহারে বেচারা! এই কিছুক্ষণ আগেই গেইট ধরায় একটি বিশাল অংকের টাকা গচ্ছা দিয়েছিলেন। এখন জুতা চুরিতে। সামনে যে আর কি অপেক্ষা করছে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই চুপচাপ হয়ে গেলেন। কাজী সাহেবকে স্থান করে দেয়া হলো।
রেজিস্ট্রি খাতা হাতে কাজী সাহেব উপস্থিত হয়েছেন।
তিনি একমনে কোরআন শরীফের কিছু সুরাহ পাঠ করছেন। মেয়েরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে তেলাওয়াত শুনছেন। ছেলেদের চেহারাও গম্ভীর।
একটা সময়ে তিনি ছেলের কাছে গিয়ে নাতাশার বিস্তারিত পরিচয় ও মোহরানা বলে জানতে চাইলেন, "আপনি কি এই বিয়েতে রাজি?"
নাতাশাকে ফিরিয়ে দিবে এমন কলিজা কয়টা ছেলের আছে?
"রাজি।"
"আবার বলুন, আপনি রাজি?"
"রাজি।"
"মাশাআল্লাহ। আরেকবার বলুন। আপনি রাজি?"
"রাজি!"
"সকলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ! আপনি এখানে সই করুন।"
আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলতে বলতে জামাইবাবু কাবিনে সই করলেন।
এবারে মেয়ের পালা।
শাহীন তখনই পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করলো। আমি তার হাত চেপে ধরে বললাম, "কোথায় যাচ্ছিস?"
"একটু কাজ আছে, আসছি।"
তার গলা ধরে এলো।
আমি তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছি। সে আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। দৃঢ়ভাবে ঠোঁট কামড়ে রেখেছে। চোয়াল শক্ত।
সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। তাই এইটুকু অনুগ্রহ আমি তাকে করলাম। আমি তাকে যেতে দিলাম।
সে ছুটে যাচ্ছে ছেলেদের টয়লেটের দিকে। ভিড়ের জন্য বারবার বাঁধা পাচ্ছে। তাকে আমি চিনি। মানুষের সামনে চোখের পানি ফেলার ছেলে সে না। কিছুতেই চোখের বাঁধ ভাঙ্গতে দিবেনা। অথচ এই মুহুর্তে সেই বাঁধ ভাঙ্গাটা ভীষণ জরুরী।
"আলহামদুলিল্লাহ! সকলে হাত তোলেন।"
আমি ফিরে তাকালাম।
নাতাশা কবুল বলে ফেলেছে। তিনবার কবুল বলার মধ্য দিয়ে শাহীনের অব্যক্ত প্রেম-কাব্যের সমাপ্তি টানা হলো। আমি তার ছোটবেলার সুহৃদ হবার পরেও কিছুই করতে পারলাম না।
কিসের এত দ্বিধা? কিসের এত সংকোচ থাকে, আমাদের মনে?
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×