somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"স্টিফেন হকিং সাহেব বাংলাদেশে জন্মালে এতদিনে গোরস্থানে ভিক্ষা করতেন"

২২ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"প্রেম-কাব্য"
- মঞ্জুর চৌধুরী

অনিক আজকে ক্লাসে যায়নি। জীবনে এই প্রথম ক্লাস ফাঁকি দিল। তাই তার মন সমান দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
ভাল অংশটা অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। বারবার বলছে, “কাজটা করা মোটেই উচিৎ হয়নি। এখনই ক্লাসে ঢুকে যাও। প্রফেসর যদি দেরীর কারন জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলবে কার পার্কিং স্পট পেতে দেরী হয়েছে।”
অতি সামান্য মিথ্যা বলা হবে, কি আর করার?
আরেক অংশ বলছে, খুব ভাল করেছিস! পুতুপুতু ভদ্রলোক হয়ে কোন লাভ আছে? মাঝে মাঝে দুয়েকটা ভুল কাজ না করলে চলবে? স্টুডেন্ট লাইফটা এঞ্জয় কর ব্যাটা!
আপাতত সে খারাপ অংশটার কথাই শুনলো। ঘুরে ঘুরে কলেজ ক্যাম্পাস দেখতে লাগলো।
বিশাল ক্যাম্পাস! অ্যামেরিকার সবকিছু এমনিতেই বিশাল! তারমধ্যেও টেক্সাসের সবকিছু আরও বিশাল। সাধে কি আর বলে, "Everything is big in Texas?"
অনিক সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে অ্যামেরিকা এসেছে। পরিবারের সাথে ইমিগ্র্যান্ট ভিসায়। তাদের বেশ কিছু আত্মীয় টেক্সাসে থাকেন। নতুন দেশ, তাই পরিচিত মানুষদের পাশে পেলে সুবিধা হবে ভেবে তারা টেক্সাসে এসে উঠেছে। থাকে বিখ্যাত নগরী ডালাসের পাশের শহর প্লেনোতে।
পড়ালেখা করার জন্য ভর্তি হয়েছে কলিন কাউন্টি কমিউনিটি কলেজে। দুইবছর পর ইউনিভার্সিটিতে ক্রেডিট ট্রান্সফার নিয়ে যাবে। সেখানে দুইবছর পড়লেই ব্যাচেলরস ডিগ্রী পাশ করে ফেলবে। এখানে ইউনিভার্সিটিগুলোতে টিউশন ফীস সাংঘাতিক এক্সপেন্সিভ! সেই তুলনায় কমিউনিটি কলেজগুলোয় নামমাত্র টিউশনে পড়া যায়। কাজেই প্রথম দুইবছর কোর কোর্সগুলো কলেজে নিয়ে নিলে অনেক টাকা সাশ্রয় হয়।
"কিরে, একাএকা ঘুরঘুর করছিস যে? ক্লাস নেই?"
অনিক চমকে তাকালো। জিসান ভাইয়া! অনিকের চাচাতো ভাই। সর্বনাশ! ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে কথাটা যদি বাসায় বলে দেয়, তাহলে কেয়ামত হয়ে যাবে!
"ইয়ে, মানে, ইয়ে.....এখন ক্লাস নেই। আরও একঘন্টা পরে ক্লাস।"
অনিক অতি কষ্টে 'বাক্য রচনা করলো।' মিথ্যা কথা সে একদমই বলতে পারেনা।
"ও আচ্ছা।"
জিসান ভাইয়ের গলা নির্বিকার।
"ভালই হলো, আমারও ক্লাস শুরু হতে দেরী আছে। চল ক্যাফেতে যাওয়া যাক।"
"চলো যাই।"
অনিকের মনে খুব আনন্দ হলো। যাক! জিসান ভাইয়া তার কথা বিশ্বাস করেছে। তার শরীর শিহরিত হচ্ছে। প্রথমে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে, এখন মিথ্যা বলে পারও পেয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, "জগতের সকল আনন্দ পাপে" - কথাটা মিথ্যা নয়!
"কি খাবি বল?"
"তুমি যা খাবে সেটাই খাব। আমার কোন ধারনা নেই।"
"ফিলি চিজ স্টেক স্যান্ডউইচ খাওয়া যাক। খেয়ে দেখ কেমন। সাথে কার্লি ফ্রাইজ নিচ্ছি। এদের কার্লি ফ্রাইজ বিখ্যাত।"
"সাথে কোক নিবেনা?"
জিসান ভাই ভর্ত্সনা করলেন, "খবরদার! এখানে কোন ফাস্টফুডে গিয়ে ফাউন্টেন ড্রিংকস কেনার বেকুবামি করবিনা। এক গ্লাস কোক এরা দেড়-দুই ডলার চার্জ করে, আর বাইরে পাঁচ ডলারে চব্বিশ ক্যান কোক পাওয়া যায়। কি পরিমাণ প্রফিট মেক করে বুঝতে পারছিস?"
অনিক মাথা উপর নিচ নাড়ে।
"অ্যাকাউন্টিং-ফাইনেন্স নিয়ে পড়াশোনা করিতো, তাই 'কস্ট কাটিং' রক্তে মিশে গেছে। তুই আবার আমাকে কিপ্টে ভেবে বসিস না।"
অনিক বিব্রত হাসি হেসে বলে, "না না, ছিঃ ছিঃ! কিপ্টা ভাববো কেন?"
তারা দুজনে ক্যাফেতে বসে নাস্তা খেতে লাগলো।
জিসান ভাই ঠিকই বলেছিলেন। খাবার আসলেই মজার আছে। বিশেষ করে কার্লি ফ্রাইজ। আলুকে যে এইভাবে স্প্রিংয়ের মতন প্যাঁচিয়ে কেটে তেলে ভাজা যায়, এই ধারণাই তার ছিল না।
"তা, নতুন দেশে নতুন ক্লাস করতে কেমন লাগছে?"
"ভালই।"
"প্রফেসরদের সব কথা বুঝতে পারিস?"
"অ্যাকসেন্ট বুঝতে একটু সময় লাগছে।"
"সেটা কোন ব্যপার না। কয়েকদিন ক্লাস করলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন বল, কোন মেয়ের সাথে পরিচয় টরিচয় হয়েছে? প্রেমের কথা বলছি আর কি। হাহাহা।"
অনিক ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল।
"আরে না, ছিঃ ছিঃ! মেয়েদের সাথে পরিচয় হবে কেন?"
জিসান হাসি থামিয়ে সামনে ঝুকে এসে বেশ সিরিয়াস গলায় বলল, "তাহলে কি তোর ছেলেদের ভাল লাগে? I see. কোন সমস্যা নাই, আমি টিপিক্যাল বাঙ্গালিদের মত না। I completely understand. ইনফ্যাক্ট আমারই কয়েকজন ‘গে’ বন্ধু আছে, তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।"
"আল্লাহ! ছিঃ ছিঃ ভাইয়া! তুমি ভুল বুঝছো। মানে আমি ‘গে’ না, মানে আমার মেয়েদের সাথে মিশতে লজ্জা লাগে। কথা বলতে পারিনা, জড়িয়ে যায়।"
"ও আচ্ছা বুঝেছি। টিপিক্যাল বাঙ্গালি ভদ্র ছেলে, তাই তো? সামনা সামনি মেয়েদের সাথে কথা বলবে না, কিন্তু আড়ালে চোখে এক্সরে মেশিন নিয়ে ঘুরবে! কিন্তু তোমাকে যে ভদ্রতার মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বাছাধন! এদেশে এসে যদি তুমি কারও সাথে কথা না বলো, সেটাকেই বরং অভদ্রতা বলবে। এদেশের মেয়েরা একদমই দেশের মেয়েদের মত না। এখানে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মেয়ের সাথে যদি তোর চোখাচোখি হয়, তাহলে দেখবি ও তোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবে। এরমানে কিন্তু এই না যে সে তোর প্রেমে পড়ে গেছে। উল্টো না হাসলে বরং অভদ্রতা ধরা হয়।"
অনিক লজ্জিতভাবে মাথা নাড়ে।
কথা সত্য। কলেজে স্বল্পবসনা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী মেয়েদের ছড়াছড়ি। সে বাঙ্গালি কায়দায় ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরমাঝে চোখাচোখি হলে মেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসে। সে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেয়। দেশের মেয়েরা এই কাজ কখনও করেনা। তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছেলেটিকে যদি মনে মনে তারা পছন্দও করে, তবু তার দিকে এমন একটা দৃষ্টি দিবে যেন খুব বিরক্ত হয়েছে। ওদেরই বা দোষ কি? ওরা হাসলে ছেলেরা নির্ঘাৎ ভেবে বসবে, মেয়েটা তার সাথে 'লাইন মারছে।'
ঠিক এই সময়ে তাদের পাশ দিয়ে হুইল চেয়ারে করে দুইজন ছেলে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। অনিককে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিসান ভাই জিজ্ঞেস করেন, "কি দেখছিস?"
অনিক বলল, "একটা ব্যপার লক্ষ্য করলাম। এখানে অনেক প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী আছে। আমাদের দেশের সাধারণ স্কুল কলেজে এতোটা দেখা যায়না।"
জিসান ভাই ভুরু কুঁচকে বললেন, "প্রতিবন্ধীদের সাথে পড়ালেখা করতে কি তোর কোন আপত্তি আছে?"
অনিক সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলে, "না না না, আমার আপত্তি থাকবে কেন? বলছি যে এইদেশে এত প্রতিবন্ধী, অথচ আমাদের দেশে কিন্তু তেমন নেই।"
জিসান ভাই এবারে গলার স্বর পাল্টে বললেন, "অ্যামেরিকার জনসংখ্যার কতভাগ মানুষ প্রতিবন্ধী জানো?"
অনিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে জানেনা।
"শতকরা বারো ভাগের মতন। আমাদের দেশের হিসেব জানো?"
অনিক এইবারও চুপ।
"সঠিক হিসাব আমিও জানিনা, তবে সেটা যে অ্যামেরিকার চেয়ে কম হবেনা, সেটা আমি নিশ্চিত। এখন কথা হচ্ছে, কেন আমরা সাধারণ স্কুল কলেজে, বা অফিস আদালতে প্রতিবন্ধীদের দেখি না? প্রতিবন্ধী কেবল রাস্তায় দেখা যায়, ভিক্ষা করতে। আর বাকি যারা ভিক্ষা করেননা, তাঁরা না পাড়তে ঘর থেকেই বেরোন না। মনে প্রশ্ন জাগে না, কেন?"
অনিক বুঝতে পারছে জিসান ভাই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন। গলার স্বর ক্রমেই সিরিয়াস হচ্ছে। ‘তুই’ বাদ দিয়ে ‘তুমি তুমি’ করে বলছেন। সে বুঝতে পারছে না কথার প্রসঙ্গ পাল্টানো উচিৎ হবে কিনা।
"আমি যখন দেশে পড়াশোনা করতাম, তখন শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুলে পড়ালেখা করেছি। শহরের সবচেয়ে ভাল কলেজেও আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ্য শিক্ষা জীবনে একটাও প্রতিবন্ধী ছেলে অথবা মেয়েকে আমার সাথে ক্লাস করতে দেখিনি। ওরা ক্লাস করবে কিভাবে? ওদের ভর্তিই হতে দেয়া হতো না। আমার মা নিজে ছিলেন এক প্রাইভেট স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। কোন শারীরিক প্রতিবন্ধী যখন ভর্তি হতে আসতো, তখন অন্যান্য গার্জিয়ানরা তাঁর উপর প্রেশার দিত তাকে ভর্তি না করতে। এতে নাকি তাদের বাচ্চাদের উপর নেগেটিভ প্রভাব পড়বে। একটি ছেলে হাঁটতে পারেনা বলে হুইল চেয়ার ব্যবহার করছে, এতে নেগেটিভ প্রভাব পড়ার কি আছে? মাই ফুট!"
জিসান ভাই গলা ভিজাতে পানির গ্লাসে চুমুক দিল। অনিক এখনও বুঝতে পারছে না সে কি বলবে। তার নিজের অভিজ্ঞতাও তেমন। ছোটবেলায় তাদের পাশের বাড়িতে একটি অন্ধ ছেলে থাকতো। প্রতি বিকেলে তাদের একতলার বারান্দায় বসে কান পেতে বাইরের শিশুদের খেলাধুলার শব্দ শুনতো। আপন মনেই হাসতো।
একদিন অনিকরা দল বেঁধে ছেলেটির সাথে বন্ধুত্ব করতে গেল। নতুন বন্ধু পেয়ে ছেলেটার যে কি আনন্দ!
রাতে খাবার টেবিলে নতুন বন্ধুর কথা মা বাবাকে বলতেই তাঁরা দুজনই ভীষণ ক্ষেপে গেলেন।
বাবা বলে উঠলেন, "খবরদার! তোমাকে যদি আর কোনদিন ঐ কানার সাথে কথা বলতে দেখি, থাবড়ায়ে দাঁত ফালায় দিব!"
বাবাকে এত কুৎসিতভাবে কথা বলতে সে কখনই শুনেনি।
মার গলা অবশ্য কোমল ছিল, কিন্তু বক্তব্য একই।
"সুন্দর সুন্দর ছেলেদের সাথে মেলামেশা করবে। ভাল ভাল ছাত্রদের সাথে মিশবে। নাহলে বড় হয়ে রিকশা চালাতে হবে।"
মার কথাও কেমন অদ্ভূত! "ভাল ছাত্রদের সাথে মিশবে।" কোন ছেলে যদি তার সাথে কথা বলতে আসে, সে কি হাই হ্যালোর আগে ছেলের রিপোর্ট কার্ড দেখতে চাইবে? এভাবে বন্ধুত্ব হবে? হওয়া সম্ভব?
পরদিন বিকেলে অন্ধ ছেলেটা ‘নতুন বন্ধুদের’ সাড়াশব্দ পেয়ে তাদের নাম ধরে ডাকছিল। কিন্তু কেউই এগিয়ে যায়নি। সবাই বাড়ি থেকে বকা খেয়েছিল।
এরপরও সেই ছেলেটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের খেলাধুলার শব্দ শুনে আপনমনে হাসতো। যতদিন তারা সেই বাড়িতে ভাড়াটে ছিল, ততদিন এই ঘটনা ঘটতো।
"ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে প্রতিবন্ধীদের প্রতি করুণা করতে। ভালবাসতে শেখানো হয়নি। ওদের করুণা করতে হবে কেন? সঠিক এক্সেস পেলে আমাদের ছাড়িয়ে যাবার ক্ষমতা তারা রাখে, এটা কি কেউ জানেনা? আসল প্রতিবন্ধী আমাদের দেশের সমাজ। বুঝলি?"
যাক, জিসান ভাইর উত্তেজনা কমতে শুরু করেছে। তিনি আবার 'তুমি' থেকে 'তুই'তে নেমে এসেছেন।
"দেশের বেশিরভাগ স্কুল কলেজে তুই দেখবি সিড়ির পাশাপাশি কোন 'Ramp' আছে। এলিভেটর থাকতো দূর কল্পনা। হুইল চেয়ারে কেউ থাকলে উপরতলায় উঠবে কি করে? অফিস আদালতেও একই সিস্টেম। প্রতিবন্ধীদের সুবিধা অসুবিধার কথা কেউ মাথাতেই রাখেনা। আরে, একটা লোকের চোখ নষ্ট হতে পারে, সে হাঁটতে নাও পারে, হয়তো কথা না বলতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাঁর ব্রেইনতো মরে যায়নি। সে কেন আর সব সাধারণ ছেলেমেয়েদের সাথে একই স্কুলে, একই কলেজে পড়তে পারবে না? আমাদের দেশে কয়জন প্রতিবন্ধী উচ্চশিক্ষিত হবার সুযোগ সুবিধা পান? এখানে সবার আগে প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রাখা হয়। ডিজেবল পার্কিংয়ে সুস্থ কেউ কোন অবস্থাতেই গাড়ি পার্ক করতে পারবে না। চাকরির ক্ষেত্রে ডিজেবিলিটি কোন অবস্থাতেই প্রতিবন্ধকতা নয়। সব প্রতিষ্ঠানেই সিড়ির পাশাপাশি ramp'র ব্যবস্থা থাকে। এলিভেটর থাকে। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসে সীট বরাদ্দ থাকে। কিন্তু ভিড়ের বাসে সেই প্রতিবন্ধী লোক উঠবেন কি করে সেইটা নিয়ে কেউ ভেবেছে? এখানে বাস ট্রেনেও ওদের ওঠার সুন্দর ব্যবস্থা থাকে। স্টিফেন হকিংয়ের ভাগ্য ভাল যে তিনি ইংল্যান্ডে জন্মেছেন। আমাদের দেশে জন্মালে উনি কিছুই করতে পারতেন না। কে জানে, বনানী গোরস্থানের বাইরে কতটা সম্ভাব্য স্টিফেন হকিং "আল্লাহ আল্লাহ" করে ভিক্ষা করে জীবন কাটাচ্ছে!"
জিসান ভাইয়ের কথায় অনিক হেসে দিল। সে কল্পনার চোখে দেখেও ফেলেছে নিউটন-আইনস্টাইনের পর বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং সাহেব মাথায় ছেড়া টুপি পড়ে জিকির করতে করতে ভিক্ষা করছেন।
"হাসছিস কেন? আমি মোটেও জোক করছি না। আমি কিন্তু সিরিয়াস।"
"স্যরি ভাইয়া। তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। এই হাসি সেই কারনে নয়।"
"একজন মানুষের একটি অঙ্গহানী ঘটলে যে তার জীবন থেমে যেতে পারেনা, এই উপলব্ধি এদেশের মানুষেরা পায়। আমাদের দেশের সমাজ উল্টো সেই প্রতিবন্ধীকে চিরদিনের জন্য 'পঙ্গু' বানিয়ে দেয়। সে একা একা কিছুই করতে পারেনা, অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। আরে, দেশের মোট জনসংখ্যার বারো তের পার্সেন্ট মানুষকে তোমরা শুইয়ে বসিয়ে রাখছো, দেশ এগুবে কি করে? ওয়েস্টার্ন ইকনোমি যে বিশ্বের সেরা, সেখানে কি শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অবদান নেই? অবশ্যই আছে। এবং সেটা এরা স্বীকারও করে।"
ঠিক তখনই একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে এসে পেছন থেকে জিসান ভাইয়ের চোখ চেপে ধরলো। জিসান ভাই হাত ধরে তাকে সামনে নিয়ে এলেন। তারপর ইশারায় উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বললেন, "হাই!"
অনিকের বুক মুচড়ে উঠলো। আহারে! তাকেও যদি কখনও এমন সুন্দরী কেউ কোনদিন এসে চোখ চেপে ধরতো!
জিসান ভাই বললেন, "পরিচয় করিয়ে দেই, অনিক এ হচ্ছে ডারলা, আমার বান্ধবী।"
তারপর তিনি ডারলাকে ইশারায় কিছু একটা বললেন। ডারলা তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে "হাই" বলল।
শৈশবে এক বর্ষাকালে অনিক তার গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। সেদিন মধ্যদুপুরে আকাশ অন্ধকার করে টিনের চালে ঝমঝম সুর তুলে বৃষ্টি নেমে এসেছিল। মেয়েটির হাসি সেই বৃষ্টির কথা মনে করিয়ে দিল।
অনিক লজ্জা মাখানো স্বরে বলল, "হ্যালো! তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম।"
জিসান ভাই সরল গলায় বললেন, "ও কথা বলতে ও শুনতে পায়না।"
ডারলা কি বুঝলো সেই জানে, সে আবারও হাসলো। অনিকের বুকটা আবার মুচড়ে উঠলো। এবার ভিন্ন কারনে।
তাহলে এই সেই মেয়ে যাকে নিয়ে তাদের পরিবারে তোলপাড় চলছে।
সেদিন আম্মা, চাচি, ফুপুরা মিলে একটা ‘রুদ্ধদ্বার বৈঠকে’ বসেছিলেন। সে পানি খেতে দরজার পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনেছে জিসান ভাই নাকি এক শ্বেতাঙ্গিনী পেত্নীর প্রেমে পড়েছেন। মেয়েটা বিদেশিনী, ইহুদি-নাসারা ধর্মী এসবের সাথেও তাঁর আরও একটা বড় খুঁত, সে শারীরিক প্রতিবন্ধী। “বোবা – বয়রা!”
মেয়েটি নাকি জিসান ভাইকে জাদু করেছে। নাহলে কেন কিছুতেই এতএত সব খুঁত তার চোখে পড়ছে না? কেন সেই মেয়ের কাছ থেকে তাকে ছাড়ানো যাচ্ছে না?
অনিক উপলব্ধি করলো এই মেয়ে আসলেই জাদু জানে। এই হাসিকে জাদু না বললে আর কি বলা হবে?
জিসান ভাই কিছুক্ষণ ইশারায় কথা বললেন ডারলার সাথে। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজও একটি ভাষা, সেটা জিসান ভাই ভালই রপ্ত করেছেন। দিব্যি কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। বোধয় রসিকতা করছেন, ডারলা কিছুতেই হাসি থামাতে পারছে না।
দুইজনের কথোপকথন দেখতে ভালই লাগছে। দুজনকে মানিয়েছেও ভাল! ডারলাকে দেখে কাজী নজরুল ইসলামের গানটা মনে পড়ে গেল। "মোমের পুতুল, মোমের দেশে যায় নেচে যায়..."
জিসান ভাই বললেন, "এভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছিস কেন? ভাবি পছন্দ হয় নাই?"
অনিক বলে ফেলল, "অবশ্যই পছন্দ হয়েছে! আমি নিজেই ভাবির প্রেমে পড়ে গেছি!"
জিসান ভাই সেটা হয়তো ডারলাকে ইশারায় বললেন। ডারলাও কিছু একটা বলল, জিসান ভাই হাসতে হাসতে বললেন, "ও বলছে, বড্ড দেরী করে ফেলেছিস। তার কোন বোন নেই। এখন আরেকটা বোন জন্ম দেয়ার জন্য তার মার বয়স পেরিয়ে গেছে।"
অনিক হো হো করে হেসে দিল। হবু ভাবির রসবোধ তার ভালই লেগেছে।
ডারলা ইশারায় জানালো যে সে এখুনি আসছে।
ও সরে যেতেই জিসান ভাই বললেন, "এই মেয়ের সাথে আমাকে পালিয়ে বিয়ে করতে হবে, বুঝলি। আমার পরিবার কোনদিন মেনে নিবেন না। কারন সে কথা বলতে পারেনা। আরে বাপ, ও কথা বলতে পারলেই বা কি এমন ঘোড়ার আন্ডা ফলে যেত? আমার মায়ের ইংরেজির দৌড় জানিস না? একটা বাক্য বলতে গেলেই বত্রিশটা দাঁত ভেঙ্গে ফেলেন। ওতো বলছে না যে তোমরা তার মত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলতে পারো না, কাজেই তোমরাও প্রতিবন্ধী! আর তাছাড়া আমি যদি তার সাথে দিব্যি ইশারায় কথা বলতে পারি, সে যদি আমার সাথে কমিউনিকেট করতে পারে, তাহলে বাকিদের প্রবলেমটা কি?"
অনিক বলল, "ঠিক। কিন্তু তাঁর সাথে তোমার কোথায় পরিচয় হয়েছে?"
ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিং ক্লাসে। আমার পাশেই বসেছিল। লেকচারার যা বলছিলেন, সব তার ল্যাপটপে লিখিত আকারে ফুটে উঠছিল। দারুন সফটওয়্যার! সেটা দেখেই ইন্টারেস্টেড হয়ে কথা বলতে এগিয়ে যাই। আসলে ওটা ছিল স্রেফ একটা বাহানা। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি। তারপর জানলাম সে কথা বলতে পারেনা। এরপরের সেমেস্টারেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস নিয়ে নিলাম। তার জন্মদিনে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলে তাকে চমকে দিলাম। সেদিনই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে তাকে ভালবাসা প্রপোজ করলাম। ও আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি।"
জিসান ভাই তাহলে এই মেয়ের কারনেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ক্লাস নিয়েছিলেন? সে তখন ভেবেছিল স্প্যানিশ না শিখে শুধু শুধু এই ভাষা শিখে কি লাভটা হবে?
"ও কিন্তু ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী! সিজিপিএ ফোর! তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে!"
অনিক হেসে বলল, "সিজিপিএ ফোর! বাবারে! তোমার কত?"
জিসান ভাই কৃত্রিম রাগী গলায় বললেন, "বেকুব ছেলে কোথাকার! খবরদার কোন ছেলের কাছে জীবনেও তার সিজিপিএ জানতে চাইবি না। মার খেয়ে বসতে পারিস!"
হাসির মাঝেই ডারলা ফিরে এলো। হাতে সালাডের প্লেট। লাঞ্চে সালাড খাবে। শুধু লতাপাতা খেয়ে কারও পেট ভরে? অ্যামেরিকানদের হয়তো ভরে। বাঙ্গালিদের কাছে ভাত ছাড়া অন্য যেকোন কিছুই 'নাস্তা।'
তারা দুজন ইশারায় প্রেম করতে লাগলেন। অনিক বুঝতে পারলো তার উঠে যাবার সময় এসেছে। সে ক্লাসের বাহানায় উঠে এলো।
ডারলা তাকে ইশারায় বলল, "আবার দেখা হবে।"
সেও বলল, "অবশ্যই।"
জিসান ভাইকে দেখে মনেই হয়না যায় যে মেয়েটির শারীরিক দূর্বলতা তিনি পরওয়া করেন। এটা সত্য ডারলা প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ার মতন একটি মেয়ে। এও সত্য যে যখন কোন সুস্থ্য ছেলে জানতে পারবে মেয়েটি মূক ও বধির, তখনই তার প্রেম উড়ে চলে যাবে। রূপবতী নারীর অভাব এইদেশে অন্তত নেই। জিসান ভাই দেখতেও কম আকর্ষনীয় নন।
অথচ তিনি মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে ইশারায় কথা বলা শিখে ফেলেছেন!
তিনি মেয়েটিকে করুণা নয়, ভালবেসেছেন; তাঁর হৃদয়কে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এখানে উহ্য। তিনি এখন এই মেয়েটির সান্নিধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ!
অনিকের হঠাৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়ে গেল। সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করার জন্য তখন বিদ্যাসাগর মশাই জোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। একটা সময়ে তিনি তাঁর নিজের একমাত্র পুত্রের বিয়েও কিন্তু একজন বিধবার সাথেই দেন।
বাংলার প্রাচীন সমাজ বদলেছে বিদ্যাসাগর মশাইদের মতন মহান মহান লোকেদের কারনেই।
অনিকের মনে হলো আল্লাহ যুগেযুগে বিদ্যাসাগর মশাইদের ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনেন। এইযুগে হয়তো জিসান ভাইয়ের রূপে ফিরিয়েছেন। তার জিসান ভাইও পারেন সমাজের অনেক ভ্রান্তরীতি বদলে অবদান রাখতে। এই সমস্ত লোকেদেরই মন থেকে সালাম দিতে ইচ্ছে করে।
অনিক পেছনে ফিরে তাকালো। তারা দুজন গুটুর গুটুর প্রেম করছেন। ভাই রসিকতা করেই চলেছেন, হবু ভাবী হেসেই চলেছেন। হাসির দমকে তাঁর আর সালাড খাওয়া হচ্ছে না।
আহা! কি পবিত্র দৃশ্য! তোমাদের সালাম!

লেখকের আরও লেখা পড়তে যোগ দিন:
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১২:৩৪
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×