ধরুন আমি একটা রচনা লিখছি, যেটার মূল বিষয় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভাল নয়।
আমি নজরুলের কবিতার দুটি চরণ লিখলাম, "গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান....."
পাঠক বাহ বাহ দিয়ে উঠবেন।
এরপর আমি লিখলাম সাইজি বলেছেন, "...আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বলো না..." চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।
"সাধু! সাধু!!"
অথচ যেই আমি বলবো চৌদ্দশ বছর আগে মুহাম্মদ (সঃ) বলেছিলেন, "কোন আরবের উপর কোন অনারবের এবং কোন অনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর চেয়ে সাদা এবং কোন সাদার চেয়ে কোন কালো শ্রেষ্ঠ নয়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর কর্মফলের উপর নির্ভর করবে।"
ঠিক তখনই হায় হায় রব উঠে যাবে।
"মৌলবাদী!"
"ছাগু!"
"কুসংস্কারি!"
"ঘেউ! ঘেউ!! ঘেউ!!!"
বিরোধিতাকারীদের আসলে সমস্যা কোথায়? লেখার মূল বিষয় ঠিকই আছে। লেখার কোথাও বলা হচ্ছেনা কলিমা পড়ে মুসলমান হও, নামাজ পড়ো, যাকাত দাও। কিচ্ছু না। উদাহরণ দেয়া হচ্ছে একজন "মানুষের" যিনি কোটি কোটি মানুষের কাছে অনুকরনীয় চরিত্র।
আমাদের কী "কী" বলা হচ্ছে সেটা নিয়েই মাথা ঘামানো উচিৎ না? "কে" বলছে, সেটা নিয়ে ফালতু কথাবার্তা শুরু করে দিয়ে মূল বিষয় থেকে বহুদূর ছিটকে আসার কী মানে হয়?
কথা প্রসঙ্গেই বলি। সেদিন এক পরিচিত ভদ্রলোক মুখ বাঁকিয়ে বললেন, "আমি কোন ধর্মকর্ম মানিনা। আমি আগে 'মানুষ' হতে চাই।"
কথাটা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মানে কী? আমি কী তবে "মানুষ" না?
"ধর্ম মানেন না, খুব ভাল কথা। সেটা আপনার নিজস্ব ব্যপার। তবে আগে দেখা যাক আমাদের মধ্যে কে কতখানি 'মানুষ' হতে পেরেছি।"
ভদ্রলোক খুবই তৃপ্তির হাসি হাসলেন। হরিণশাবক দেখে বাঘের ঠোঁটে যে অদৃশ্য হাসি ফুটে উঠে।
"এখন রমজান মাস চলছে, আপনিতো জানেনই আমরা কেন রোজা রাখি।"
"অবশ্যই। কতটা অস্বাস্থ্যকর একটা ব্যপার। সারাদিন না খেয়ে থাকা। তুমি জানো এতে শরীরের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়?"
"নিজের শরীরের ক্ষতির সাথে "মনুষ্যত্বের" সম্পর্ক কোথায়? আমরা রোজা রাখি যাতে আমরা ক্ষুধার্তের কষ্ট নিজে উপলব্ধি করতে পারি। যাতে কখনও কোন ক্ষুধার্ত আমার কাছে খাবার চাইলে আমি তাকে মাফ 'করো' বলে তাড়িয়ে না দেই। আপনি স্বাস্থের দোহাই দিয়ে নিজে ভরপেট খেলেন, কিন্তু মানুষের জন্য কী করলেন?"
"ইয়ে...আমি দান করিতো। যখনই আমার কাছে কেউ খাবার চায়, আমি তাকে ফেরাই না।"
"আমার পরিবারের এক সদস্য শারীরিক অসুস্থ্যতার কারনে রোজা রাখতে পারেনা। বিনিময়ে আমরা পুরো মাসের জন্য তিরিশজন নিরন্ন মানুষকে ভরপেট খাওয়াই। তুমি বছরে কয়জন ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দাও?"
কথা বলতে বলতে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলাম।
"ইয়ে, দিইতো। আমিও খাওয়াই। সুযোগ পেলেই খাওয়াই।"
"বছরে একবার আমরা নিজের সম্পদের আড়াই পার্সেন্ট বিনা শর্তে দান করে দেই। একশ টাকায় আড়াই টাকা শুনতে কম মনে হলেও যার সম্পত্তির পরিমান এক লাখ ডলার, তাকে আড়াই হাজার ডলার গরিব মানুষের কল্যানে স্রেফ দান করে দিতে হচ্ছে। বিনিময়ে সে কিছু চাইতে পারেনা। তুমি বছরে কতটাকা দান করো?"
"করি, আমিও দান করি। ইয়ে আমার তাড়া আছে, যেতে হবে।"
"আরে শুনেন ব্রাদার। আমাকে যখন 'অমানুষ' ডেকেই ফেলেছেন, তখন কিছু কথা না শুনিয়ে ছাড়ছি না। কুরবানির ঈদে আমরা আমাদের জবাই করা মাংসের তিনভাগের দুই ভাগই আত্মীয় স্বজন এবং গরিব মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেই।"
"ধর্মের নামে পশু হত্যা করো, আবার সেটাকে জাস্টিফাই করো?"
"তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেন তুমি ভেজিটেরিয়ান? প্রতিদিন যে বিফ আর চিকেন খাও, তার জন্য কী প্রাণীগুলোকে 'হত্যা' করা হয়না? তার উপর তোমার হত্যা করা প্রাণীর পুরোটাই তুমি একা খাও। যেখানে আমরা অন্যদেরকে দিয়ে খাই। তাহলে 'মানুষ' কে হলো?"
"যাও যাও। আমার এখন এইসব ফালতু কথা শোনার সময় নাই।"
"তোমার পকেট থেকে অন্যের জন্য একটা পয়সা বেরুতে চায়না, তুমি "দান করি" বলে চাপাবাজি করো? তোমার বাড়িতে গেলে অতিথিকে একা বিস্কিট খাওয়াতেও তোমার কলিজা ছিড়ে যায়, তুমি বলছো তুমি ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দাও? আমার সামনে অন্তত ফাপরবাজি কম করবা। তোমাকে আমি সেই ছোটবেলা থেকে চিনি।"
"তোমরা ধর্মের নামে মানুষ খুন করো। আইসিস, বকো হারাম, আল কায়েদা এইসব তার প্রমাণ!"
"অনেক নাস্তিকই ইনসেস্ট প্রথাকে(নিজের আপন মা-বোন-মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন) সমর্থন করে। তুমিও কী তাই?"
"মুখ সামলে কথা বলো!"
"তুমিও মুখ সামলাও! পুরো পৃথিবী জুড়ে মুসলিম জঙ্গিবাদির মোট সংখ্যা কত হবে? এককোটি? দুই কোটি? পৃথিবীতে এক বিলিয়নের বেশি মুসলমানের বাস। তোমরা আইসিস নিয়েই বসে আছো। শোন, এইসব মানবতা ফানবতা থিওরি আমার সামনে কপচাতে এসো না। তোমাকে আমি ভাল করেই চিনি। ক্ষুধা সহ্য করতে পারোনা তাই রোজা রাখো না বললেই হয়। কিপটামির কারনে যাকাত দিতে চাওনা বললেই হয়। অন্যের সাথে 'অনৈতিক' সম্পর্ক করতে চাও বললেই হয় - শুধু শুধু 'মানবতার' মুখোশ পড়ার কোন মানে হয়না।"
ভাই তরিঘরি করে সরে গেলেন। তাঁকে আর মা বাবার অধিকার ব্যখ্যা করা হলোনা। পরিবারের প্রতিটা সদস্যের অধিকারের ব্যপারটাও ব্যাখ্যা করা হলো না। সমাজের অধিকারের কথা বলা হলো না। প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যপারটা ব্যাখ্যা করা হলো না।
"অভুক্ত প্রতিবেশী রেখে নিজে ভরপেট খাওয়া যায়না।" এই নিয়ম যে মানেনা, তাকে "মানুষ" কিভাবে বলা যায় জানিনা।
বিদেশে অভুক্ত প্রতিবেশী পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু তাতেও কাজটা সহজ হয়ে যায়না। বাড়িতে লাউডস্পিকার ব্যবহার করতে পারবো না। এতে তাঁদের সমস্যা হতে পারে। নিজের বাড়ির আবর্জনা তাঁদের বাড়িতে ফেলতে পারবো না। তাঁদের যেকোন বিপদে আমাকে এগিয়ে যেতেই হবে। ধ্যাৎ! ধর্ম একটা খুবই ফালতু বিষয়। মানুষকে "মানুষ" হতে শিখায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৬