যখন প্রথম প্রথম অ্যামেরিকায় আসি, ওয়ালমার্টে কাজ করতাম তখন। ওয়ালমার্টে শিকারের বন্দুক বিক্রি হয়, শিকারের লাইসেন্স বিক্রি হয়। আমি নিজেই কতজনের লাইসেন্স করে দিলাম। মাছ শিকারের লাইসেন্সের এক ফী, হরিণ, শূকর,পাখি ইত্যাদি শিকারের লাইসেন্সও আলাদা ফী।
যতদূর মনে আছে এক লাইসেন্সে দুই হরিণ, দুই শূকর, কয়েকটা খরগোশ এইরকম সংখ্যা বেঁধে দেয়া থাকে। বেশি শিকার করে ফেললেই জেল-জরিমানা ইত্যাদি ঝামেলায় পড়তে হয়।
তখন ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা শেষ করে বন্দুক কিনে শিকারের লাইসেন্স নিয়ে নিব। ব্যাপারটা আমার ভারতীয় গুজরাটি ম্যানেজারকে বলতেই সে বললো, "সাদা চামড়ার লোকেদের মতন এই শখ দেখি তোমারও আছে।"
শখটা শুধু সাদা চামড়ার লোকেদেরই নেই। আমার পরিচিত কিছু বাঙালি ভাইয়েরও আছে। তাঁরা মাঝে মাঝেই দল বেঁধে যেন। শিকার করে ফেরেন। আমার বাবারও শখ ছিল শিকারের, যদিও জীবনেও তিনি একটা পাখিও শিকার করতে পারেননি। নিশানা বরাবরই খারাপ ছিল তাঁর।
আব্বু বেড়াতে আসার পর একবার বলেছিলাম একদিন শিকারের লাইসেন্স নিয়ে আমরা বনে শিকার করতে যাব। তাঁরও আগ্রহ ছিল। হয়ে উঠেনি। তিনি মারা গেলেন, এবং আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমার বৌ আমার বন্দুক কেনার শখের কথা শোনার সাথে সাথে বলল, "ঘরে যদি বন্দুক আসে, তাহলে সেই বন্দুক দিয়ে সবার আগে আমি তোমাকে খুন করবো।"
কথা ভুল বলেনি। অ্যামেরিকায় বাড়িতে বাড়িতে বন্দুক রাখাটা মহা যন্ত্রনায় পরিণত হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা বাবা মায়ের বন্দুক নিয়ে স্কুলে গিয়ে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলছে। এই গতকালকেই যেমন মেরিল্যান্ডে এক মহিলা গুলি করে তিনজনকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে। প্রতিবছর শ খানেক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এই দেশে। শখানেক লোক মারা যায় এইসব ঘটনায়। সরকার চাইলেও কিছু করতে পারেনা, কারন তাদের পকেট ভারী হয়ে থাকে NRA (National Rifle Association) এর টাকায়। মানুষকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করে, "mass shooting এর জন্য ভিডিও গেম্স্ দায়ী।" কিংবা "লোকটা ডিপ্রেশনে ছিল, তাই এমন কাজ করেছে। একটু ভালবাসা পেলে হয়তো সে গুলি চালাতো না।" কিংবা "আসলে ওতো ছিল মানসিক রোগী। একারনেই এই কাজ করেছে।"
যাই হোক, আমার বাড়িতে আর বন্দুক আসেনা। লাইসেন্সও নেয়া হয় না।
মাছ শিকারের লাইসেন্সও নেই না। এর পেছনে দুইটি কারন আছে।
কারন নম্বর এক, আমি মাছ খাই না। বাড়িতেও খুব আগ্রহ করে রুই-কাতলা-ইলিশ জাতীয় দেশি মাছ খাওয়া হয়। অ্যামেরিকান মাছে আমার মা বৌয়ের আগ্রহ নেই। কাজেই মাছ মারা হলে সেটা আত্মীয় বন্ধুবান্ধবে বিলিয়ে দেয়ার জন্যই মারা হবে।
কারন নম্বর দুই, খুব ভোরে গিয়ে মাছ মারতে হবে। এত ভোরে সাধের ঘুম ভেঙে অফিসেই যেতে ইচ্ছে করেনা, আর অন্যকে গিফট দেয়ার জন্য মাছ মারা!
যাই হোক - অ্যামেরিকায় শিকার করা খুবই সাধারণ ঘটনা। এখানে শিকারের আলাদা মৌসুমই আছে। হরিণ বা বন্য প্রাণীগুলোর সংখ্যা ঐ সময়ে ঐ এলাকায় অতিরিক্ত হারে বেড়ে যায়, এবং তখন শিকারিদের সুযোগ দেয়া হয় শিকারের মাধ্যমে সেই সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে। ইকো ব্যালেন্স নিয়ে এখানে দারুন গবেষণা চলে। কিছুতেই প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতে দেয় না এরা।
একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন।
ইয়েলো স্টোন পার্ক বলে এখানে একটি ন্যাশনাল ফরেস্ট আছে। চারটি স্টেট বা রাজ্য জুড়ে এর অবস্থান। বিশাল এলাকা! আমরা সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম গত বছর। পৃথিবীতেই স্বর্গের সৌন্দর্য্য এবং নরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা পেতে চাইলে অবশ্যই এই অঞ্চলে লোকজনের ভ্রমন করা উচিৎ।
একদিকে ঘন সবুজ অরণ্য, বহতা পাহাড়ি ঝর্ণা, আগ্নেয়গিরির লাভা জমাট বেঁধে অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে পায়ের নিচে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির অবস্থান। মাটির নিচে প্রচন্ড তাপমাত্রায় ফুটন্ত পানি ও লাভার বিকট শব্দ, বেরিয়ে আসা কুয়াশার মতন ধোঁয়া, এবং সেই ধোঁয়ায় উৎকট রাসায়নিক গ্যাসের গন্ধ - ইত্যাদি নরকের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই পার্কে গেলে অবশ্যই বাইসন দেখতে পাওয়া যায়। রাস্তার পাশে স্বপরিবারে চড়ে খাচ্ছে। কিছু হরিণও নজরে আসে। এরাও দল বেঁধে চড়ে খায়। ভাল্লুকের দেখা পেতে হলে ভাগ্য ভাল হতে হবে। তিন চারদিনের সফরে আমাদের ভাগ্য কেবল একবার সুপ্রসন্ন ছিল। জংলী ভালুক দেখেছিলাম সেদিন।
কথা হচ্ছে স্রেফ তৃণভোজী প্রাণী থাকার ফলে ওরা সব ঘাস এবং তৃণ খেয়ে সাফ করে দিচ্ছিল। এতে ইকোসিস্টেমে সমস্যা হচ্ছিল। পার্ক কর্তৃপক্ষ তখন পার্কে কিছু নেকড়েবাঘ ছেড়ে দিল। নেকড়ের দল হরিণ বাইসন শিকার করে ইকো সিস্টেমে ব্যালেন্স ফিরিয়ে আনলো। কিছু কিছু অঞ্চলে গাছ বড় হবার সুযোগ পেল। নদীর গতিপথ পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে গেল স্রেফ কয়েকটি নেকড়ে বাঘ ছেড়ে দেয়ার কারনে।
কাজেই, ইকোসিস্টেম ধরে রাখতে হলে আপনাকে মাঝে মাঝে কিছু তৃণভোজী নিরীহপ্রাণী হত্যা করতেই হবে। নাহলে সেটা প্রাকৃতিক ভারসাম্যেরই ক্ষতি করবে।
একটি ভিডিওতে দেখলাম বাংলাদেশের সুন্দরবনে চোরা শিকারিরা অবাধে হরিণ মেরে সাফ করে দিচ্ছে। টিভি সাংবাদিক গিয়ে তেমনই এক চোরা শিকারির সাক্ষাৎকারও নিয়ে এলেন, একদম মৃত হরিণ সহ। এই ঘটনা এইটাই প্রমান করে যে ঘটনাটি কত সহজে কত নিয়মিত হারে ঘটছে।
সুন্দরবনের হরিণ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং দামি হরিণের অন্যতম। আমাদের বুনো বাঘের সংখ্যা ব্যাপকভাবে নির্ভর করে এই হরিণের উপর। হিসেব সহজ। হরিণের সংখ্যা বেশি হলে বাঘ সহজে শিকার করতে পারবে। বাঘের খাওয়া খাদ্য পর্যাপ্ত হলে বংশ বিস্তার ভাল হবে। এবং বাঘের সংখ্যাও বাড়বে। বাঘের সংখ্যা বেড়ে গেলে হরিণের উপর আক্রমণ বেশি হবে। হরিণের সংখ্যা তখন কমবে। তখন বাঘের খাদ্য সংকট হবে। বাঘের সংখ্যা আবার কমে যাবে। এইভাবেই দুনিয়া চলছে সেই আদিযুগ থেকে।
এখন হরিণের উপর চোরা শিকারিরা যদি হামলা করা শুরু করে, তাহলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। বাটারফ্লাই এফেক্টের মতন, জলচ্ছাস, বন্যা, সাইক্লোন ইত্যাদির কারনও এই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। সামান্য মাংসের লোভে আমরা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি নিয়ত।
ছোটবেলায় পড়েছিলাম হাতিয়ায় নাকি হরিণের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে স্থানীয় কৃষকরা বিরক্ত ছিলেন এদের যন্ত্রনায়। তাঁদের কষ্টের ফসল খেয়ে সাফ করে দেয় হরিণ। সেক্ষেত্রে বনকর্মকর্তারা কাউকে কাউকে শিকারের লাইসেন্স দিতে পারতেন। অথবা বিপুল পরিমান হরিণ সরিয়ে নিয়ে সুন্দরবনে ছেড়ে দিতে পারতেন। জানিনা এখনও সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে কিনা।
তবে সুন্দরবনে এই অবাধে হরিণ নিধন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। চোরা শিকারী ধরা খাওয়ার পরে কিভাবে এত সহজে মুক্ত হয়ে যায় বুঝিনা। অ্যামেরিকার ওকলাহোমায় একটি চিড়িয়াখানা আছে যেখানে রেসকিউড বাঘ লালন পালন করা হয়। মানে হচ্ছে চোরা পথে অবৈধভাবে অ্যামেরিকায় আসা বাঘগুলোকে ধরে এনে এখানে লালনপালন করা হয়। শুনে অবাক হবেন যে প্রায় পনেরোটির মতন বাঘ কেবল বাংলাদেশ থেকেই এসেছে। আমাদের বনের বাঘ আমাদের কাস্টম্স পেরিয়ে অ্যামেরিকায় এসে ধরা পড়ছে। কী অদ্ভুত শোনায় না? সুন্দরবনের রাজা যখন ওকলাহোমায় খাঁচা বন্দি হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়, তাদের দেখে বাঙালি হিসেবে দুঃখও হয়। কী করছে আমাদের বন্য প্রাণী অধিদপ্তর?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ভোর ৪:০৭