কাউকে কাউকে অভিযোগ করতে দেখি, "আমার দাদা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, তাহলে তিনি কেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন?"
কিংবা "আমার চাচী একজন পরম ধার্মিক নারী, তাঁর কেন তিনটি সন্তানই ছোট অবস্থায় মারা গেল?"
কেউ কেউ এও বলেন যে "যে ঈশ্বর তিন বছর বয়সী শিশুকে বোন ক্যান্সার দেয় - তাঁর অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করিনা।"
কথাগুলো আবেগে আক্রান্ত মানুষের। তবে অনেকে সিরিয়াসলিই এই কথা বলেন।
মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখা যাক।
এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সবাই তাঁকে নসিহত দেয়া শুরু করে দেয়, "পর্দা করলে ধর্ষণ হতো না। পর্দার ক্ষমতা অনেক।"
পর্দানশীন নারী ধর্ষিতা হলে, "তাঁর পর্দা সহীহ ছিল না, হলে তাঁকে কেউ ধর্ষণ করতো না।"
আগুন লেগেছে?
নসিহত আসে, "হে মানবসকল! নামাজ আদায় করো! নামাজ পড়লে আগুন লাগতো না।"
সমস্যা হচ্ছে দুই পক্ষই ধর্মটিকে এমনভাবে প্রচার করে যেন এটি মানুষকে কোন সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার দান করার অঙ্গীকারবদ্ধ। আমার সত্যিই খুব মেজাজ খারাপ হয় যখন দেখি লোকজন কোন অসুস্থ রোগীকে কোন বৃদ্ধ মুরুব্বির কাছে দোয়া পড়ে ফু দিতে নিয়ে যান। সেই মুরুব্বির কোয়ালিফিকেশন হচ্ছে "তিনি হজ্জ্ব করেছেন।" অথবা "তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন।"
সিরিয়াসলি?
যে নবীর (সঃ) নির্দেশনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত, সেই নবীর (সঃ) জীবনী কী ওরা জীবনেও পড়ে দেখে না? যদি পড়ে, তাহলেতো এই উজবুকীয় ধারণা মাথাতেই আসার কথা না।
নবীর জীবনই কেটেছে দুঃখে কষ্টে। পিতৃহারা হয়ে জন্মে জীবনের শুরুতেই মাতৃবিয়োগ ঘটে। এক শিশুর জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হচ্ছে পিতা অথবা মাকে হারিয়ে ফেলা। তিনি দুইজনকেই হারান। দাদাও মারা যান দ্রুত। ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার পরে যেই না নব্যুয়াতির সুসংবাদ পান, এরপরে তাঁর জীবনে ঘটতে থাকে একের পর এক দুর্যোগ। শুরু হয় দুই মেয়ের ডিভোর্সের ঘটনার মধ্য দিয়ে। বাবা মা মাত্রই জানেন নিজের মেয়ের সংসার ভাঙার ঘটনা কতটা বেদনাবিধুর। তারপরে হলেন সামাজিকভাবে বয়কট, নিজের চোখের সামনে নিজের ফলোয়ারদের নির্যাতনের শিকার হতে দেখা, নিজে লাঞ্ছনার শিকার হওয়া, নিজের পিতৃভিটা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে ভিনদেশে নিঃস্ব অবস্থায় আশ্রয় গ্রহণ। এর আগে প্রিয়তমা স্ত্রীর পরলোকগমন, পিতৃসম চাচার মৃত্যু। এবং নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে সন্তানদের মৃত্যু। একজন পিতার জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ কী? নিজের হাতে নিজের সন্তানকে কবর দেয়া। এরচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি কোন পিতার জীবনে আর কখনই আসে না।
যিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন। মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা যাকে মানবজাতির পথের দিশারী হিসাবে নির্বাচন করেছেন, তাঁকে কেন এত কষ্ট দেয়া হলো? আল্লাহর নির্দেশ মানতে গিয়েইতো এত ঝামেলার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। থিওরি অনুযায়ী, তাঁকেইতো পৃথিবীর সমস্ত সুখের উত্তরাধিকারী করার কথা। ভূলোক দ্যুলোকের সমস্ত ঐশ্বর্য্য তাঁর পায়ের নিচে লুটোপুটি খাওয়ার কথা। ঐশ্বর্যের কথা বাদই দিন, এই ভদ্রলোক নব্যুয়াতি লাভের পরে জীবনে একবেলাও ভরপেট খাবার খাননি। খেজুর পাতার বিছানায় শুতেন, উঠলে পরে তাঁর পিঠে দাগ লেগে থাকতো। মৃত্যুর আগে স্ত্রীর কাছে নিজের সম্পদের হিসাব চাইলেন। একটি গবাদি প্রাণী, এক থলেতে সামান্য বার্লি, এবং কয়েকটি সিকি পয়সা ছাড়া কিছুই নেই। তারপরেও স্ত্রীকে কঠিন নির্দেশ দিলেন, "সিকি পয়সাগুলো তুমি গরিবদের মধ্যে বিলি করার ব্যবস্থা করো। আল্লাহ আমার কাছে ওসবের হিসেব চাইলে, আমি কী জবাব দেব?"
তাঁর ফলোয়ারদের কথাও চিন্তা করুন।
বিলাল (রাঃ) ছিলেন হাবশী (আবীসিনিয়ান) দাস। যেই সময়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, তাঁর মালিক তাঁকে তপ্ত মরুভূমির উপর খালি গায়ে শুইয়ে আগুন গরম ভারী পাথর তাঁর শরীরে চাপা দিত। ইয়াসির-সুমাইয়াকেতো খুনই করা হলো। খাব্বাব ইবনে আরদের (রাঃ) মালিক তাঁর পিঠের উপর জ্বলন্ত কয়লা ঢেলে দিত। যন্ত্রনায় খাব্বাব কাতরে উঠলে বদমাইশটা আনন্দে হাতে তালি দিতে দিতে লাফাতো।
দল বেঁধে প্রতিটা মুসলিমকে বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি ফেলে সম্পূর্ণ নতুন দেশে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে বাধ্য করা হলো।
কুরাইশরা তখন এই কথাটাই বলতো যা উপরে উল্লেখ করলাম। "এখন তোমাদের আল্লাহ কই? যদি তিনি আসলেই সর্বশক্তিমান হতেন, তাহলে এসে আমাদের শাস্তি দিন, তোমাদের উদ্ধার করুন।"
সাহাবীগণ করুন চোখে তাকাতেন নবীর (সঃ) দিকে। নবীর অসহায়ত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন? তাঁর কথায় বিশ্বাস করে এই লোকগুলো এখন এই শাস্তি পাচ্ছেন। যে আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাঁদের আহ্বান করেছিলেন, সেই আল্লাহ কিছু বলছেন না, করছেনও না। নবীর হাতেও কোন ক্ষমতা নাই। ওদের প্রতিটা চাবুকের আঘাত তাঁদের পিঠে যতটা না ক্ষত সৃষ্টি করতো, তারচেয়ে বহুগুন বেশি রক্তপাত হতো আমার নবীর কলিজায়, প্রতিটা চাবুকের আঘাতে। তিনি কেবল বলে গেলেন, "ধৈর্য্য ধরো। নিশ্চই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।"
কুরআনের আয়াত নাজেল হয়েছে এই বিষয়ে।
সুরাহ আল আনকাবুতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ ব্যপারটা একদম স্পষ্ট করেন, "মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে "আমরা বিশ্বাস করি," এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে।"
আয়াতটি আরেকটু সহজে ব্যাখ্যা করি।
ধরেন, আমি অনেক বড়লোকের ঘরে জন্মেছি। আমার বন্ধু বান্ধবের অভাব কখনই হয়নি। রেগুলার পার্টি করি, প্রচুর খাবার দাবারের আয়োজন থাকে। আমার কোথায় লোকজন উঠে বসে। আমার এক কথায় মানুষের জীবন পাল্টে যায়। বন্ধুবান্ধব আমার উপর খুব খুশি। এবং যে কেউ আমার বন্ধুত্ব প্রত্যাশী।
এরা কী তবে আমার প্রকৃত বন্ধু?
না।
আসল বন্ধু তখন চেনা যাবে যখন আমি নিঃস্ব অবস্থায় থাকবো, এবং এরা আমার খোঁজ নিবে আমি ঠিকমতন খাওয়া দাওয়া করেছি কিনা। যদি না খেয়ে থাকি, তবে ওরা নিজের রুটির অর্ধেক ছিড়ে আমার পাতে তুলে দিবে। ঠিক বলেছি?
ছেলেটা "সুপারস্টার" হবার পরে যেসব বন্ধু পেয়েছে তাঁদের থেকে অনেক অনেক ভাল বন্ধু তাঁরা, যখন ছেলেটা পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমাতো এবং তারপরেও তাঁরা তাঁর বন্ধু ছিল।
ঠিক তেমনই, আল্লাহ কঠিন পরিস্থিতি এই কারণেই সৃষ্টি করেন, যাতে সত্য মিথ্যার পার্থক্য বুঝা যায়। আগুন দিয়ে না পোড়ালে সোনা খাঁটি করা যায় না। আপনিতো বললেই হলো না যে আপনি আল্লাহর একত্ববাদে, তাঁর ক্ষমতায়, তাঁর উদারতায়, তাঁর করুনায় বিশ্বাসী। আপনি কী আসলেই বিশ্বাসী কিনা সেটা আপনাকে প্রমান করতে হবেনা?
ইসলাম আপনাকে কোন সুপার পাওয়ার দিবেনা। কোন সুখের গ্যারান্টি দিবে না। আপনি অনাহারে থাকেন, ভাবলেন কলিমা পড়লেই আসমান থেকে ফেরেশতাকূল এসে আপনার জন্য সিলভার প্ল্যাটারে সী ফুড বাফে সাজিয়ে দিবে - যদি আপনি এই আশায় ঈমান এনে থাকেন, তবে দুঃখিত, আপনাকে খুশি করতে পারলাম না।
বরং জীবনে কষ্ট হবে প্রচুর। আপনার আগেও প্রতিটা মানুষকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, আপনার পরেও যেতে হবে।
আপনি বোরখা পড়লেই আপনার দিকে ধর্ষণের ইচ্ছায় এগিয়ে আসা জানোয়ার পাথর হয়ে যাবে - এইটা ঘটবে না।
আপনি নামাজ পড়েন বলেই আপনার বা আপনার সন্তানদের রোগবালাই হবেনা - এমন ঘটবে না।
এসবের বিরুদ্ধে দোয়া করতে পারেন, কিন্তু দোয়া কবুলের মালিক আল্লাহ, তিনি ইচ্ছা করলে রিজেক্টও করতে পারেন, এইটা মাথায় রাখতেই হবে। তবে আমাকে অবশ্যই সেই রিজেকশনের উপর আস্থা রাখতে হবে। মানতেই হবে যা আমার কাছে আপাত দৃষ্টিতে দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে, বাস্তবে সেটাই আমার কল্যাণের কারন হবে।
কুরআনের ঘোষণা এইটা, মিথ্যা হবার কোনই কারন নেই। বিশ্বের যেকোন সফল মানুষের জীবনী ঘাটুন, জীবনে ব্যর্থতা এসেছিল বলেই আজ তিনি সফল হয়েছেন। "ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অফ সাকসেস" - এটা ইসলামেরও বাণী।
সুসংবাদ হচ্ছে, যদি পরীক্ষায় পাশ করেন, মানে কঠিন পরিস্থিতিতেও আপনি আপনার ঈমান দৃঢ় রাখেন, আল্লাদি মার্কা ("ঈশ্বর দয়ালু হলে এই হলো কেন ওটা হলো কেন ব্লা ব্লা ব্লা") কথা না বলেন, তাহলে পুরস্কারও হাতে হাতেই পাবেন। বিলাল, খাব্বাব, আম্মার প্রমুখ সাহাবীদের জীবনের শেষ পরিণতি দেখে নিন।
তাহলে ইসলাম চর্চায় লাভ কী?
তার আগে উত্তর দেন, না চর্চা করে কী খুব বেশি লাভবান হচ্ছেন? এমনতো না যে আপনি ঈশ্বর অবিশ্বাসী হলে অমরত্ব লাভ করবেন। আপনার সব অভাব দূরীভূত হবে। আগুন লাগলে পুড়বেন না, জীবনেও ধর্ষিতা হবেন না। অসুস্থ হবেন না। আপনার পাশাপাশি আপনার গুষ্ঠির লোকজনও অমর হয়ে যাবেন। এগুলো কী ঘটে? না। ঐ আপনাকে একদিন মরতেই হবে। আপনার আত্মীয় স্বজনকেও মরতেই হবে। এইটা সম্পূর্ণই আপনার সিদ্ধান্ত, পরকালে আপনি কী লিমোজিনে যাবেন, নাকি পায়ে হেঁটে।
এত কথা যে বললাম, শেষে এইটাও বলি, যদি আসলেই আপনি আল্লাহ বিশ্বাসী হন, এবং সূক্ষ্মভাবে নিজের জীবন লক্ষ্য করেন, তাহলে অবশ্যই দেখবেন জীবনে মাঝে মাঝে মিরাকেল ঠিকই ঘটে। জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতির শিকার আপনি অবশ্যই হয়েছেন যখন আপনি হাল ছেড়ে দিয়ে ভেবেছেন এই বুঝি সব শেষ। এবং তারপরেই দেখবেন সাহায্য এমন কোথাও থেকে এসেছে যা আপনি আশাও করেননি। নবীর জীবনীর সবচেয়ে দুর্যোগময় পরিস্থিতির উদাহরণ দিয়েই লেখা শেষ করি।
তিনি তায়েফে ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে চরমভাবে লাঞ্চিত হলেন। মক্কায় ফেরার উপায় নেই। আবু জাহেল তার দলবল নিয়ে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বসে আছে। আবু লাহাব তাঁকে পরিবারচ্যুত ঘোষণা করায় বনু হাশিম তাঁকে রক্ষা করতে লড়বে না। এই অবস্থায় যাইদ (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, "ইয়া রাসূলুল্লাহ! এখন কী হবে?"
নবীজি (সঃ) বললেন, "আমি নিজেও জানিনা যাইদ, তবে এই বিশ্বাস
রাখো, আল্লাহ নিশ্চই কোন না কোন ব্যবস্থা নিবেন।"
এইটাই আমাদের ধর্ম ইসলাম। পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন, এই বিশ্বাস অন্তরে থাকতেই হবে যে আল্লাহ ঠিকই ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। ইহকাল এবং পরকাল - দুই কালেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:১১