somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেভাবে বেঁচে থাকতে হয়ঃ বেঁচে থাকার সহজ প্রনালী...

০৬ ই জুন, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরনে হাউস কোট, কোমরে ফিতা দিয়ে আঁটা, চুলের গোছা মাথার উপরে পনিটেইল করে বাধা—ছোট ফুফু ঘর গোছগাছ করছিল। ছুটির দিনের সকাল, ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে দুনিয়া ভেসে যাচ্ছে বসন্তের উদাস বাতাসে, একটা হিমভাব জড়িয়ে আছে বাইরের খোলা ছাঁদের নরম রোদে। ড্রইংরুমের সোফার গদি, কুশন, তাকিয়াগুলো টেনে টেনে রোদে দিচ্ছিলাম আমি—ছোট ফুফুর নির্দেশে—অনেকটা বাধ্য লেফট্যানেন্টের মতো। জেনারেল ছোট ফুফু আজ লেগেছে বাসার পেছনে, ড্রইংরুম থেকে বেডরুম—এ মাথা থেকে ও মাথা, সর্বত্র চলছে শুদ্ধি অভিযান......

ফুলের টবগুলো খোলা ছাঁদ থেকে সরানো, ছাদের ওপেন স্পেশটা একটু বাড়ানো—রাতের জন্য ছাদের কার্ণিশে বাড়তি আলোর ব্যাবস্থা করা...... আমার নিজের অনেক কাজ বাকী রয়ে গেছে। বিশেষ করে সব কাজ শেষ হয়ে গেলে, ছাদের ট্যাংকের কলে হোসপাইপ লাগিয়ে ‘তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে—স্টাইলে...... পুরো ছাঁদটা আমাকে ধুয়ে দিতে হবে, সন্ধ্যা ছয়টা বাজার আগেই...

আজ রাতের ভরা পুর্ণিমায়, এ ছাদে বসবে গানের আসর।

আমাদের এই বাড়ীটা উত্তরার ৫নম্বর সেক্টরের একদম শেষ মাথায়। আশেপাশের খালি প্লটগুলোতে কনষ্ট্রাকসন এর কাজ সদাই লেগে থাকে, আজ এই সাত-সকালে শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে তৈরী এক ধরনের ইট ভাঙ্গার মেসিনের ক্রমাগত আওয়াজে চারপাস সরগরম হয়ে আছে। এ বাসার পশ্চিম দিকের প্রায় লাগোয়া পাশের এই বাসাটাও চারতলা। তবে এই মুহুর্তে চারপাসের সব আওয়াজ ছাপিয়ে বাচ্চাদের চিল চিৎকার আর চেঁচামেচিতে সে বাসার ছাঁদ নরক গুলজার। প্রায় একই বয়সী বাচ্চাগুলো এক সাথে জড়ো হয়েছে, তাদের দাপাদাপি আর হুল্লোড়ে ফেটে পড়ছে খোলা ছাঁদ। সে সব আওয়াজে চমকে উঠে, পাশের ঝাকঁড়া গাছ্টা থেকে মাঝে মাঝেই ঝটপটিয়ে উঠছে কাকগুলো—কাঁ কাঁ শব্দে।

একটা হাত সর্টসের পকেটে, অন্য হাতটা কোমরে, ছাদের সিড়িঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে, পাশের ছাদের বাচ্চাদের হুটোপুটি দেখছিলাম। মুখে এক চিলতে হাসি, সে হাসির প্রস্থ কখনো বাড়ছিল, কখনো কমছিলো, মজাই লাগছিল পুলাপাইনের বাঁদরামী দেখতে। কতক্ষন ধরে চোখের কোনে রঙীন কোন কিছুর একটা নড়া চড়া টের পাচ্ছিলাম—ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নজরে এলো মেয়েটাকে। বাচ্চাদের লাফঝাঁপ আর চিৎকার, সব কিছু এড়িয়ে মেয়েটা দাড়িয়ে আছে উদাশ হয়ে, ছাদের রেলিং ঘেষে। চোখের দৃষ্টি আমার মাথার উপর দিয়ে উর্ধ্বাকাশে। সবুজ আর হলুদে মেশা টাই-ডাই এর ওড়না তার—বাতাসে উড়ছে...

বাঁ পা থেকে শরীরের ভার ডান পাঁয়ে নিচ্ছিলাম, মেয়েটা তখনই চোখ নামিয়ে তাকালো আমার দিকে, দুচোখে তার বিস্ময়ের ঝিলিক, কি যেন একটা বলতে গিয়ে তার ঠোট দুইটা ঈষৎ ফাক হলে আমি তার সাদা দাঁতের বিচ্ছুরনের আভাষ পাই।

—হেই জিশান, জিশান আলি... মেয়েটা চিৎকার করে ডাকে, আমার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে।

টের পাচ্ছিলাম আমার চওড়া হাসি, সঙ্কুচিত হয়ে আসছে ক্রমশঃ, শিথিল হয়ে আসছে দুই গালের মাংশ পেশি, সারা শরীরে আমার বাড়তি সতর্কতা......। সারা মুখে হঠাৎ করেই আমার নিমপাতা চিবানোর মতো তিতা। সকালের উদাস করা মৃদু সমীরন, চারদিকে আলো ঝলমলে এক সোনালী সকাল—দারুন উত্তেজনার বারুদে ঠাসা জমাটি একটা দিনের পুর্বাভাষ—সব কিছু নিমেষে উধাও।

আমার জোড়া কাঁধ ঝুলে পড়ে- অনির্দিষ্ট ভাবে ঐ ছাদের উদ্দেশ্য হাত নাড়ি, তারপর কিছুটা অবন্ধু সুলভ শরীরি ভাষায়—ব্যস্ততার ভঙ্গীতে এগিয়ে যাই সিড়িঁর দিকে, উদ্দেশ্য- স্রেফ কেটে পড়া।

তবে আমার ঘোর কাটছিল না, বিড়বিড় করে বলছিলাম-সব্বোনাস!!! কাকলী এখানে কি করে?? কখনো এর আগে তো দেখি নাই! কি বিপদ! আমারে খাইছে......


পুরবী সিনেমা হলের পরে ঢাল যখন পল্লবীর দিকে নামা শুরু করেছে, হাতের বাঁদিকে ডাঃ রুমা ঘোষের চেম্বার, এর পিছনের কয়েকটা বাসা নিয়েই হুমায়ুনদের মহল্লা, একটু ভেতর দিকে এগিয়ে গেলে নির্মানাধীন মসজিদের পাশে ছিল আমাদের আড্ডা। পল্লবীর পরিবেশ তখন ছিল অনেকটা মফঃস্বলের জিলা শহরগুলোর মতো, সবাই সবাইকে চিনে, রাস্তা ঘাটে, দোকানে বা বাসে—প্রচুর পরিচিত মুখ। সন্ধ্যার পর বাসার খালাম্মাবৃন্দ ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা গুলোতে হাঁটতে বেরোতেন, সহচর হিসাবে থাকতো (আমাদের হৃৎপিন্ড কাঁপিয়ে দেওয়া) তাদের সেই সব আদুরে কন্যারা। আমরা শ্রদ্ধা ভরে কপালে হাত ছুইয়ে সালাম দিতাম, আদুরে কন্যারা মায়েদের সাথে তাল মিলিয়ে ঘাড় নেড়ে আমাদের সালাম নিতেন......

অসহ্য তারুন্যের তুমুল সেই দিন গুলো আমরা কাটাতাম মহল্লার মেয়েদের ছোঁয়াবিহীন এক জীবন হিসাবে। আন্তঃলৈঙ্গিক বন্ধুত্ব ছিল অচেনা বস্তু। আমাদের তখন ছিল দু' গালের মসৃনতায় মাথা তুলে দাঁড়ানো লালচে ব্রণের যুগ, কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম আর ঘন হয়ে আসা নিঃশ্বাসে বিস্রস্ত এলোমেলো সেই অচেনা দুপুর গুলোর দিন। এটা ছিল সেই সময়, যখন আমাদের বালিকাদের পেতাম শুধু শেষ রাতের স্বপ্নে আর উদাশ করা কল্পনাতেই।

আমাদের প্রিয় বালিকারা থাকতো ভাল লাগা কোন মুভি অথবা উপন্যাসের পাতায়।

আমরা পাভেল করচাগিনের তানিয়াকে চিনতাম, দশটা মেয়ের মাঝখান থেকে বাঁচতে শেখা’র (মাকারেঙ্কো) সাশাকে আলাদা করতে পারতাম। পরিচয় ছিল পুর্ব জার্মানীর বর্ডার চেকপোষ্টের রুপবতী প্রহরী, কারবাইন কাঁধে এলটন জনের নিকিতা'র সাথে। প্রেটি ওম্যানের জুলিয়া রবার্টস কিংবা ডার্টি ড্যান্সিং এর জেনিফার গ্রে ছিল আমাদের আড্ডার নিয়মিত চরিত্র। এমনকি রোমান হলিডের অড্রে হেপবার্ণ---- তার যাবতীয় মুদ্রাদোষ আর ম্যানারিজম ছিল আমাদের মুখস্ত।
অথচ পাশের বাসায় থাকা মেয়েটা সহ পল্লবীর অনেক বালিকাদের-- এমনকি আমরা পুরো নামও জানতাম না। আমাদের সেই প্রজন্মে চারপাশের নড়ে চড়ে বেড়ানো মেয়েরা ছিল সব এলিয়েন, ভিন্ন কোন গ্যালাক্সি থেকে আসা প্রাণ। আমাদেরই মতো হাত পা নাক মুখ, অথচ কোথায় যেন অমিল। যে আইনে আমরা পাঁচজন জীবন কাটাই, তাদের জন্য সে আইন অপ্রযোজ্য!

চারপাশের বাস্তবের সব বালিকাদের আমরা তাই পাত্তা না দেওয়ার ভান করতাম!


পল্লবীর এই আড্ডাগুলো আমার জন্য খুব এক্সপেনসিভ হয়ে যেত। উত্তরা থেকে যাওয়া এবং আসা, হাত খরচ আর সিগারেটের পয়সায় প্রায় টান পড়ে যেত...... ফলে বন্ধুরা প্রায়ই চাইতো কি ভাবে আমাকে পোষায় দেওয়া যায়, কি ভাবে আমাকে চাঙ্গা রাখা যায়। অন্ততঃ আমি যেন পল্লবী যাওয়া বন্ধ না করে দিই। পল্লবীর মেয়েদের সৌন্দর্য্য আর গুনগানে আমার কান ভরিয়ে রাখা হতো।

গায়ক শুভ্রদেবের খালাম্মা ডাঃ রুমা ঘোষের বাসায় গিটার শিখানোর ক্লাস নিতেন উনার স্বামী সুজেয় শ্যাম। দু’পা এগোলেই হরিণ ওয়ালা বাসা, আর তার ফূটপাতে আমি প্রথম দেখি কাকলীকে। হাতে গীটারের বাক্স, দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলছিল- আরোও কয়েকজন বান্ধবীর সাথে......

পারভেজদের বাসা তখন ছিল কালাপানি, মুসলিম বাজারের দিকে। হুমায়ুন, সাব্বির আর আমি যাচ্ছিলাম সেদিকে—আমার কনুইয়ে চাপ দিয়ে স্বাভাবিক স্বরে সাব্বির বললো- নীল ওড়না পরা লম্বু টাকে দেখে রাখ। পরে কমুনে......

এবং আশ্চর্য্য চিনিয়ে দেবার পর দেখা গেল, কাকলীর সাথে আমার প্রায়ই দেখা হচ্ছে, কখনো চৌরঙ্গীর মোড়ে ভরদুপুরে, কখনও ১১ নম্বরে ইরানি হীরা অথবা জাফরানী থেকে নামতে...... একদিন তো বক্সীবাজারে বদরুন্নেসার সামনের রাস্তায়। আমি আড্ডা মারছি আমার মেডিক্যালের বন্ধুদের সাথে, ক্লাস শেষ করে ফিরছিল কাকলী। আমাকে তার চেনার কথা নয়, ফলে সে জানতেও পারে না আমার কথা......

অথচ আমরা প্রায়ই ঘটনাচক্রে মুখোমুখি হয়ে যাই।

----------অসমাপ্ত--------------
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০০৯ রাত ৯:১৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×