বর্তমানে নতুন একটা ট্রেন্ড চলছে মেধাবী শব্দটাকে বিকৃত করে "ম্যাদাবি , ম্যধাবী" ইত্যাদি বলা হচ্ছে কারণটা হলো বাংলাদেশে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটার সংস্কার চেয়েছিল শিক্ষার্থীরা !
একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতির সাথে কথা বলার সময় সে আমাকে বললো , ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা , কোথায় ছিলো মেধাবীরা ?!! যুদ্ধ তো করেছিল গ্রামের চাষা , শ্রমিক , নিরক্ষররা !!! তখন তারা যুদ্ধ করেছিল বলেই তো আজকে মেধাবীরা পরীক্ষা দিতে পারছে । আর আজকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিপুতিদের দেওয়া কোটার বিরুদ্ধে বলছে এরা !
এই একই প্রশ্ন বা কথা আমি টিভির টকশোতেও অনেককে বলতে শুনেছি । বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকও এই একই কথা বলেছেন !
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছুটা বিব্রত হলাম কারণ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করি । এখন এই যে তারা ডিভাইড করে গরীবদের আর নিরক্ষরদের কেবল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করলো এতে পুরো মুক্তিযোদ্ধাদেরই অপমান করা হলো ।
তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় যাওয়া হয় বা হয়েছে । প্রায় প্রত্যেকটি স্থানেই স্মৃতি ফলক লাগানো দেখি যেখানে ১৯৭১ সালে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এর শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্টাফদের ভিতর যারা নিহত হয়েছেন তাদের নাম আছে । এসব সংখ্যা নেহায়েৎ কম না । ১৯৭১ এ কালো রাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম ও প্রথম টার্গেটই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চ লাইট শুরুই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার মধ্য দিয়ে । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি রেজিমেন্ট এর সৈন্য সমন্বয়ে একটি স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ তৈরি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায় । ১৪ ডিসেম্বর তারিখেও তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে হত্যা করে। এসব জিনিস আমাদের কারোই অজানা নয় ।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলো কারা ? কারা শুরুটা করেছিল ? কারা মেইন টার্গেট ছিল ? সবই কিন্তু মেধাবীরা । আপামর জনগণ তো ছিলই কিন্তু মেধাবীরাই ছিলো এর সব ।
যেমন আন্দোলনের সূতিকাগার ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা , ১৯৭১ তাদের উপর খুনের মহোৎসব চালিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অবশ্যই মেধাবী । তারাই কিন্তু গ্রামের লোকেদের আগে এই আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল । বঙ্গবন্ধু নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন !
১৯৭১ এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতে “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের” কর্মকান্ড পরিচালিত হত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরূল হক হল থেকে)। পাকিস্তানি অপারেশন সার্চ লাইটের ১নং লক্ষ্যবন্তু ছিল জহুরুল হক হল।
জিন্নাহের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদ , ছয় দফা প্রণয়ন , বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা তৈরি, পতাকা উত্তোলন , আন্দোলনের যৌক্তিকতা দেশে বিদেশে তুলে ধরা , ছাত্রলীগ কর্তৃক দেশের মানুষকে পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন করা এর সবই কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ ছিল । তাঁদের সাথে ছিল দেশবাসীর অকুন্ঠ সমর্থন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপরে রাজাকাররা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী কি ধরণের নির্যাতন চালিয়েছিল সেটা কারোরই অজানা নয় । একই অবস্থা ছিল দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষকদের ।
দুই নাম্বারে পাকিস্তান ডিফেন্স সার্ভিসের পালিয়ে যাওয়া বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররাই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ড করেছিলেন ও যুদ্ধের কলাকৌশল ঠিক করেছিলেন । ডিফেন্সে যারা চাকরি করে তারা কি মেধাবী নয় ? যে কেউই কি মিলিটারি অফিসার হতে পারে ? অবশ্যই তারা মেধাবী মানুষ ছিলেন ।
কাজেই মেধাবী শব্দটাকে নিয়ে কটাক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধ করেছিল কেবল গ্রামের লোকজন এসব বলে ডিভাইড করার ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবদানকে অস্বীকার করার বিষয়টি খুবই আপত্তিকর ।
এনিওয়ে , এগুলো বলা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না কিন্তু যেভাবে মেধাবী শব্দটাকে হেয় করছেন তাতে বলতে বাধ্য হলাম
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:১১