somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাকাল

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৪:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সমুদ্র সুউচ্চ পর্বত এবং সুনীল জল দুটোকেই তার বুকে ধারণ করে কিন্তু সুউচ্চ পর্বতকে বুকে ঢেকে রেখে প্রকাশ করে নীল জলকে- কী ভীষণ আশ্চর্য এক বিশালতায়! কঠোরকে গভীরে রেখে কোমলের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। অতি ক্ষুদ্র প্রানিকণা-উদ্ভিদকণা থেকে শুরু করে বিশালাকার তিমি পর্যন্ত জীবজগতের সিংহভাগের আশ্রয়দাতা এই নীল জল। কালের কাছে হার মেনে সেও বুক চিড়ে ধীরে ধীরে বের করে দেয় পর্বতকে! বুকের গভীরের মাটিকে আলাদা করে দেয়। জন্ম হয় দ্বীপের! এইসব দ্বীপ-বদ্বীপ নানা খন্ডে খন্ডিত হয়ে ভূমিষ্ঠ লাভ করে ছোট্ট সেন্ট মার্টিন, ভূমধ্যসাগর ফুঁড়ে বের হয় অপরূপ নান্দনিক সিসিলি, হয় গ্রীনল্যান্ডের মত বৃহত্তম দ্বীপ, অস্ট্রেলিয়ার মত একটি আস্ত মহাদেশ। মাটির দুই খন্ড লরেশিয়া আর গন্ডোয়ানা নীল জলে ভাসতে ভাসতে একে অপরের সাথে ধাক্কা লেগে যায়। আর তাতেই জন্ম লাভ করে হিমালয় পর্বতমালা। নীল জল থেকে সেন্ট মার্টিন জেগে ওঠে হয়ত ২৫০-৩০০ বছরে আর সমতল মাটি থেকে হিমালয় জেগে ওঠে ৭ কোটি বছরে।



মাঝখানে শুধুই সময়ের অখন্ড প্রবাহ। সময়ের এই মহাশক্তি প্রথম অনুভব করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালতায় এসে। লাল-কালিতে সময়কে ‘মহানায়ক’ সম্বোধন করে সাদা কাগজে লিখেছিলাম একটি উড়োচিঠি। মহানায়কই বটে! দেড় থেকে দু’কোটি বছর আগে এল লোমশ মানুষ যারা মেরুদন্ড খাড়া করে মাটির সাথে উলম্বভাবে ঠিকমত দাঁড়াতে পর্যন্ত পারত না। এইত মাত্র ১৮ লক্ষ বছর আগের কথা- মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখল!



চাকা আবিষ্কারের ইতিহাস ৬ হাজার বছরের কম। এভাবে, মানুষ মাটি পুড়িয়ে থাকবার বন্দবস্ত করেছে, নক্ষত্র বুঝে চাষাবাদ করতে শিখেছে, পিরামিড বানিয়েছে, ডানা-মেলে আকাশকে ছুঁয়েছে, সুদূরকে পরাহত করেছে, পানি আর বাতাসকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপন্ন করেছে। আলোর গতি মেপে এই মানুষই বের করেছে এই মহাবিশ্বের সীমাহীনতাকে। বের করেছে আকাশে তাকিয়ে কিভাবে আমরা সুদূর অতীতকে দেখতে পাই। যে তারাটি আপনি দেখছেন হয়ত ভাবছেন- তারাটির বর্তমানকে দেখছেন। আসলে হয়ত তারাটির যে আলোটি আপনি দেখছেন তা গতকালের, ছ’মাস আগের অথবা ছ’বছর আগের। কিংবা আপনার জন্মের আগে তারাটি যে দশায় ছিল তা অবলোকন করছেন। দূর্বার গতিময় আলোর এতটা সময় লেগে গিয়েছে আমাদের পৃথিবীতে আসতে। এমনটি হলেও অবাক হবেননা- যে তারাটি আপনি দেখছেন আজকে রাতের আকাশে সেই তারকার মৃত্যু হয়েছে আজ থেকে আরও লক্ষ লক্ষ বছর আগে। আর তার শেষ দ্যুতিটুকু এই পৃ্থিবীতে আসতেই কেটে গিয়েছে লক্ষ-কোটি বছর! মৃতকে জীবন্ত দেখছেন সময়ের অবসরে- কী দুর্লভ, কী আশ্চর্য! এই বিশালতায়, গভীরতায়, সৌন্দর্যের অখন্ড-বহমানতায়, অপূর্বতায় বিমুগ্ধ হয়ে যদি আপনার কিঞ্চিৎ ‘স্থানিক’ এবং কালিক লয় হয় তা কি খুব দোষের?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা কবি রবার্ট ফ্রস্ট ১৯২০ সালে তাঁর ‘The Road not Taken’ কবিতায় লিখলেন-

I shall be telling this with a sigh
Somewhere ages and ages hence:
Two roads diverged in a wood and I-
I took the one less traveled by
And that has made all the difference.


পৃথিবীর মোট মহাকাব্য ৪টি যার ২টিই লিখলেন একজন অন্ধকবি- হোমার, ১টি লিখলেন ভারতীয় একজন ডাকাত। মন ও মননের সৃজন- বিরাটত্বকে ধারণ, তার যথাযথ লালন এবং বিমূর্তকে মূর্তিদান- সে কি সকলে পারে! একদিকে সময়ের বহমানতা অন্যদিকে মানুষের জয়যাত্রার মহাসোপান। দু’চোখ খুলে রাখলেই কি শুধু দেখা যায়! রবিঠাকুর লিখলেন- ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম, চোখের বাহিরে’। আহ্, কী দার্শনিক কথা! ‘সময়-মানব’ যাত্রার এই দ্বৈত-দ্বিমুখিতাকে পুংখানুপুংখ করবার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় মানুষ শুধু অধিবর্ষতে একদিন যোগ করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং সেকেন্ডেও বাড়তি সেকেন্ড যোগ করে থাকতে চেয়েছে সময়ের সাথে সাথে- যাতে কোনভাবেই সময় আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে না যায়। মহাকালের বিশালত্বকে অনুভব করে কবিগুরু লিখলেন ‘সোনার তরী’। অমরত্বে আমার লোভ নেই- এই কথাটি যে বলে সে হয় মিথ্যে বলে কিংবা ভুল বলে। ‘অমরত্ব’- আমার কাছে সেটাই যা আমাকে সময়ের সাথে হারাতে না দিয়ে ধারণ করে রাখবে- কালোত্তীর্ণ করবে। কেউ ধর্মের সাধনে-কেউ বা কর্মের সাধনে কিন্তু আদতে সব্বাই লাভ করতে চায় অমরত্ব।একদিকে মহাসমুদ্র যেমন লক্ষ-লক্ষ বছর তার বিশালতায় আচ্ছাদিত করে ধারণ করে রাখা পর্বতকে, মাটিকে একসময় নিজ অংশ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অন্যদিকে মহাকাল প্রকাশিত অমরত্বকে তার বিশালতার মাঝে লীন করে দেয়। দেয় বলেই আমরা শত বছর আগের লালনকে জানি, সহস্র বছর আগের কাহ্নপাকে জানি, দেড় সহস্র বছর আগের মোহাম্মদ (সঃ) কে জানি, দু’সহস্র বছর আগের ঈসা (আঃ) কে জানি, আড়াই সহস্র বছর আগের পিথাগোরাসকে জানি। কিন্তু, জানিনা সেই মানুষটির নাম যে সর্বপ্রথম এই মর্তলোকে নিজহাতে আগুন জ্বালিয়েছে? জানিনা কোন ব্যক্তি সর্বপ্রথম চাকা আবিষ্কার করেছে? মহাকাল তাদেরকে ধারণ করে অমরত্বদান করতে পারেনি। পারেনি বলেই নাম এর দিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক। কেউ কি শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে যে, আজ থেকে শতকোটি বছর পরে কেউ শেকসপিয়ার এর ‘ম্যাকবেথ’ মঞ্চায়ন করবে, কিংবা বাজাবে মোৎজার্টের/বিটোফেনের সিম্ফনি? মহাকাল অসীম হলেও মহাবিশ্ব নিয়ত প্রসারমান হলেও জীবজগতকে অথবা শুধুই মানব সম্প্রদায়কে অনন্তকাল ধরে ধারণ এবং লালন করে অমরত্বদান অদ্যাবধি সম্ভবপর হয়নি। তাই এই নশ্বর অস্তিত্ব যতক্ষণ অনুভব করার শক্তি আছে প্রাণভরে করাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। জারুল ফুলের বেগুনি রঙ্গে, কৃ্ষ্ণচূড়ার আগুন-লালে, গিরগিটির রং-পাল্টানোয়, জোছনায়, মাটির সোঁদা গন্ধে, খালি পায় শিশিরভেজা দূর্বাঘাস মাড়ানোয়, সঙ্গীতের মুর্ছনায়, টাকি মাছের ভর্তায়, ছোট্ট শিশুর অবুঝ-হাসিতে, মানুষের ভালবাসায় অনুভব করুন আপনার অস্তিত্বের পূর্ণতাকে। দিক হতে দিকচক্রবাল পর্যন্ত তাকিয়ে দেখুন কিভাবে অসীম এবং সসীম পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছে পরম মমতায়। দু’চোখ বন্ধ করে দু’হাত দিগন্তে বিস্তৃত করে দিয়ে বৃষ্টির সুশীতল পরশ অনুভব করুন কোন সবুজ মাঠের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে। আকাশের নীলিমায় লীন হোক সকল ক্লেদ, জরা, শ্রান্তি আর দুঃখ আর জীবনের স্বপ্নগুলো ঐ সাদা মেঘের ভেলায় করে অসীমকে ছুঁয়ে ছড়িয়ে যাক সবখানে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×