একজন সুফিয়ানের গল্প এবং একটি খণ্ডচিত্র
==========মোঃ খুরশীদ আলম
[ সুফিয়ানের টবে লাগানো পুদিনা (কাল্পনীক)]
ঘুম হতে জেগে সুফিয়ানের প্রথম কাজ হলো ব্যালকনিতে যাওয়া। ব্যালকনি হতে বাইরের আকাশটা যত সুন্দর দেখায় খুব সম্ভবত সৈন্দর্য উপভোগ করার মতো এমন মাধ্যম দ্বিতীয়টি নাই। আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘ নীল চাদরে ঢেকে থাকে। ঝিরঝিরে বাতাস আন্দোলিত করে, শিহরিত করে দেহমন। এই অনুভূতি দেখানো যায় না, মনেপ্রাণে অনুভব করা যায় । মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন থরে থরে সাজিয়ে আকাশে মেঘের যে রূপ বৈচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তা অন্য যে কোন বিচারে অনন্য, অপরূপ, অদ্বিতীয়। তার নিপূন কারিগরী, রূপের উপস্থাপনা যে কোন শিল্পির তুলিতে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। এই মোহময় দৃশ্য ঈমানদারের মনে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়, সহিহ পথের পাথেয় হয় পথহারা মুসাফিরের, বৃদ্ধি পেতে থাকে ঈমানের নূর, আত্নায় সঞ্চারিত হয় সত্য ও সুন্দরের উপাসনা। সৃষ্টির সৌন্দর্য সম্পর্কে ভাবনার উদয় হয় মুমিনের হৃদয়ে, আত্নশুদ্ধিতে বলিয়ান হয়ে ঈমানদার উচ্চারণ করে “ মাওলা হে, আপনি সৃষ্টির কোন কিছুই এমনি এমনি সৃষ্টি করেননি। ”
সুফিয়ান প্রকৃতি প্রেমী, প্রকৃতিতে ডুবে মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির লিলা নিয়ে ভাবতে ভালবাসেন। ব্যালকনিতে ফেলনা পানির বোতল আর টবে লাগিয়েছেন থানকুনি, পুদিনা এবং গোলাপের চারা। মন খারাপ থাকলে গাছগুলোতে হাত বুলান আর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকেন। পুরাতন কুঁড়ি ঝরে সেখানে নতুন কুঁড়ির আগমন ঘটে, পুরাতন যায় নতুন আসে, নতুনের জন্যই যেন পুরাতনের বেঁচে থাকা। কত সহজে একে অপরকে জায়গা করে দেয় তারা। এভাবেই চলতে থাকে, আমৃত্যু। সুফিয়ানের মনে ভাবনার উদয় হয়। দৃশ্যটি তিনি হৃদয় দিয়ে উপভোগ করেন। মানুষ ও প্রকৃতির চরিত্রের পার্থক্য আলাদা করেন সুফিয়ান। মানুষ কত বিচিত্র প্রাণী, একবার কোথাও অবস্থান শক্ত করে তুললে আর সরতে চায়না। এক ধরণের মাতাল প্রেমে জড়িয়ে পড়ে আর ভুলেই বসে এখানে তার অবস্থান চির দিনের জন্য নয়, সাময়ীক মাত্র, সে তো এক অজানা মুসফির, ক্ষণিকের জন্য যার আসা-যাওয়া।
উদার মনা সুফিয়ান মানুষের মাঝে, মানুষের ভালবাসার মাঝে সৃষ্টির রহস্য উম্নোচন করার চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অসহায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে যে সুখ লাভ করা সম্ভব মাগরেব হতে মাশরেক পর্যন্ত তা সব নাজ-নেয়ামতের উর্দ্ধে। শহুরে ব্যস্ততম সময়ে অফিসে যাওয়া-আসার প্রাক্কালে বাদামতলী, সিঙ্গাপুর মার্কেটের সামনে সুরে সুরে গাইতে থাকা ভিক্ষুকদের মাঝে তিনি প্রতিভা খুজে পান। কিছু মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান, ভাবনা উদয় হয় তার মনে। আহা! আমি কতোই না ভাল আছি, ওদের তুলনায়।
[ বস কর্তৃক আবেদন প্রত্যাহার হওয়ার পূর্বমুহুর্ত, আপনার সাথে মিলে কিনা দেখে নিন]
সময়ের সঠিক ব্যবহারে সুফিয়ান খুবই সিরিয়াস। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা আগে অফিসে পৌঁছানো তার বহু পুরাতন অভ্যাস। তবুও কেনযে ওরা তার পিছনে লেগে থাকে তা তিনি বুঝতে পারেন না। এইতো গেল রজমানের কথা। সাতাশতম রোযায় অসুস্থতার কারণে অফিসে উপস্থিত না হতে পেরে সহকর্মীর হাত দিয়ে দরখাস্থ পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেই দরখাস্ত নিয়ে কতো গবেষণা ! গবেষক তারই এক জুনিয়র সহকর্মী। কর্মকর্তার সামনে বলে বসেন, দরখাস্তে সে নিজে দস্তখত করেছে কিনা বা সে নিজে লিখেছে কিনা। ফলে যা হবার হলো। কর্মকর্তা ছুটি পাশ করেননি। পরের দিন অফিসে এসে নতুন দরখাস্ত নিয়ে কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাত করলো সুফিয়ান। স্যার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জর্জকোট, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্টের সকল নিয়ম তাকে শুধিয়ে দিয়ে অবশেষে দরখাস্ত পাশ করে দিলেন। সুফিয়ান ভাবে, তার অধিকাংশ কলিক বন্ধুগণ সঠিক সময়ে অফিসে আসে না, নির্ধারিত সময়ের আরো আগে অফিস ত্যাগ করে, নানান রকমের অনিয়মে জড়িয়ে আছে তারা। সেই দিকে কারো নাজদারি নেই, থাকলেও কোন এক অজানা রহস্যে তারা থাকে ধোয়াছোয়ার বাইরে। অথচ সুফিয়ানের এই একটি ব্যাপার নিয়ে তাকে যেভাবে হেনস্তা করা হলো তাতে খুব কষ্ট পেয়েছেন তিনি। মাঝে মাঝে নিজের প্রতি আক্ষেপ হয় সুফিয়ানের। নিজের চোখে যখন দেখেন তেলবাজেরা দিব্যি আরামে আয়েশে আছে, নীতি নৈতিকতার বালাই যাদের নেই তারাই সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তারাই যখন নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় উর্ত্তীণ হয় তখন সমাজে মন্দ ভালোর প্রভেদটা স্পষ্ট করতে পারেননা সুফিয়ান। মূর্খ লোকগুলো যখন ঘরে বাইরে নিয়মের কর্ণধার সাজে তখন মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে, এই কি সভ্য সমাজ ! যেখানে অনিয়মটাই নিয়ম, যেখানে গুণী লোকের কোন কদর নেই, দু’টাকা আয়-রোজগারের জন্য মানুষ যেথায় তেলবাজিতে মগ্ন প্রতিনিয়ত। শিক্ষিত বলে যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, যারা শিক্ষার আলোয় আলোকিত বলে দাবীদার তারা তেল পেলে এতো খুশী হয় যে, আসমানে আছে না মাটিতে আছে তা আর মনে থাকে না। সুফিয়ান ভাবতে থাকে, ভাবনার সমাপ্তি ঘটে যখন সে ঘরে পৌছে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। তার রোপিত পুদিনা, থানকুনি আর গোলাপের পাপড়িগুলো যেন তার সাথে কথা বলে। তারা তাকে বলে, দুনীয়ার এই আস্থা-ভালবাসা ক্ষণিকের, এর শেষ আছে। তাই সে যেন পরম করুণাময়ের কাছে শোকরিয়া জানায়। করুণাময় তাকে সমাজের অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা করে গড়েছেন বলে। যেখানে তার অনুভূতিগুলো খোদার মারেফতের আলোয় তাকে আলোকিত করে, ভাল মন্দের প্রভেদ শিখায়। সুন্দরকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার যোগ্যতা সে পেয়েছে বলে অস্ফুট কণ্ঠে সুফিয়ান উচ্চারণ করে “ শোকর আলহামদুলিল্লাহ” ।
[আপনাকে যখন এভাবে মূল্যায়ন করা হয়]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৮ সকাল ১১:২৪