“ বয়স কোন ফ্যাক্ট নয়, শিক্ষায় অন্ধকার দূর হয় । ” - আঠারো বছরের নেপথ্যে : একটি সুন্দর ফলাফল
========== মোঃ খুরশীদ আলম
২০০০ সাল হতে ২০১৮; ১৮টি বছর। এই ১৮ টি বছরে একটি শিশু সাবালক হয়, বিয়ে-থা করে কেউ কেউ সন্তান-সন্ততীর পিতা-মাতা হয়। সংসারের হাল ধরে। সুখের স্বপ্ন দেখে, দেখায়। একটি কচি চারাগাছ এই আঠারো বছরে পত্রপল্লবে ভরে উঠে; মোটা-তাজা হয়, ফুল দেয়, ফল দেয়, বীজ দান করে এবং স্বগোত্রকে টিকিয়ে রাখে। আঠারো বছরের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকে আঠারো হাজার ঘটনা-দুর্ঘটনা, হাসি-কান্নার ইতিহাস। আমি ও আমরা সকলেই এই ইতিহাসের এক একটা নায়ক। আমাদের চরিত্রকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে এক একটা কাহিনী আর চিত্রনাট্য।
আঠারো বছর পরে গতকাল আমি একটি সুন্দর ফলাফল হাতে পেয়েছি; আলহামদুলিল্লাহ (সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার জন্য)। আমার ব্লগের বন্ধুদের আমি সেই সুখবরটি জানাতে চাই। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে, গতকাল বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের এইচ, এস, সি ফলাফল প্রার্থীদের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। আমি নিজেও এই ফলাফলের প্রার্থী ছিলাম। আপনাদের এই ব্লগার বন্ধুর বর্তমান বয়স ৩৫ বছর (আলহামদুলিল্লাহ)। আমি ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বোর্ডের অধীনে এস, এস, সি পরীক্ষায় ফাস্ট ডিভিশন অর্জন করি। ২০০০ সালে চট্টগ্রামের খ্যাতনামা কলেজ ওমরগনী এম,ই,এস কলেজ হতে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। দু’টি সাবজেক্টে (এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না) ফলাফল খারাপ হওয়ায় আর পরীক্ষা দেয়া হয় নাই। অভিজ্ঞরা জানেন, পড়াশোনা হতে একবার পিছিয়ে পড়লে তাতে মনোঃসংযোগ করা অনেক কঠিন ব্যাপার। আর যদি পরিবারে কাউন্সিলিং করার মতো কেউ না থাকে, মাথায় হাত বুলিয়ে বইমুখী করার মতো কেউ না থাকে, সরল রাস্তার হিসাব নিকাশ বা যোগ বিয়োগ বুঝিয়ে দেয়ার কেউ যদি না থাকে তবে যুবকের তপ্ত রক্তে বইয়ের নেশাটা আর ঢুকে পড়ে না। আমার বেলায়ও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। ছাত্র রাজনীতি, পারিবারিক দৈন্যদশা, অভাব আর পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতাটা একেবারেই মরে গিয়েছিল।
[ আচ্ছা কথার ফাঁকে আমার রেজাল্টটা একটু তুলে ধরি; কি বলেন ? ]
পড়াশোনায় মনযোগি না হলেও আমি কিন্তু কাজের বেলায় যথেষ্ঠ মনোযোগি ছিলাম। আমি কখনোই বেকার জীবনযাপন করিনি। জীবিকার তাগিদে চট্টগ্রাম শহরে বেবী ট্যাক্সি চালিয়েছি, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্সের কাজ শিখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করেছি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি অভাবের তাড়নায় চট্টগ্রামে রিক্সাও চালিয়েছি দু’একদিন। আমি মিশেছি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে। চা দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, ডাক্তার, এডভোকেট, ম্যাজিস্ট্রেট, সচিব মহোদয়, বিচারপতি মহোদয়সহ সকলের সাথে আমার ছিল সুন্দর সখ্যতা এবং আছেও। আমি সকলের ভালবাসা পেয়েছি। আমি জীবনকে চিনেছি সকল দরজায় কড়া নেড়েনেড়ে। জীবনের স্বাদ পেয়েছি কাপড় নিংড়ানো জলের মতো। সকল নদীর কূলে গিয়ে আমি দেখেছি কোন নদীর পানি কতোটা স্বচ্ছ। তাই অহংকারবোধ আমার মাঝে আলহামদুলিল্লাহ কাজ করেনা। কারণ আমি জানি আমি কি ছিলাম আর কি হয়েছি। সত্য কথাটা আমি সকলের সামনে অকপটে বলতে দ্বিধা করিনি। যার কারণে অনেকের কাছেই আমি যা নই তা।
অনেক গল্প এই আঠারো বছরের, আঠারোটি বই লিখলেও শেষ হবেনা হয়তো। আর সব গল্প বলার অভিপ্রায়ও আমার নেই, ব্লগার বন্ধুদের সেই গল্প শুনার ধৈর্যও হবেনা বোধ করি।
সরকারি চাকুরীতে (চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এর কার্যালয়, চট্টগ্রাম) আমার পদার্পন ২০০৮ সালের ২৬ জুন, “ ফরাশ” পদে। এর পর থেকে জীবন চলতে থাকে একটি ব্যতিক্রমী নিয়মে। অনেক চড়াই-উৎরাই আর সংগ্রামের পরে “ প্রসেস সার্ভার” পদে পদোন্নতী প্রাপ্ত হয়ে অদ্যাবধি এখানে নিযুক্ত আছি। নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে স্টেনো টাইপিস্টের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি প্রায় ০৮ বছর। বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণের সাথে এই পদে কাজ করে যাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার স্যারদের নিয়ে সন্তুষ্ট এবং স্যাররাও আমার সার্ভিস নিয়ে সন্তুষ্ট।
এবার বলব কেন এতো বয়সে এসে আবার পড়াশুনা করা শুরু করলাম। জনসাধারণের মাঝে সবসময় একটা বোধ কাজ করে। আর সেটা হলো “ কোর্টের দেয়ালেও টাকা খায়।” বিশ্বাস করেন, শুধুমাত্র কোর্টে চাকুরী করি বলেই আমার সন্তানদের ভাল শিক্ষদের কাছে পড়াতে পারি না। কোর্টে চাকুরী করি বলে শিক্ষকদের ডিমাণ্ড বেড়ে যায় অনেক গুণ। তারা মাইনে এতো বেশী চায় যা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়না। “ভাই আপনি সরকারি চাকুরী করেন, কোর্টেতো আপনার ইনকাম ভাল।” এমন মন্তব্যে মনের ভিতর একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সবসময় কাজ করত। আমার সন্তানরাতো আমার মতো করে কষ্ট করতে পারেনা। তাদেরতো মানুষ করতে হবে। তাই ভাবছিলাম কি করা যায়। প্রাইভেট টিচারদের দাবী মিটানোর পরেও যখন দেখতাম তারা ভুল পড়াচ্ছেন বা নিয়মিত পড়াচ্ছেন না, যখন দেখতাম মাস শেষ হলেই বাচ্চাকে টিউশন ফি দেয়ার জন্য ইশারা করছেন তখন মনের ভিতর যন্ত্রনা অনুভব করতাম কেন পড়াশোনা বন্ধ করে দিলাম। কেন সুযোগ হেলায় নষ্ট করলাম।
এমন মূহুর্তে জনাব জসিম উদ্দিন স্যার (যিনি এখন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, চট্টগ্রাম), জনাব গোলাম কিবরিয়া মজুমদার (অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সিএমএম কোর্ট, চট্টগ্রাম), জনাব লুৎফুল কবির নয়ন স্যার (সিনিয়র সহকারী সচিব, ঢাকা) গণের পরামর্শে ভর্তি হয়ে গেলাম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পথে-ঘাটে সমন জারী করেছি, অফিসে কম্পিউটারে বসে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা স্যারের দিকনির্দেশনায় মামলার রায় লিখেছি, পরিবার, বউ-বাচ্চা সামলিয়েছি কিন্তু পড়াশোনাটা চলমান রেখেছি। হাজার ঝামেলার পরেও বইকে সময় দিয়েছি, সহপাঠিদের সময় দিয়েছি। চেষ্টা করেছি ভাল করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ ভাল করেছি। আমি আমার সকল ব্লগার বন্ধুদের দোয়া চাই। আপনারা আমার সাথে থাকবেন। পরামর্শ দিবেন। এখন আমি বুঝতে পেরেছি পড়াশোনা শুধু নিজের জন্য নয় বরং সকলের জন্য। কারণ এটা আলো আর আলোর কাজ হলো অন্ধকারকে আলোকিত করা। আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন আমার সন্তানদ্বয়ের জীবন আলোকিত করতে পারি।
[ যাদের কাছে ঋণী আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। জনাব ডাঃ মোজাম্মেল কাকা (ইনি আমার জীবনের সিঁড়িটা দেখিয়ে দিয়েছেন), জনাব উজ্লল ভাই ও সোলেমান (এরা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন, মানুষের অনেক কথাও শুনেছেন), জনাব বিপু ভাই, জনাব জসিম উদ্দিন স্যার, জনাব লুৎফুল কবির নয়ন স্যার, জনাব গোলাম কিবরিয়া মজুমদার, নাজির সাহেব জনাব আবুল কালাম আজাদ, ক্যাশিয়ার জনাব তারিকুল ইসলাম, লাইব্রেরী সহকারী ও রেকর্ড কীপার যথাক্রমে জনাব শাহানা আকতার ও জনাব আছমা আকতার, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব পলাশ চন্দ্র বর্মন, বিশেষ করে ইউটিউব চ্যানেলে আরিফ ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক জনাব আরিফ স্যারকে এবং শিক্ষা বিষয়ক অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী টিম টেন মিনিট স্কুল ও এর সকল কলাকুশলীকে। সবশেষে যার কথা না বললেই নয়, যিনি আমাকে সব সময় সময় দিয়েছেন, কাছে থেকেছেন, সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়েছেন, আমার ফলাফলের পিছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিন হলেন আমার অর্ধাঙ্গিনী জয়নাব বিলকিছ। তার সহযোগিতা ও উৎসাহ না থাকলে হয়তো এতদূর আসা সম্ভব হতো না। আমি তার কাছে চীর কৃতজ্ঞ রইলাম। ]
সব শেষে আর একটা কথা না বললেই নয়, “ বয়স কোন ফ্যাক্ট নয়, শিক্ষায় অন্ধকার দূর হয় । ”
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ৮:৩৫