দাবী আদায় ও ভাষার কদর্য্ ব্যবহার
প্রসঙ্গ : “নিরাপদ সড়ক চাই” এবং নিরাপদ সড়কের রুপরেখা
=====================মোঃ খুরশীদ আলম
ভাষা ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রকাশ করে। আচরণে ভদ্রতা, উপস্থাপনার সৈন্দয্য দাবীর যথার্থতা তুলে ধরে। শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য যদি হয় নিজেকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা তবে তার আরো একটি উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীরা ভাষার সুন্দর ব্যবহার শিখবে, ভাষাকে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দনরূপে উপস্থাপন করবে।
আমরা কথায় কথায় বলে থাকি- “ ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। “ একথা সত্য যে, আপনাকে অন্যরা মূল্যায়ন করবে আপনার আচরণশৈলির অলংকরণে, আপনার ভাষার মজবুদ গাঁথুনিতে। আপনার ভাষা যত সুন্দর, প্রাঞ্জল ও বোধগম্য হবে ততই আপনার গ্রণনযোগ্যতা ও দাবীর যথার্থতা অন্যরা অনুধাবন করবে সক্ষম হবে।
আমরা ভাষা শিখি, জন্মের পর হতে। প্রথমত মা-বাবা তথা পরিবার ও সমাজ হতে। এটা ভাষা শিখার প্রথম সোপান। অতঃপর স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে আমরা ভাষা আয়ত্ব করি এবং নিজেদেরকে আলোকিত করি। আলোকিত মানুষের ভাষাও অলংকার, সম্পদ। অচেনা একজন মানুষের মধ্যে আপনি কখনো কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলতে সক্ষম হবেন শুধুমাত্র তার ভাষার মোহে, চেহারার ঝলকানিতে বা শারিরীক সৌন্দর্য়ে নয়।
আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আপনি যখন কথা বলেন তখন শ্রোতা আপনার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রবণ করে। শ্রোতা আপনার কথা শ্রবণ করে তার মূল্যবান সময় ব্যায় করেও। কারণ সে আপনার ভাষা হতে নিজের জন্য কিছু আয়ত্ব করার উপাদান খুঁজে পেয়েছে। শ্রোতার পলক না পরা সময় আপনি পুরোটা হজম করে নিচ্ছেন শুধুমাত্র আপনার ভাষা শৈলীর তীর নিক্ষেপনে, আপনার চেহারা রং ঢংয়ে নয়। আবার কারো কারো ব্যাপারে বিপরীতও হয়। এরা সব সময় উপেক্ষিত। এদের মধ্যে অনেক উঁচু মাপের শিক্ষিতও রয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত।
আপনি হয়তো আমাদের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করে থাকবেন। এই ধরুন, উঁচু শ্রেণীর ভাষা, নিচু শ্রেণীর ভাষা, সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাবঞ্চিতদের ভাষা। সকলের চাহিদা বা ভাষা ব্যবহারের লক্ষ্য এক হলেও সকলের উপস্থাপনা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন।
দুঃখজনক ভাবে আপনি চলার পথে একজন ডাক্তার, একজন ট্রাফিক পুলিশ বা পুলিশ সার্জন, একজন রিক্সাচালক, বাসের হেলপার বা চারক আ হোটেলের ম্যানেজার বা কর্মচারী বা একজন আদালত অঙ্গনে কর্মরত ব্যক্তির মধ্যে ভাষা উপস্থাপন বা ব্যবহারের কল্পনাতীত পার্থক্য লক্ষ্য করে থাকবেন। অথচ একই জাতি স্বত্তার অংশ হিসাবে আমাদের সকলের ভাষা শৈলী এক হওয়া কি খুবই দরকার নয়।
আসুন, আমাদের প্রচলিত সাহিত্য চর্চায় ভাষার ব্যবহার দেখি। আমাদের প্রথিতযষা সাহিত্যকগণ তাদের সাহিত্যে ভাষার যে রসকস যোগ করেন অনেক সময় তাতে শালীনতা বিসর্জিত হয়। তবুও তাদের সাহিত্য মানুষের রুচির খোরাক হয়, উঠতি বয়সি নারী-পুরুষের ভাবের খোরাক হয়, তাদের সহিত্যের কাটতিও বেশি। নারীর রুপ উপস্থাপনায় তারা যে গবেষণা তুলে ধরেন আমার কাছে তা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে মুক্তা কুড়ানোর চেয়েও শক্ত বলে মনে হয়। এই সব সাহিত্য যদি গলধঃকরণ করার পেছনে আত্নার শান্তি লুকায়িত থাকে, এই সাহিত্য যদি আপনাকে হীরো ভাবতে সহায়ক হয় তবে আজকে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে আমাদের ছেলেরা ভাষার ব্যবহারে যে প্লাকার্ড নিয়ে সড়কে নেমেছে তা অযৌক্তিক হবে কোন দাবীতে, কোন দলিলে ? রাস্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর আচার-আচরণ আর ভাষার ব্যবহার যে কতটা অমায়ীক তা কেবল ভূক্তভোগীরাই জানেন। এটা যদি কোন সমস্যা না হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের আজকের আচরণ অবৈধ হওয়ার পিছনে কোন যুক্তি খাটে ? এটা গেল একটা দৃষ্টিকোণ হতে।
অন্য দৃষ্টিকোণ হতে আমি দেখি, আমাদের বিদ্যাপিঠ হতে বেরিয়ে আসছে আগামীর কর্ণধাররা। এদের ভাষার ব্যবহার এমন হওয়াটা প্রাসঙ্গিক নয়। এটাও সঠিক যুক্তি বলেই আমি মনে করছি। সকল দাবীর যথার্থতা তুলে ধরতে সফলভাবে ভাষায় সর্বোচ্চ ভদ্রতাটুকু প্রদর্শন করা উচিত। জ্ঞানীজনরা অন্তত ছাত্রদের কাছ থেকে তাই মনে করে। এটাই সত্য, তিক্ত হলেও।
আমাদের দেশে অতীতে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। বলতে গেলে আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েইতো বাংলাদেশের জন্ম। এই জাতি জানে কিভাবে দাবী আদায় করতে হয়। তবে কোন আন্দোলনে ইতিপূর্বে ভাষার এমন অশালীন ব্যবহার কারো নজরে পড়েছে কিনা তা আমার জানা নাই। এতে দাবী আদায় হবে কি হবে না সেটা বড় কথা নয়। বিশ্বের দরবারে আমরা ভাষাকে যে সুউঁচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছিলাম তা অনেকটাই অন্ধকারে ঢেকে গেছে বলে আমি মনে করি। বিশ্বের দরবারে আমাদের ভাষার অবমূল্যায়নে চিত্রটা পরিস্কার করা হলো।
অনেকেই শিক্ষার্থীদের এমন আচরণের অন্তরালে উষ্কানীদাতার সন্ধান আশা করছেন। এমন প্রকাশ ভঙ্গির পিছনে যদি আসলেই কারো ইন্ধন থেকে থাকে তবে তাদের সামনে আনতে হবে। তাদের জাতির কাছে স্পষ্ট করতে হবে। যদি কেউ ভিন্ন পথে সুষ্ঠু দাবী প্রবাহিত করতে চায় সেই মহলকে ছাড় দেয়া যাবে না। কোন মহল যেন শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে তার জন্য সরকারসহ সকলকেই সজাগ থাকতে হবে।
নিরাপদ সড়কের দাবী শুধুমাত্র শিক্ষাথীদের নয়, সকলের। আজকের নয়, বহু আগের। দেশবাসী মনে করে এটা দেশের প্রধান সমস্যা বহুকাল আগ হতে। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রচলীত যে আইন রয়েছে তা এই সমস্যা নির্মূলে যথেষ্ট নয়। এই তথ্য ইতিমধ্যেই পরিস্কার করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই একটা টেকসই, স্থিতিশীল পরিবেশ বান্ধব আইন প্রণয়নে সরকারকে ও সংশ্লিস্ট সকলকেই ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এটা একটা জটিল পক্রিয়া বলে এড়িয়ে যাওয়া নয় বরং ধীরে ধীরে হলেও এর বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা জনিত মামলা- মোকদ্দমায় দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করতে হবে। আইন আদালত সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের উচিত হবে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থের মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তিতে যথাযথভাবে সাহায্য করা। মামলার তারিখ, মামলার হাজিরা, সাক্ষীগ্রহণ সব ধারবাহিকতা যেন দ্রুত সম্পন্ন হয় সেদিকে সকলকেই পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের সাথে সাথে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে এবং এই মামলাকেই আগে প্রায়রিটি দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় সাক্ষীগণ প্রায়ই আদালতে উপস্থিত থাকেন বা সাক্ষী দিতে চান না। এ ব্যাপারে আদালত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন বলে প্রত্যাশা করি। যিনি বা যারা ক্ষতিগ্রস্থ ভিকটিম তারাতো এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্থ। তাই তাদের কাছ থেকে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ ফি না নিয়ে পারেন কিনা তা ভাববেন, প্রত্যাশা করি। দুঃখজনক ভাবে সত্য যে, ভিকটিম ন্যায় বিচার পেতেও পুলিশ, আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মচারী, উকিল, মুহুরীদের সবাইকে খুশী করতে গিয়ে আরো নুহ্ন্য হয়ে পড়েন। অন্তত ভিকটিম পক্ষকে যথাসম্ভব সুবিধা দেয়া যায় কিনা তা ভাবা যেতে পারে। গরম রক্তের টগবগানির কারণে মাথা ফাঁটানো যায়, গাড়ি ভাংচুর করা যায়, খুন-জখম করা যায় কিন্তু রাতারাতি সিস্টেম পাল্টানো যায় না। এজন্য ধৈর্য্ ধরে, ন্যায়ানুগভাবে সামনে আগাতে হয়। সর্বাঙ্গে নিরাপত্তা ও সচেতনতা, ভুললে চলবে না। অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে আমরাইতো গাড়িতে উঠি, এটা করা যাবে না। মহিলাদের সিটে পুরষরা কাপুরুষের মতো বসে থাকা যাবে না। সড়ক পথে চালকরা প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। আমরা যাত্রীরা মজা নিই, এটা রুখতে হবে। প্রতিযোগিতার কুফল তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। কয়টা টাকার লোভে পারমিট বিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে দেয়া যাবে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স বিহীন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের গাড়ি চালাতে দেয়া যাবে না। গরীব অসহায় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সাবলম্বি করার জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে বিনা খরচে কাজ করার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। পথচারী হিসাবে ফুট ওভার ব্রিজ ও জেব্র্রা ক্রসিং ব্যবহার করতে হবে। স্কুল মাদ্রাসা ছুটির পরে সেই স্থানে অন্তত পাঁচ মিনিট গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখতে হবে।
আমরা যদি যথাস্থানে থেকে যার যার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি তাহলে সমস্যা যেমন প্রকট হবে না তেমনি ব্যক্তি, সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে। তাই সচেতনতা সৃষ্টি, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে কার্যকরী ভূমিকায় ছাত্র-শিক্ষক, ইমাম-মুয়াজ্জিন, সভাপতি-কর্মী, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন, মালিক ড্রাইভার, মিডিয়া-মিডিয়াকর্মী, যাত্রী-চালক, ঘরে-বাইরে সকলকেই নিজ নিজ ভূমিকা যথার্থভাবে তুলে ধরতে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই “ নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলন সফল হবে, অন্যকোন পন্থায় নয়। এর বাইরে যে কোন পদ্ধতি বা কৌশল সাময়িক সুবিধা দিলেও ব্যাপকভাবে কুফলই বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:০৩