somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আতঙ্কের সুড়ঙ্গ : গাজায় ইসরাইলী আক্রমণের রাজনৈতিক অর্থনীতি

৩০ শে জুলাই, ২০১৪ ভোর ৫:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলছে। আগুন জ্বলছে অনেকদিন থেকেই। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, মিসরের পর এখন আবার প্যালেস্টাইন। গত ৮ই জুলাই থেকে শুরু হওয়া অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ নামে ইসরাইলী আক্রমণে এ পর্যন্ত এগারোশোরও বেশি গাজার নাগরিক নিহত যাদের শতকরা সত্তর ভাগই বেসামরিক নাগরিক, উদ্বাস্তু প্রায় দুই লাখ। অপরপক্ষে ইসরাইলের সেনাবাহিনীর নিহতর সংখ্যা তেপ্পান্ন আর নিহত হয়েছেন দুইজন বেসামরিক ব্যাক্তিবর্গ এবং একজন থাই নাগরিক। এই সংঘর্ষের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। কিন্তু আমাদের অনেকেই হয়ত জানিনা এর আশু কারন।

ভু-রাজনৈতিক কারনে ভূমধ্যসাগরীয় তীরবর্তী এ অঞ্চলের দিকে ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নজর ছিলো সবসময়। খৃষ্টপূর্ব ১৪৫৭ সালে ফারাও তৃতীয় তুতমসের আমল থেকে শুরু করে অ্যালেকজান্ডার দি গ্রেট, পারস্য, রোমান, বাইজেন্টাইন, আরব, তাতার, ওসমানীয় সম্রাটরা, নেপলিয়ন আর বৃটিশদের আগ্রহ ছিলো এই বাণিজ্য পথের উপর। ১৯৬৭ সালে মিশরের কাছ থেকে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার পর ইসরাইলই এই অঞ্চলের অবিসংবাদিত প্রভু। মজার ব্যাপার হল ২০০৫ সালের ইসরাইলের একতরফা প্রত্যাহার পরিকল্পনা অনুসারে ইসরাইল গাজা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিলেও এর আকাশসীমা ও তীরবর্তী জলসীমার নিয়ন্ত্রণ থাকে ইসরাইলের হাতেই। ২০০৬ সালে হামাস গাজার ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইল ও মিসর গাজা অবরোধ করে। মিশরের বক্তব্য ছিল সীমান্ত খুলে দিলে তা হামাস সরকারকে সমর্থন করা হবে আর ইসরাইলের বক্তব্য হল হামাস সীমান্ত ব্যবহার করে ইসরাইলের বিরুধ্যে সামরিক শক্তি সঞ্চার করছে। যদিও ২০০৭ সালে হামাস প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করলে এই অবরোধ সরকারিভাবে হ্রাস করার কথা বলা হয়েছিল কিন্তু কার্যত তা থেকেই যায়।

অবরোধ চলাকালে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহের সুবিধার্থে মিশরের সীমান্তে কিছু সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল, পরবর্তীতে যা সংখ্যায় অনেক বেড়ে যায়। সুড়ঙ্গগুলো ছিল বেশিরভাগই মিসরের রাফা শহরের পাশে মিসর-গাজা সীমানায় । ওগুলোকে বলা হয় গাজার লাইফ লাইন। শিশুখাদ্য থেকে জ্বালানী তেল, গৃহসামগ্রী, গবাদিপশু, প্রয়োজনীয় সবকিছুই আসে এই সুড়ঙ্গগুলো থেকে। অনেক সুড়ঙ্গে বিদ্যুত, বাতাস ও যোগাযোগের জন্য টেলিফোন সুবিধা আছে। কিছুকিছু সুড়ঙ্গ এতো বড় যে তাতে একটা আস্ত গাড়ি চালিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া মানুষও যাতায়ত করে এই পথে যার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ থেকে ৩০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত গুনতে হয়। সাধারণত এগুলোর বের হবার পথ শেষ হয় কোন রাফার কোন বাড়ি বা বাগানের ভেতরে। মিসর আর গাজার অনেক নাগরিকই এখন এই সুড়ঙ্গ ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত। এটা লাভজনকও বটে। সেক্ষেত্রে বাড়ি বা জমির মালিকের সাথে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব থাকে। হামাসের তত্বাবধায়নেই এসব সুড়ঙ্গ পরিচালিত হয়। প্রত্যেকটি জিনিসের উপর হামাস একটা লভ্যাংশ পেয়ে থাকে যার পরিমান বছরে প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিশাল আয় সুরঙ্গগুলোকে টিকিয়ে রাখার পেছনে হামাসের অন্যতম কারন।

সুড়ঙ্গ ব্যবসা বর্তমানে গাজার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিক অবরোধের কারনে গাজার ৩৫ ভাগ কৃষি জমি চাষের বাইরে, মাছ ধরা যাচ্ছেনা ৮৫% জলসীমায়। এমতাবস্থায় লাগাতার সংঘর্ষের কারনে পঙ্গুপ্রায় গাজার অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে বৈদেশিক সাহায্য আর এই সুড়ঙ্গ ব্যবসা। গাজার চল্লিশ ভাগেরও বেশি জনগণ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। মোট জনসংখ্যার চল্লিশ ভাগ বেকার যাদের অধিকাংশই বয়সে যুবক। এই যুবকরা খুব সহজেই এই সুড়ঙ্গ ব্যবসায় চলে আসছে। এদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য তারা এই কাজ নিয়েছেন। যদিও এই ব্যবসায় ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেশি। প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা সুড়ঙ্গ ধ্বংস করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খুড়তে গিয়ে মারা গিয়েছে একশোরও বেশি প্যালেস্টাইনি। কিন্তু তারপরেও থেমে নেই এই ব্যাবসা। একটা সুড়ঙ্গ বন্ধ হলে আরেকটা তৈরি হয়। ২০১২ থেকে ২০১৩’র মধ্যে মিশর প্রায় এক হাজারেও বেশি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করলেও এখনো নতুন করে সুড়ঙ্গ তৈরি হচ্ছে।

আগেই বলেছি, গাজার লাইফ লাইন হলো এই সুরুঙ্গ ব্যবস্থা। গত মঙ্গলবারের বোমাবর্ষণে গাজার ৪০% জ্বালানী তেল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই তেলই ছিলো গাজার বিদ্যুত ব্যবস্থার একমাত্র উৎস। বিদ্যুতের অভাবে সেখানে এখন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়া যাচ্ছেনা, বন্ধ সেখানকার একমাত্র পানি শোধনাগার, অচল পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ধ্বংস হয়েছে সব ধরনের অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত হাসপাতালও ইসরাইল মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। প্যালেস্টাইনি প্রাকৃতিক সম্পদ কর্তৃপক্ষের ডেপুটি চেয়ারম্যান ফাতাহ-আল-শেখ খলিলের মতে, “এটা একটা মহা বিপর্যয়”।

ফিরে যাই লেখার শুরুতে, কথা হচ্ছিলো অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ নিয়ে। এই অপারেশনের অন্যতম কারন এই সুড়ঙ্গপথগুলো। ওগুলো মূলতঃ ব্যবসায়িক কাজে তৈরি করা হলেও এখন তা সামরিক উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত জুনের মাঝামাঝি ইসরাইলের তিন কিশোরকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়। এর পাল্টা জবাবে এক প্যালেস্টাইনি কিশোরকে অপহরণ ও হত্যা করে ইসরাইল, বৃদ্ধি পায় হামাসের রকেট হামলা। ইসরাইলের অভিযোগ এই সুরঙ্গ পথেই হামাসের অস্ত্রসস্ত্র আসে। উপরন্তু হামাস এখন ইসরাইলী সীমান্তে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেই পথে গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছে। আর তাই এই অপারেশনের অন্যতম উদ্দ্যেশ্য হলো এই সুড়ঙ্গপথগুলোকে চিরতরে বন্ধ করা। কিন্তু হামাস কি বসে থাকবে? অবশ্যই না। এবং থাকেওনি। হামাস ইসরাইল ও মিসরের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি ফিরিয়ে দিয়েছে। কারন স্থল ও জলপথ অবরোধের ফলে এই সুড়ঙ্গগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে হামাস তথা গাজাবাসীর মৃত্যু। এই সংঘাতের সমাধান কোন দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদী শান্তি পরিকল্পনা। কোন পদক্ষেপ নেওয়া হলে তাতে সেখানকার জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। আর তা না হলে বরাবরের মত সেই পদক্ষেপও ব্যার্থতায় পতিত হবে।


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৪ ভোর ৫:৪৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×