মেঘনাতে আমি দিনক্ষণ ঠিক করে যাইনি আর। হঠাৎ মনে হয়েছে দৌড় দিয়েছি। স্প্যানিশ গীটার প্রথম হাতে খড়ি আমার বন্ধু সোহাগের কাছে। সেই উপলক্ষে কোনদিন সকালে তো কোনদিন বিকালে আমরা এক এক জায়গায় বসতাম। এক সকালে সোহাগ এলো দোস্ত লিপুকে নিয়ে। আমরা আইয়ূব বাচ্চুর Ôসেই তুমি বাজাচ্ছি নিষ্ঠার সাথে। লিপু বলে উঠলো ওর না কি অসহ্য লাগছে। সোহাগের মনে তখন কোনভাবেই জাকিয়াকে পটাতে না পারার কষ্ট আর আমার মনে তো ব্যথার স্থায়ী বসতবাড়ী। তিনজনে ভর দুপুর বেলা গুলিস্তান গিয়ে হাজির। মেঘনার পারে গিয়ে দেখি পূজার মৌসুম শেষ করে শত শত বউ ঝি লঞ্চে করে এসে পাড়ে নামছে। আমাদের ঘণ্টার নৌকা পাওয়া দুষ্কর। হুন্ডাই সিমেন্টের কারখানা হব হব। নদীর এপাড়ে বাঁধা ওপাড়ে বাঁধা। টিকটিক করে চলা একটা মুদির দোকানে বসে চা আর নাবিস্কো বিস্কুট খেলাম। তারপর বসলাম গিয়ে ব্রীজের নীচে। চুপচাপ বসে থেকে, পানির দিকে তাকিয়ে একদম চুপ করে বাসে করে ঢাকা চলে এলাম। সেদিন কেন আমরা এত নীরব ছিলাম তিনজনের কেউ সোহাগের মৃত্যুর আগেও না পরেও না জানতে পারিনি।
৯৭ এর ডিসেম্বরে সবাই যখন অনার্সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টুপটাপ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে, আমার বিখ্যাত রেজাল্ট এবং পকেট কমজোরি হওয়ায় কোথাও ভর্তি হতে না পেরে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরাই যখন একমাত্র কাজ তখন পাবলিক লাইব্রেরীতে বান্ধবী কাজলার বদৌলতে পরিচয় হলো মনি, মৃদুল, রানা, আরিফ, নোমান এদের সাথে। মৃদুল মণি নোমান কাজলার সাথে বোরহানউদ্দিনে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে। কোন বন্ধু যে কখন জীবনে স্থায়ী হয়ে যাবে সে জবাব শুধু সময়ই বলতে পারে।নোমানদের সাথে যেদিন পরিচয় সেদিন আমার সাথে ছিল আমার স্কুল বন্ধু লিপু। আমি আইবিসিএস প্রাইমেক্সে তখন কম্পিউটার স্টাডিজ পড়ছি, কোথাও ভর্তি না হয়ে। ইচ্ছা ছিল লিটারেচার পড়ব, সে কারণে ঘ ইউনিট ছাড়া আর কোথাও সিরিয়াসলি পরীক্ষাও দেইনি। বুক ভরা হতাশা, বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলো ঘুরা আর ননস্টপ আড্ডা এ হতাশার একমাত্র উপশম। আর কি! চলে গেলাম মৃদুল মণি নোমান আরিফ রানা কাজলা নোমানের বান্ধবী চৈতী মেঘনায়। চললো সেইরকম ডুবাডুবি। মেঘনা তখন চরিত্র বদলাচ্ছে। এতগুলো ছেলের সাথে এতগুলো মেয়ের দাপাদাপি দেখে স্থানীয় মাস্তানরা শাসাতে চলে এলো। মনির রফায় আমাদের মাঝি আমাদের মানে মানে এনে মেঘনার পাড়ে দিয়ে গেল।ভেজা কাপড়ে বাসে নেবে না। অগত্যা ব্রীজের নীচে বসে নিজেদের শুকালাম।মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমার মেঘনার কাছে এমন অপমাণে।
৯৯ এর শেষে মৃদুলের সাথে কাজলার কাটাকাটি। বন্ধুদের মাঝে যা যা ছেলেমানুষী গ্যান্জাম হয়...আমার তো ঘুরবার কথা শুনলেই গা হাত পা নিশপিশ করতে থাকে। মৃদুলকে বললাম দোস্ত চলো মেঘনা যাই দিল খুশ হইয়া যাবে। ঘাটে নেমে আগে স্থানীয় পোলাপানকে টাকা দিয়ে ওদের কাছ থেকেই এবার নৌকা নিলাম ঘণ্টার যেন কোন ঝামেলা না হয়। নোমান মণি মৃদুল মাবরুকা আরিফ আমি চৈতী নিজেদের মাঝে মেঘনাকে নিয়ে আলোচনা করছি যেন আমাদের কোন অনেকদিন পর দেখা বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে এই স্টাইলে। আগের চাইতে দোকানপাট বেড়েছে। নৌকার একদম মাথায় কে বসবে তা নিয়ে আরিফ আর মৃদুল ঝগড়া করছে। নোমান মৃদুলকে বাপ ডাকার বাকি রেখেছে একটা আস্ত সিগারেটের জন্যে। চৈতী খুব মজা পাচ্ছে ঝগড়াতে। মাবরুকা নৌকার পাশে ঝুঁকে পানিতে হাত দিয়ে রেখেছে। মণি মাঝির গামছা চোখের উপর দিয়ে নৌকার পাটাতনে সটান শোয়া। আমি বরাবরের মতো বসে আছি ধ্যানীমুনি হয়ে। এবারের ট্রিপটা খুব ভালো হলো হয়তো শেষ ট্রিপ বলে। দুপুরে মসজিদের পাশে এক হোটেলে খেলাম। বিকাল পর্যন্ত ব্রীজের নীচে বসে তাস খেললাম, প্রথমবারের মতো ছবি তুললাম, গান গাইলাম, বাসে ফিরলামও গান গাইতে গাইতে। আমাদের গানে বাসের সব মানুষ চরম বিরক্ত হলেও আমাদের হাসি থামলো না।
২০০২ এ মেঘনা যাওয়া রাণীর হালে যাকে বলে! আমার বড় ভাই এর বিয়ে হয়েছে কিছুদিন হলো। আব্বু তখন মাগুরা পেপার মিলের এমডি। মেঘনা ঘাটের সাথে সেই পেপার মিল। বান্ধবী তানিয়া শাবানা আমার ভাই ভাবী গেলাম আব্বুর কর্মস্থল দেখতে আর আউটিং করতে। গাড়িতে ড্রেস কয়েকটা। বাসে বসে ভ্যাপসা গরমের সেইসব দিন না, পকেট ছিঁড়ে টাকা বের করবার দিন না, রীতিমতো এসি কারে সাজানো গোছানো বেড়ানো যাকে বলে! কার গিয়ে কারখানার গেটে ঠেকতেই সবার দৌড়াদৌড়ি...পেপার মিল ঘুরে দেখলাম। তারপর সিকিউরিটি ইনচার্জ আলম আংকেলের তত্ত্বাবধানে গেলাম নৌভ্রমণে মেঘনা নদীতে। তানিয়া শাবানা আমার ভাবী স্মৃতি ভাইয়া নিপুণ সবাই তো নদীতে ঘুরতে পেরে আমোদিত। শাবানা আপু বারবার বলে যাচ্ছে তার কত ভয় লাগছে পানিতে। কারণ সে সাঁতার জানে না। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, আমরা কেউই সাঁতার জানি না এ মর্মে। তারপর শাবানা আপু বললো তার এত জলভীতির কারণ সে একবার ধানমিন্ড লেকে ডুবে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে এই শাবানা আপু জলপরী নিকনেমে ব্লগ লিখবে বা সুইমিং শিখবার জন্যে প্রাণ লড়িয়ে দিবে সে ইতিহাসের স্বাক্ষী হবে সময়।
নৌভ্রমণের পরে দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। সে কি এলাহি কারবার! গলদা চিংড়ি, মুড়িঘণ্ট, কাবাব, মুরগী, গরু ভুনা-আইটেমের পর আইটেম আসছে। আমার মনে ভেসে উঠছে নাবিস্কো বিস্কুট আর চা, অকালে চলে যাওয়া সোহাগের মেঘনার পাড়ে ক্ষুধার্ত মুখ-আমাদের ঠনঠনে পকেট। আমি জানতাম আমি আর সাজানো গোছানো মেঘনা ভ্রমণে কখনো আসব না। সেই আমার শেষ প্রিয় নদীর কাছে যাওয়া শেষবারের মতো
আগের পর্ব পড়তে চাইলে:
http://www.amrabondhu.com/meghkanya/5330
http://www.amrabondhu.com/meghkanya/5321