somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক , দুই বা পাঁচ টাকার অর্থহীন গল্প

১৫ ই জুলাই, ২০০৯ রাত ৩:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১ টাকার গল্প:
সেই যে রাজেক দাদু আমায় ফাঁকি দিয়ে হারিয়ে গেল , এক টাকার গল্পটা আর কখনোই ফুরোলো না । দাদু তোমার দিব্যি দিয়ে বলতে পারি , তোমার উপর অভিমানটা আজও কাটেনি । পুকুরের চালায় বসে
যে কথা তুমি দিয়েছিলে ,সে কথা না রেখে কি করে তুমি চলে গেলে ?

দু'মাসের জন্য দেশে এসেছি তখন । সালটা ৮৮ না , ৯০ ভাল করে মনে নেই , হয়ত সবটুকুন মনে রাখার মত বয়েস তখনও হয়নি বলেই ।শুধু মনে আছে নানা বাড়ির কোণে প্রকান্ড একটা গাছ ছিল সে গাছে প্রথম আম চিনেছিলাম, প্রতিবেলায় নতুন জামা কাপড় বেগুনি রসে রাঙিয়ে পাড়া-পড়শিকে জাম চেনাতাম , সবার অজান্তে বিকেলের পাগলামিতে ভর করে শহরের মাঝ আর নানার জানালার পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইছামতির বুকে চপ্পলজোড়া ছুঁড়ে দিতাম।

কোলে উঠার বয়েসটা তখনও আমার হারায়নি , বড় হওয়ার পণ করে কারও কোলেই উঠতে চাইতাম না । প্রতিজ্ঞা ভাঙিয়েছিল আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুটি .....আমার ছোট চাচা। চাচার কোলে চড়ে দিব্যি উঠোন জুড়ে ঘুরে বেড়াতাম , পুকুর চালায় যেতাম । বেলায় বেলায় ছোট চাচার কাছ থেকে মিলত সাদা ধবধবে পাড়ের হরিণ রাঙা ১ টাকার নোট ।খামে জমানো নোটগুলো কখনও দৃষ্টির আড়াল হতে দিতাম না , ভাঁজ পড়তে দিতাম না , নোটের খামটা সাথে নিয়েই ঘুমোতে যেতাম , রাতভর স্বপ্নের মাঝেও নোটের ছবিতে আঁকা হরিণগুলোই দেখতাম ।

আমার খামভরা ১৯ টাকার গল্প তদ্দিনে পিচ্চিদের মাঝে বুঝি ছড়িয়ে গিয়েছিল । এক বিকেলে আমার সমবয়েসী গাঁয়ের দস্যিদল খেলাচ্ছলে আমাকে ঝুপড়ি দোকানের সন্ধান দিল। ছোট্ট টং দোকানের ভেতরটায় গুটিসুটি মেরে সারাটা দিন এক বৃদ্ধ বসে থাকতে দেখতাম । গাঁয়ের সবাই সবার চেনা , সবাই সবার আত্মীয় , বুড়ো মানুষটি সেদিন থেকে আমার রাজেক দাদু হয়ে গেল ।

বিকেল বেলায় আমার দাদা বাড়ির পুকুর চালায় রাজেক দাদু হাঁটু ভেঙে বসে থাকতেন । আমার মোটরগাড়ি আঁকা সাদা রঙা গেঞ্জিটা পড়ে দাদুর সামনে গেলেই দাদু গেঞ্জিটা নেবার আব্দার করতেন । শতবার দাদুকে বোঝাতাম গেঞ্জিটা দাদুর গায়ে লাগবে না , দাদু কিছুতেই যেন বুঝতে চাইতেন না ।

দাদু নিজেই চানাচুর বানিয়ে ছোট্ট প্যাকেটে করে বেচতেন ।এক টাকা দিলেই ছোট প্যাকেট মিলত । আমরা পিচ্চিরা দাদুর ঝুপড়ির চানাচুরের প্রেমে পড়ে গেলাম ।চানাচুরের নেশায় আমার ১৮/১৯ টি চকচকে নোট ফুরোতে সময় লাগল না ।

দেখতে দেখতে ইরান ফেরার সময় হয়ে গেল , এক বিকেলে আমার হারানো নোটগুলোর জন্য বুক ফেঁটে কান্না আসল , হরিণগুলোর জন্য ভীষণ মায়া হল । পুকুর চালায় গিয়ে রাজেক দাদুকে পেলাম , আজ দাদুর আব্দার ফেললাম না , আমার চকচকে ১ টাকার নোটগুলোর বিনিময়ে আমার গেঞ্জিটা দিয়ে দিতে চাইলাম । দাদু খুব হেসে আমায় সবক'টা টাকা ফিরিয়ে দেবার কথা বললেন । পরের দিন ভোরে ঢাকায় রওনা হওয়ার সময় দাদুর দেখা পাইনি ।

অপেক্ষার দীর্ঘ দু'টি বছর কাটিয়ে আবার যখন গাঁয়ে ফিরে যাই ,তখনও আমার অবুঝ শৈশব শেষ হয়নি , রাজেক দাদু তখন চিরতরে হারিয়ে গেছেন ।

তারপর আরও অনেক দিন টং দোকানটা রয়ে যায় , তার ঝাপি আর খোলে না । দাদা বাড়ির পুকুর ঘাট ভেঙে নতুন ঘাট হয় , রাজেক দাদুকে কোথাও দেখিনা ।প্রথম চেনা নানাবাড়ির রসগোল্লা সাইজের মিস্টি পাকা সেই জামের সাথে এখন কোথাও জাম মেলেনা , কোণের দিকে তাকালে শুকনো গাছটায় আম মেলেনা , গতি হারানো ইছামতির
একটা ক্ষণেও ঘুম ভাঙে না ।শৈশব হারাই , কৈশোরবেলা কেটে যায় আমার ১ টাকার গল্প কখনও ফুরোয় না .............

২ টাকার গল্প.....
২ টাকার গল্পটা যখন ডানা মেলতে শুরু করে , তখন আমি দূর-প্রবাসে ইরানে । দেহে ভাঙেনি শৈশবের শেকল , মনে ভাঙেনি ১ টাকার সে বিরহ।

মাত্র ২০ টি বছর আগের সে সময়টিতেও বিদেশে চিঠি দেয়া নেয়াটা মোটেও সহজ নয় । ফি মাসে দেড়টি বা দু'টো চিঠি মেলে বাংলাদেশ থেকে। ছোট্ট মেহরাবের অপেক্ষার অনেক প্রহরগুলো কাটে ছোট চাচার চিঠির নেশায়। চিঠির ভেতর সেঁটে দেয়া থাকে কমলা আভার দোয়েল আঁকা দু'টাকার নোট । একটা দু'টো করে নোট জায়গা পায় আমার সংগ্রহশালায়। এবারের সংগ্রহশালাটাও বিচিত্র , আব্বুর মোটা একটা মেডিসিন বইয়ের ভেতর।

আমরা থাকি একটা বাসার দোতালায় , নীচ থেকে দোতলা অব্দি উঠে যাওয়ার সিড়িটার পুরোটাই খোলা আকাশের নিচে , সিঁড়ি দিয়ে উঠার পর দেখা মেলে একটা লম্বা ঝুল বারান্দার। পাশের বাসার ছাদটা বারান্দা লাগোয়া , ইচ্ছে করলেই অনায়াসে লাফিয়ে বারান্দা আর আর পাশের বাড়ির ছাদের মাঝে যাওয়া আসা করা যায় ।আব্বুর চোখা রাঙানি এড়িয়ে ত্রিং ব্রিং লাফিয়ে ছাদ-বারান্দা পারাপার চলে সারাবেলা।

শহরটির নাম নাম জাভানরুদ, সবুজের সমরোহ নেই , আছে পাথুরে রুক্ষতা , সে রুক্ষতার মাঝেও শহরজুড়ে কোন দীর্ঘশ্বাসের ছায়া মেলে না । পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা সে শহরে সারা রাত বাসার দরজা খোলা থাকলেও চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না , নিঃস্তব্ধ শহরে সারা রাত দিব্যি ঘুরে বেড়ালেও আতঙ্ক ভর করে না। সে সুযোগটা আমরা কাজে লাগাই পুরোদমেই , গ্রীষ্মে তাই বলতে গেলে ঘরের দ্বার কখনোই রুদ্ধ হয় না ।

এমনই এক গ্রীষ্মের দিন শেষে রাত নেমে আসে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে প্রকান্ড ডাক্তারি বইটা খুলে দেখি সবক'টা নোট হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে । বুঝতে বাকি থাকে না কার কাজ। পাশের বাসার সমবয়েসী ছেলেটিকে একবার নোটগুলো দেখিয়েছিলাম , রাতে আমাদের খাবার সময় ছাদ দিয়ে এসে সব নিয়ে গেছে ।

টাকার মায়া তখনও বুঝতে শিখিনি , বুকের খাঁচায় ভীষণ ব্যাথা হয় আমার দোয়েলগুলোর জন্য । ছেলেটি আর স্বীকার করেনা , আজ ১৭ টি বছর পর ওর জন্য কোন অভিমানও জমা থাকেনা, তবুও মনে পড়ে সে রাতটির কথা , যে রাতে কমলা রঙে রঙিন দুই টাকার দোয়েলেরা আত্মহত্যা করে ।

৫ টাকার গল্প:
দু'টাকার গল্পের সে রাতের দেড় যুগ পরের বাষ্পে ভেজা এক রাত , ২ রা অক্টোবর , ২০০৮ । ঈদের পরেরদিনের ঝুমঝুম বৃষ্টিবেলার এই রাতে হঠাৎ করেই একজনের কাছে ঈদী পাই .......... মামুলি ৫ টি টাকা । কেন জানি ,ছোটবেলা থেকে পাওয়া আমার সবক'টা ঈদীর নোট এই নোট টির কাছে ম্লান লাগে , সে রহস্য ভেদ করা হয়ে ওঠে না।

নতুন চকচকে নোটটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিই , ভুলেও যাই সে কথা। সাতটা দিন নোটটি লুকিয়ে থাকে । অষ্টম দিনে ড্রয়ারে ঝোলানো পাঞ্জাবীর পকেট থেকে নোটটা যখন বেরিয়ে আসে , হঠাৎ করেই যেন নোটটা ভীষণ ভালবেসে ফেলি ।

বুকশেলফের ওপরে রাখা কাঁচখন্ডের নিচে নোটটা আলোর ছোঁয়ায় নতুন স্পন্দন খুঁজে পায় । প্রতিদিন আমার সাথে নোটটির চোখাচোখি হয়।

এক বিকেলে অফিস শেষে ঘরে ফিরে খেয়াল হয় , রিকশাভাড়ার সমপরিমাণ টাকা আমার পকেটে নেই । ৫ টাকা নেয়ার জন্য বাসায় এসে দেখি বাসায় কেউ নেই , বাইরে যাবার আগে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়া বেশির ভাগ রুম, চাবির খোঁজটাও মেলে না, ফোনেও কাউকে পাই না। তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলি আমার ঘরের সবকিছু , কোথাও একটা কড়িরও সন্ধান মেলে না । হঠাৎ করে চোখ পড়ে পাঁচ টাকার নোটটির উপর , কাঁচ সরিয়ে নোটটা হাতে নিই

কাঁচের ভারে ভাঁজ হারানো জীবন্ত নোটটাকে হঠাৎ করেই যেন অনেক বিষন্ন হয়ে ওঠে। ভারী হয়ে ওঠা আবেগের কাছে আমাকে আত্মসমর্পন করতেই হয়। লজ্জার মাথা খেয়ে পাশের বাসা থেকে ৫ টাকা ধার করে ভাড়া শোধ করি ।

এরপর কেটে যায় আরও ৬ টি মাস , নোটটি রয়ে যায় সেই কাঁচের নিচেই । একদিন কি ভেবে মানিব্যাগের বিশেষ কুঠুরিতে নোটটির বসত বানিয়ে দিই । আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গ পেয়ে নোটটার মাঝে বিচিত্র রঙ খেলা করে ।

বর্ষার এক বিকেলে শাপলা চত্তরে আকস্মিকভাবে এক বন্ধুর সাথে দেখা হয় । রিকশা ভাড়া না দিতে পেরে অপেক্ষারত বন্ধু আমার কাছে ৫ টি টাকা চায় ।

মানিব্যাগ বের করার সাথে সাথে ৫ টাকার নোটটি উঁকি মেরে বন্ধুকে দেখা দেয় । ওটা ছাড়া ছোট আর কোন নোটের খোঁজ মেলে না । আমি প্রমাদ গুনি , ভীষণ কষ্ট হয় । দু'টো/ চারটি মুহূর্ত দ্বিধা করি । কিছু বলতে না পেরে ভীষণ কষ্টে ওর দিকে নোটটা বাড়িয়ে দিই । মূহুর্তের নিস্তব্ধতা চূর্ণ করে কোথায় যেন কলরব শুনতে পাই , রিকশাওয়ালা কোথা থেকে যেন ভাঙতি জোগাড় করে আনে ।

পাঁচ টাকার পটে আরেকবার জীবনের ছবি আঁকা হয়। যুগান্তরের জীবনের আর গল্পের স্বপ্ন বুনে পাঁচ টাকা বেঁচে রয় ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০০৯ বিকাল ৫:৪৯
৫৩টি মন্তব্য ৫৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×