রাসুলকে স. নিয়ে ইরানে সম্প্রতি একটা মুভি বানানো হয়েছে । এই মুভির নাম ‘মুহাম্মদ : দ্য মেসেঞ্জার অব গড’ ।
এর আগেও ‘আর রিসালা’ বা ‘দ্য মেসেজ’ নামে মোস্তফা আক্কাদের একটা ছবি আমরা দেখেছি । দ্য মেসেজ নিয়ে একসময় খুব আন্দোলন-ফান্দোলন হয়েছে । জার্মানিতে এই ছবি যখন মুক্তি পাবো পাবো করছে, তখন ক্ষোভে ফেটে পড়েছে একশ্রেণির ‘শান্তিপ্রিয়’ মানুষ । কিন্তু মোস্তফা আক্কাদ মানুষের সামনে নিবেদন করে বলেছেন, “আপনারা ছবিটা দেখুন, এখানে ইতিহাসের কোনোরূপ বিকৃত প্রকাশ ঘটে নাই । রাসুলের স. কোনো চিত্র ব্যবহার হয় নাই ।”
বাস্তবেও আমরা সেই ছবির নিপুন কারিশমা দেখেছি । সেখানে চার খলিফাকে ক্যামেরার আড়ালে রেখে তাদের উপস্থিতি বোঝানোর প্রয়াস বেশ প্রশংসা পেয়েছে । ছবিটা অস্কারেও গেছে । হলিউডের অ্যান্থনি কুইন, আইরেন পাপেস, মাইকেল আনাসার মতো দু-তিনজন খ্যাতিমান অভিনেতাও সে ছবিতে ছিলেন । সেই ছবির সেট নির্মাণ করা হয়েছিলো লিবিয়ার মরুভূমিতে; সেটটি মুয়াম্মার গাদ্দাফি যত্ন করে সংরক্ষণ করেছিলেন ।
বলতে চাচ্ছিলাম, এই যে রাসুলকে নিয়ে একটা চলচ্চিত্র বানানো হলো, এ বিষয়ে কি আসলেই আপত্তি করার খুব কিছু আছে ? অর্থাৎ রাসুলকে নিয়ে ছবি করাটাই কি খুব বেশি দোষের ব্যাপার ? নাকি দোষের ব্যাপার কেবল তখনই হবে, যখন তাতে ‘অবমাননাকর’ কিছু থাকবে ? যেমনটা রয়েছে ‘ইনোসেন্ট অব মুসলিম’ ছবিতে । যদি ছবি করাটাই দোষের হয়, তাহলে আন্দোলনটা কেবল ‘ইনোসেন্ট অব মুসলিম’-এর বেলায়ই ফেনিয়ে উঠলো কেনো ? কেনো মোস্তফা আক্কাদের বিরুদ্ধেও ফতোয়া জারি হলো না ? কেনো মুগ্ধ চোখে আমাদের ছেলেরা ‘দ্য মেসেজ’ উপভোগ করে ? আর যদি ‘অবমাননাকর’ কিছু না থাকলে আর দোষ না হয়, তাহলে আমরাইবা এমন ছবি নির্মাণের কাজে পিছিয়ে আছি কেনো ?
আমরা না করলেও কাজ কিন্তু থেমে নেই । হজরত ইসা ও মুসা আ.-ও তো আমাদেরই নবি, তাই না ? তাদের নিয়ে কিন্তু হলিউডে বেশ ভালো ছবি তৈরি হয়েছে । Son Of God ও Exodus: Gods and Kings । কিন্তু যা হয়েছে, সেটা ছবির মানে ‘ভালো’ বলা গেলেও বিশ্বাসের মানে কিন্তু গড়মিল আছে । থাকাটাই তো স্বাভাবিক । গড়মিলটা তো আমাদের কাছে, ওদের কাছে তো আর না । আর আমরা গড়মিল ধরেই বা কী করবো, আমরা তো বানাই নি, বানানোর মুরাদ, তাগত, হিম্মত, হাললাত কোনোটাই তো আমাদের নেই । তাই যা হচ্ছে, তা-ই মানুষ খাচ্ছে এবং তাতে তাদের বিশ্বাস আরো পোক্ত হচ্ছে ।
‘মুহাম্মদ : দ্য মেসেঞ্জার অব গড’ ছায়াছবির অফিসিয়াল ট্রেইলার প্রকাশ করা হয়েছে এই আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে । ইরানের খ্যাতনামা চিত্রনির্মাতা ‘মাজিদ মাজিদি’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন । http://www.mohammadmovie.com ওয়েবসাইটে ইংরেজি, ফার্সি ও আরবি ভাষায় ৪টি ট্রেইলার আপলোড করা হয়েছে । গত পরশু (২৬ আগস্ট) ইরানে ছবিটি মুক্তিটি পেয়েছে এবং গতকাল (২৭ আগস্ট) কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠেয় ৩৯তম বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার শোতে প্রদর্শিত হয়েছে । মুভির ফেসবুক পেজে দেখা যায়, ইরানের হলে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে ছবিটি দেখার জন্যে । ছবির পরিচালক মাজিদ মাজিদি তেহরানে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, “ইসলামের সঠিক ভাবমর্যাদা বিশ্বে তুলে ধরা এবং ইসলাম নিয়ে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে ।”
তিনপর্বে নির্মিত ছবির রিলিজ হয়েছে কেবল প্রথম পর্ব । ১৭১ মিনিটের এ ছবি নির্মাণে লেগেছে পাঁচ বছর আর ৫৫ কোটি ডলার । এতে কাজ করেছেন ইতালির অস্কারজয়ী সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো, ফিল্ম এডিটর রোবাতো পেরপিগানি, মার্কিন শিল্পী স্কট ই অ্যান্ডারসন । সঙ্গীত সংযোজনে ছিলেন ভারতীয় প্রখ্যাত সুরকার এ আর রহমান ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যে নির্মমতার সাথে ইহুদিদের নিধন করেছেন, তা নিয়ে আমরা যতই আপ্লুত হই, ইহুদিদের দু:খ কিন্তু ততটাই বাড়ে । যদিও বিচার-বহির্ভূত হত্যা ইসলাম সম্মত নয় । কিন্তু তারপরও আমরা কিন্তু হিটলারকে সাধুবাদ জানাতে ভুলি না । তবে পৃথিবীতে মেধাবী ইহুদির সংখ্যাও তো কম নয় । তারা ইহুদিদের প্রতি সিমপেথি জাগাতে বহু সাহিত্য রচনা করেছেন । তার মধ্যে অন্যতম হলো ২০১৪ সালে নোবেলজয়ী গ্রন্থ ‘মিসিং পারসন’; কালের খেয়ায় ‘নিখোঁজ মানব’ নামে যার কিছুটা অনুবাদ ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিলো । তাদের আরেকটি কালজয়ী শিল্প হলো মুভি The Pianist । এভাবেই একটা সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে ইহুদিরা তো চলছে । এবং আমরাও যখন সেইসব শিল্পকর্ম দেখি, তখন তাদের ক্ষোভের জায়গাটা টের পাই ।
একসময় আমরা ছবি-ভাস্কর্যর বিরুদ্ধে তো কতকিছুই বলেছি আমরা । চাঁদে যাওয়া বিজ্ঞানীদের বলেছি ‘খোদাদ্রোহী’ । আবার চাঁদের প্রথম পদচিহ্ন আঁকা নীল আর্মস্ট্রংকে নিয়ে তো আমাদের ‘মোসলমানিত্বের’ কম জাহির হলো না । আজ আমাদের ইসলামি স্কলাররা বলছেন- রিমুভাল পিকচার রাখা ও তোলা জায়েজ । কিন্তু মুভিকে এখনও তারা ‘হ্যাঁ’ বলেন নি । ওদিকেিআমরা, আমাদের কিছু ছেলেরা এমন একটা সময় এসে কলম ধরতে শিখেছি, যখন বিশ্ব এনিমেশন পিকচরের পথে এগিয়ে গেছে । আমরা লিখছি অথচ এখন প্রযুক্তি সচেতন মানুষ বই আর পড়ে না; শোনে কিংবা দেখে । এই বই থেকে কবে মুভি হবে, সেটার খোঁজ নেয় বারবার । কিন্তু একসময় মানুষ যখন সত্যিই বইপত্র পড়তো, তখন আমাদের এ জাতীয় ‘লেখাপড়া’ নিষিদ্ধ ছিলো । ভাবছি, কবে আমাদের আলেমগণ মুভি দেখার অনুমতি দেবেন; মানুষ কি ততদিনে মঙ্গলে পাড়ি জমাবে না ?
মুভি না দেখুক, না বানাক, অন্তত মুভির স্ক্রিপ্ট লেখাটাও কি দোষের কিছু হবে বলে মনে হয় ? সেটুকু করতে পারলেও মনে হচ্ছে, একটু আগানো যায় ।
নাকি তার আগে এই ‘মুহাম্মদ’ ছবির বিরুদ্ধেই আন্দোলন দাঁড়িয়ে যাবে, কে জানে ! বড় সংশয়ে ভুগছি আজকাল ।
তবে যে যা-ই বলুক, আমি যেমন ‘দ্য মেসেজ’ দেখেছি, দেখেছি ইনোসেন্ট অব মুসলিম, দেখেছি ফাতীহ, দেখেছি পিয়ানিস্ট; তেমনি এই ছবি দেখার অপেক্ষায়ও আছি । ট্রেইলার তো দেখা হলো.. মন্দ লাগবে মনে হচ্ছে না । খুব দোষের যে কিছু না হবে না, সেটা যাচাই করতে আপনারাও ‘নেট পরিব্রাজন’ করে দেখতে পারেন ।
দেখেন তো অনেকই, আমি না হয় একটু বললাম...
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৩৮