somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নামে কী আসে যায়

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খেজুর রসের টানেই সেদিন ঘুম থেকে ওঠা গেলো ভোর বিহানে। তারপর হেঁটে হেঁটে বহুদূর । মলয়ের সঙ্গে দেখাটা এভাবেই হয়ে গেলো আচানক ।

শীতের ভোরে কুয়াশার চাদর ফুড়ে ফুড়ে হাঁটতে ভালো লাগে বরাবরই । সঙ্গে খয়ের গ্রুপের চেয়ারম্যান । এই বয়সে এসে, যখনও কিনা আমরা সমাজের বিচার-বৈঠকে দর্শকের আসন ছাড়া এগিয়ে বসবার হিম্মত পাই না, তখনই এরা কেমন করে যেনো সামনের সারিতে চলে গেছে । এবার বাড়িতে গিয়ে শুনি দু’জন ক্লাসমেট পৌরসভার কাউন্সিলর প্রার্থীও হয়ে বসেছে রীতিমতো । সবই আচানক কারবার ।

খয়েরকে বললাম— বেরিয়েছি তো বটে । কিন্তু নদী পার হবো ক্যামনে ?
— সে হয়ে যাবে চাচা । সকালে মাছ ধরা একটা নৌকার গলুইয়ে উঠে পড়বো বলে কয়ে । রস খাওয়া ছাড়া আজ আর কোনো ভাবনা নেই ।

খয়ের আর আমার সম্পর্ক চাচা ভাতিজার বটে । কিন্তু বয়সে খয়ের আমার থেকে আরো খোকা । সে নিয়ে আমাদের কখনো ভাবনা হয় নি । আমাদের ভাবনাটা আজকাল এমনিতেও বেশ কমই বলা চলে । না চাইতেই পেয়ে যাই ঢের । এই যেমন নৌকা খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেছি আস্ত একখানা ট্রলার । ওপারে যাওয়ার জন্যে যাত্রী মিলেছে আরো দু’জন । অল্প বয়সি দুই ছোড়াছুড়ি । পরনে স্কুল ড্রেস । মর্নিং স্কুল চলছে । তারও আগে মাস্টারদার কাছে প্রাইভেট পড়বে এক ঘণ্টা ।

আমাদের সন্ধ্যা নদীর নাব্যতা কম নয়। পরিসরও মোটামুটি ভালোই । মাঝবরাবর যাওয়ার আগেই বৃষ্টি এলো টুপ টাপ । এত শীতে বৃষ্টি । দু’ফোঁট নাকের ডগায় পড়তেই হাড়ে কাঁপন লাগছে । একটুখানি ছই আছে । ছোড়াছুড়ি দুটি ছুটে সেখানে গিয়ে ঢুকলো । আমার হঠাৎ করেই মনে হলো, ওদের দুজনের সম্পর্কে একটু অস্বাভাবিকতা আছে । মনে হতেই সামান্য কৌতূহলও চাগিয়ে উঠলো ভেতরে । ছইয়ের সামনে চটের দুখানা পর্দা ঢালা । তার ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে চাইছিলাম, ওরা ওখানে কেমন করে আছে । মেয়েটা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছেলেটার কাপোলের দিকে । ছেলেটা কিছু বলছে না । একটা চুমু খাবার তাড়না কি ওরা এড়াতে পারবে ? কী জানি । আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম । ভালোবাসার এত গভীর রূপ আমার অকারণেই সয় না । বৃষ্টি এখনও থামছে না ।

খেজুর গাছ খুঁজে পেতে পেতে সূয্যি মামা জেগে উঠেছে আড়মোড়া ভেঙে । ক্ষেতের ফসলকাটা কাস্তে হাতে ধরা অবস্থাতেই রসঅলার ঘাড় ছুঁয়ে বসলাম আমরা । হুমকি দিলাম, যে করেই হোক কাল আমাদের পাঁচ হাড়ি রস চাই, নইলে...। বেরসিক লোকটা হাসলো খানিকটা । আর তখনই মলয়ের আগমন ।

মলয় যে একটা হিন্দু ছেলে তা আমাদের কখনোই মনে হয় নি । আর এখন তো মনে হবার প্রশ্নই আসে না । ও বোধহয় রসুয়াল চাচার কাছে রসের বিল দিতে এসেছিলো । চাচা ওকে ডাকলেন বাশার বলে । আমার অবাক লাগলো না । কারণ, ও যে মলয়, তা আমি তখনও নিশ্চিত নই । তাই মলয় কী করে বাশার হলো, তা-ও আমার কাছে কোনো জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নি ।

সেদিন গভীর রাতে বৃষ্টিটা বেশ ঝেঁপেই নেমেছিলো । আমি কিন্তু টের পাই নি । ফজর নামাজের পরে তাই একটা বড় কলসি আর একজন সাঙ্গ নিয়ে রওনা দিলাম রস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। মসিজদের পাশ দিয়ে যাবার সময় বাবা বললেন— রস তো পানসে হবে আজ । বৃষ্টিতে তারা হাড়ি খুলেছে কি না দেখো ।

খয়েরকেও খুঁজতে গেলাম না। আমার তখন আর তর সইছে না । বহুদিন পরে খেজুরের রস খাবো । আজ কিন্তু ওপারে গিয়ে আর রসুয়াল চাচাকে খুঁজে পেলাম না । তার বাড়ি কোথায় চিনি না । কাল তাকে ধরেছিলাম গাছের পাশেই ধান ক্ষেতে । পাওয়া গেলো মলয়কে । ও এখন কাঠমিস্ত্রীর কাজ করে । হাতের থলেটা অন্তত তা-ই বলছে । পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো মলয় । কথা হলো টুকটাক প্রথমে । তারপর পরিচয় হতে হতে গল্প বেরিয়ে এলো অর্গল ভেঙে । রসুয়াল চাচার ঘর ওর ঘরের সংলগ্নই বলা চলে । আমার হাত থেকে কলসিটা ও কেড়ে নিলো । আমার সাজ-পোশাকের সঙ্গে নাকি কলসিটা মানাচ্ছে না ।

মলয়ের বউ চা বানিয়ে খাওয়ালো । নাটি বিস্কুট আর দুটো রুটি সেঁকে দিলো বড় যত্নে । আমি শুধু ওকে জিজ্ঞেস করার ফাঁক খুঁজছিলাম, ও কী করে মলয় থেকে বাশার হলো । মলয়ের কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল আছে বলে মনে হলো না । বরং স্কুলে একসঙ্গে সেই যে অভিনয় করা, স্কাউটিংয়ের ক্যাম্পিংয়ে যোগ দেয়া, শহিদ মিনারের পেছনে আলো করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়াটার বুকে বসে উন্মাতাল গিটার বাজানো, বিকেল হলে ক্রিকেটের ব্যাট-প্যাড নিয়ে হুটোপুটি— এইসব গল্পেই কেটে গেলো শীতের সুন্দর সকালটা ।

রস তবু পাওয়া গেলো । চাচা বললেন— বাবা, তোমাদের কথা মনে করেই রাতে বৃষ্টির ডাক শুনে আমি আর বাশার গাছ থেকে রস পেড়ে রেখেছি । তবে বাবা, তোমার কলসিটা ভরে দিতে পারবো না। আর কাল যে একশ’ টাকা দিয়ে গেলে, তাতেই হবে । আর লাগবে না । এলাকার বজ্জাত পোলাপান তো জনে জনে এসে হাড়ি খুলে খেয়ে যায়, একটা পয়সাও দেয় না ।

মলয়কে বললাম— চল, এগিয়ে দিয়ে আসবি ।
—আজ থেকে যা। বউকে রসের পিঠা বানাতে বলি ।
—নারে, আমি একা তো খাবো না । বাড়িতে ভাগ্নে-ভাগ্নী আছে । ওরা রস খাবে বলে অপেক্ষা করছে ।
—তাইলে আরেকদিন আসিস ।

ট্রলারে বসে বললাম— চল, ওপারে যাবি । এই ট্রলারে আবার ফিরে আসিস ।
ভাবলাম ট্রলারে বসেই কথাটা জিজ্ঞেস করবো । কিন্তু পুরো নদীটা পেরিয়ে এলাম, একটা কথাও হলো না । সেই ছোড়াছুড়ি দুটির দেখা পেলাম আজো । এগারোটা বেজে গেছে । ওদের মর্নিং স্কুল বুঝি ছুটি হয়েছে । আজ ওরা দুজনেই দুজনার হাত ধরে রেখেছে । আচ্ছা, ওরা দুজন কি ভাইবোন ? হতেও তো পারে । আমি আর আমার বোনও তো স্কুলে হাত ধরাধারি করে যেতাম। আশ্চর্য ! কাল আমার এ কথাটা মনে হলো না কেনো ?

ওপারে পৌঁছে মলয়ই বললো— কী কিছু বলবি ?
—তোকে চাচা বাশার ডাকলো কেনো ?
—এমনি ।
—এমনি ? তুই মলয় থেকে বাশার হয়ে গেলি এমনি ?
একটু হাসলো । সে হাসিতে বিপরীত দুটিমাত্র ভাব— কষ্ট ও সুখ । তারপর বললো— নামে আর কী আসে যায় ?
—তোর মাবাবা কোথায়রে মলয় ?
—আমার সঙ্গে থাকবে না বলে ইন্ডিয়া চলে গেছে, ভগবানের দেশে ।
—তুই গেলি না ?
—আমার ভগবান এখানেই থাকেন, এখানেই ভালো রেখেছেন আমাকে।
বলে আবার একটু হাসলো । আবার দুটি বিপরীতভাবের সমান প্রকাশ ফুটে উঠলো।
—তাহলে তুই এখনো ভগবানের পূজা করিস, মলয় ? মনে আছে, তুই টিফিনের সময় আজান শোনা গেলে বলতি, কি বিশ্রী ডাকরে ভাই, হাইয়া হালার ফালা। মনে আছে ?
—আছে তো। আমি কিন্তু আমাদের মসজিদে আজান দিই জানিস ?
—তুই আজান দিস ? এই না বললি, ভগবানের পূজা করিস?
—তার আগে না বললাম, নামে কি আসে যায়?
—বাব্বাহ । ক্যামনে কী হলো মলয়, বলতো ?
—বলবো, সময় করে আসিস । তোর মাকে আশীর্বাদ জানাতে বলিস । আর শোন, আমাকে কিন্তু ‘বাশার’ ডাকিস না । আমার মলয় নামটাই ভালো লাগে ।

আমি সাঙ্গকে বললাম, তুই কলসি নিয়ে বাড়ি যা । বলিস, আমার আসতে দেরি হবে । তারপর মলয়ের হাত ধরে বললাম—চল, আজ সারাদিন তোর গল্প শুনবো ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৪৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×