somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘আই অ্যাম মালালা’ এবং আমাদের গ্লিটার সোসাইটি

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কোনো কারণ ছাড়াই ‘আই অ্যাম মালালা’ পড়তে শুরু করেছি । ভেবেছিলাম, শুরুটা ও শেষটা পড়ে আগে বোঝার চেষ্টা করবো যে পড়া যায় কি না । কেননা, ভালো-মন্দ যাই হোক সব বই পড়ার যোগ্য হয় না । প্রচ্ছদে মালালার বেশ বড় একটা ছবি, সাধারণত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বা সেলিব্রিটিদের বইয়ে যেমনটা থাকে, যেখানে বইয়ের বিষয়বস্তু জানার চেয়ে লেখক সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকে পাঠকের বেশি ।

সোয়াত উপত্যকায় মালালার বাড়ি, সে-কারণেই বোধ করি— সোয়াতের বেশ কয়েকটা নিসর্গ চিত্র বইয়ের শুরুতে সেঁটে দেয়া হয়েছে এবং ভেতরে লিখে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আক্ষরিক অর্থেই সোয়াত প্রদেশটি এশিয়ার সুইজারল্যান্ড; আমার মতে, এ জাতীয় উপমা আসলে পরাজিত মনোবৃত্তির বহি:প্রকাশ । বিদেশের সবকিছুই ভালো, সবকিছুই লেপাপোছা চকমকে, আমরাই কেবল গাঁইয়া, আমাদের রাতারগুল এশিয়ার অ্যামাজন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, আমাদের ওই জিনিসটা অমুক দেশের তমুক এবং তমুক দেশের অমুক— এই ধরনের ফ্যান্সি মানসিকতা অনুন্নত দেশগুলোর মানুষ বেশ গর্বের সাথে লালন করে । সুতরাং মালালা এ থেকে আলাদা হবার কোনো কারণ নেই ।

শুরুর মতোই বইয়ের শেষেও বেশ কয়েকটি ছবি, তবে শেষের সবগুলো মালালার নানান কীর্তি ও কৃতিত্বের । একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মালালা স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে । নীচে ক্যাপশনে লেখা— স্কুলে গল্প পড়ে শোনাচ্ছি : অল দ্যাট গ্লিটারস ইজ নট গোল্ড ।
ছবিগুলো দেখে যেমন ভালো লেগেছে, তেমনি শুরুতেই কাহিনীটাও মনে ধরেছে বেশ । তাই ভাবছিলাম, পরে পড়বো—কেননা, এই বই সময় করে পড়তে হবে—এমন একটা তাড়নায় ছটফট করতে করতেই দেখি ৩০৮ পৃষ্ঠার বইয়ের প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা শেষ ।


বই পড়ছি এবং নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা বিষয়গুলো তোলপাড় করে যাচ্ছে ভেতরের প্রাণ । সকালেও বেগানা নারীর পর্দাহীনতা নিয়ে দেশ-বিদেশের নানা মুনীর নানামত পড়ে ফেলেছি (বেশিরভাগ মতেরই কোনো রেফারেন্স নেই এবং কথার ঢঙও আমার কাছে গাঁজাখুরি মনে হয়েছে) । বউকে সেবার জরুরি ভিত্তিতে মেডিকেল নিতে হলো । রোগীর অবস্থা শোচনীয় দেখে তড়িঘড়ি করে বউয়ের বড় ভাই যে ডাক্তারের হাতে রোগীকে সোপর্দ করলেন, তিনি অত্যন্ত পরহেজগার ও অভিজ্ঞ গাইনি বিশেষজ্ঞ । কিন্তু তিনি পুরুষ ডাক্তার বলে শ্বশুরের আপত্তির পারদ তুঙ্গে উঠলো, যেহেতু পরহেজগারির বিবেচনায় তিনি আরো এককাঠি সরেস । আমি শুধু বলতে পেরেছিলাম— বাবা, কেবলই নারী ডাক্তার খুঁজছেন, আমাদের চৌদ্ধপুরুষের কেউ যদি তার মেয়েকে মেডিকেলে পড়াতে রাজি না হন, তাহলে এতো নারী ডাক্তার পয়দা হবে কোত্থেকে? আপনার মেয়েদুটিকে মাদরাসায় না পড়িয়ে মেডিকেলে পড়াতেন, তাহলে তো আপনার মেয়ের মতো আরও হাজারও মেয়ে পুরুষের ছোঁয়া থেকে সেইভে থাকতো, তাই না?

আমি মালালার বই থেকে চোখ ফিরাই না । জানি, এই বই যখন লেখা হয়, তখনও মালালা নোবেল শান্তি পুরস্কারটি হাত করতে পারেন নি, যদিও ইতিপূর্বে সাখারভ পুরস্কার ও সিমোন দ্য বেভোঁয়ার বগলদাবা করে ফেলেছেন । তসলিমা নাসরিনের কলামে পড়েছি, মালালাকে সাখারভ পুরস্কার দেয়ার অনুষ্ঠানে তসলিমা নিজেই উপস্থিত ছিলেন জুরিবোর্ডের সদস্য হিসেবে । প্রসঙ্গত: বলি— তসলিমা লেখাও আমাকে বেশ টানে । আমি জানি, স্বীকার করুক আর না করুক, আমার বন্ধুদের অনেকেই তসলিমার কলাম নিয়মিত পড়েন । তসলিমা যখন উত্থান রহিত পুরুষের নিকুচি করেন, ফতোয়ার নামে গ্রামের অবোধ বালিকাদের দোররা মারার বিরোধিতা করেন, সেক্যুলার রাজনীতিকদের ধর্মান্ধ আচরণের সমালোচনা করেন এবং চিৎকার করে বলেন— এই সৈয়দ হক আমাকে ধর্ষণ করেছিলো, তখন আমার বন্ধুরা আমার মতোই হাততালি দেন । মনে হয়, তসলিমার প্রয়োজন আছে । একইভাবে তসলিমা যখন বকধার্মিক প্রলাপ ও ধর্মগ্রন্থের ভার্সেসকে গুলিয়ে ফেলেন এবং নিজে বহুপুরুষের করগামী হয়েও রুদ্রর বহুগামিতাকে মার্জনা করতে অপারগ হন, যখন তার মূর্খতা ‍ও দ্বিচারিতা আমাদের সমানভাবে কষ্ট দেয় ।


আশ্চর্যের কথা হলো, মালালার বইতেও একই রকমের দ্বিচারিতা আমরা খুঁজে পাই । একদিকে মালালা গর্বের সাথে লেখেন তার নাম ব্রিটিশ বিরোধী বীরাঙ্গনা মালালাই মেইবান্দের নামানুসারে রাখা, যার বীরত্বগাঁথা শুনে শুনে মালালা নিজেকে তার মতো সাজানোর স্বপ্ন দেখেন, অন্যদিকে সেই ব্রিটিশদেরই পুতুল হয়ে তিনি বৃটেনের বার্মিংহামে বসবাস করেন এবং বৃটেনের চেয়ে পাকিস্তান কতটা পিছিয়ে আছে নি:সঙ্কোচে সেই বয়ান পেশ করেন । একই সঙ্গে তিনি মাতৃভূমি পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার উক্তিও তুলে ধরেন সেই দেশের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, যারা পাকিস্তানকে বোমা মেরে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেবার হুমকি দেয় অহর্নিশ ।

সচেতনভাবেই মালালা টাইপ রাজনীতি সাপোর্ট করি না আমি । কিন্তু যখন দেখি কোনো কিন্ডার গার্টেনের সামনে থেকে অভিভাবক নারীদের দুদ্দূর তাড়িয়ে দেয়া হয় (কেননা, মায়েদের গল্পগুজবে স্কুল কমিটির ইজ্জত যায়), প্রবাসী স্বামীর ভার বওয়া তরুণীর কোমর ভেঙে পড়ে সমাজের লজ্জায়, পেটে-ভাতে বেঁচে থাকতে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মেয়েটির বিয়ে ভেঙ্গে যায় পুরুষের গা ঘেঁষে কাজ করার অপবাদে, মাওলানা ছেলের বউ থাকে পর্দায় আর বিধবা মা প্রখর রোদে পুড়ে পুড়ে উঠানের ধান শুকায় এবং যখন দেখি, সমাজের মৌলভিরা মুখে আওয়াজ তোলেন— শিক্ষার উদ্দেশ্য নৈতিক উৎকর্ষ সাধন, অর্থ ‍উপার্জন নয়; আবার তারাই নারীশিক্ষার সিলেবাস খাটো করে বলেন— মেয়েদের এতো পড়ার কী দরকার, তারা তো আর...তখন মনে হয় , সমাজের অর্গল ভাঙতে দুয়েকজন মালালার প্রয়োজন আছে ।


‘আই অ্যাম মালালা’ পড়তে পড়তে হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করে ওঠে— আচ্ছা, তালিবানের বন্দি দশায় থেকেই ইয়োভনি রিডলির মতো ব্রিটিশ সাংবাদিক ইসলাম গ্রহণ করেছেন । সেই তালিবান মালালার মতো ছোট্ট একটা মেয়ের ওপরে কী করে এতটা নৃশংস হতে পারলো? । তাহলে কি এই তালিবান সেই তালিবান নয়? মালালা লিখেছেন— বান্ধবীরা পরে আমাকে বলেছে, গুলি করার সময় ছেলেটার হাত কাঁপছিলো । ছেলেটা নিশ্চয় সুপুরুষ নয়, কাপুরুষ ছিলো । সম্ভবত সেটা প্রমাণ করতেই বইয়ের প্রথম অধ্যায়টি শুরু করেছেন মালালা একটি ফার্সি (তাদের ভাষায় পশতু) কবিতা দিয়ে, যার অর্থ— যুদ্ধের ময়দান থেকে কাপুরুষতার খবর আনার চেয়ে বরং তোমার বুলেটে ঝাঝরা দেহ তুলে আনা অনেক গৌরবের ।

বইয়ের শেষ ক’টি লাইনে মালালা লিখেছেন— সোয়াত উপত্যকা এখন অনেক শান্ত । কিন্তু যে বাসে আমাদের গুলি করা হয়েছিলো, সেই বাস ড্রাইভার এখনো গৃহবন্দি ।... এখন আমি রোজ আয়নার দিকে তাকাই, চিন্তা করি, একসময় আমি এক বা দুই ইঞ্চি লম্বা হওয়ার জন্যে দোয়া করতাম । তার বদলে আল্লাহ আমাকে আকাশের সমান বড় করেছেন । আমি আমার আল্লাহকে ভালোবাসি । তিনি সত্যিই মহান । মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্যে তিনি আমাকে উচ্চতা দেয়ার পাশাপাশি মহান দায়িত্বও দিয়েছেন । প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি সড়কে, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে— এই আমার স্বপ্ন । স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে চেয়ারে বসে পড়াশুনা করা আমার অধিকার । আমি মালালা । আমার পৃথিবী বদলেছে । আমি বদলাই নি ।

কী বুঝলেন? অল দ্যাট গ্লিটারস ইজ নট গোল্ড— হুহু, চকচক করলেই সোনা হয় না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:৩২
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×