লোকটা হুড়োহুড়ি করে ওঠার পরেও আপত্তি করি নি । পাশের সিটের মেয়েটা উঠে যাবার পর যখন কয়েকজনকে ডিঙিয়ে ঝট করে সেখানে বসে পড়লেন, তখনও সামান্য একটু নাক-মুখ কুঁচকে তাকিয়েছিলাম মাত্র—এ আর তেমন কি !
তিনি স্মার্টফোন খুললেন, ধীরে ধীরে, যেন পবিত্র কোরআনের গিলাফ খুলছেন । দুয়েকবার শার্টের হাতায় ঘষে মুছলেনও । তারপর সত্যি সত্যি কোরআন অ্যাপস ওপেন করে আবৃত্তি আরম্ভ করলেন । তার পাশের লোকটা ট্রং ট্রং করে গেমস খেলছেন । তিনি বিরক্ত হয়েও ফিরে তাকালেন না ।
জায়গা পেয়ে করিডোরের ওপাশের সিটে বসলাম । ব্যাগে ছটফট করছে এমিলিও সালগ্যারির ‘থাগস অব হিন্দুস্তান’, সেটার মলাটে আবার জনৈক রূপবতী নারীর গঙ্গাস্নানের দৃশ্য—বের করে পড়তে সাহস পাচ্ছি না । এই বই পড়তে হলে প্রথমে টুপি খুলতে হবে, তারপর জানালার পাশের সিটে বসে মাথাটা সামনের সিটে ঠেস দিয়ে একনাগারে পড়ে যেতে হবে । যাতে জানালা গলে হু হু বাতাসের যাতায়াতের সাথে থ্রিলিং উত্তেজনা বাড়তে কমতে পারে । গত রাতে রেমার্কের ‘শ্যাডোজ ইন প্যারাডাইস’ শেষ করার পরে যে-পরিমাণ মনখারাপ হয়েছে, সেটা চাপা দেওয়ার আর কোনো উপায় নেই ।
সেটা যেহেতু হচ্ছে না সুতরাং কোরআন শোনাই ভালো । আওয়াজ স্পষ্ট না । লোকটার সামনের সিটে জায়গা নিয়ে বসলাম । শব্দের গতি সামনের দিকে হওয়ায় বোঝা গেলো ইঁদুরের মতো চিহি চিহি স্বরে তিনি পাঠ করছেন— উলা--কা-দ কাররামূ---না-- বা--নী--আ-দামা-। তারপরেই টেলিভিশনের নেপথ্য কণ্ঠে গমগম স্বরে আবৃত্তি করলেন— নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি...; যেন শিমুল মোস্তফার কণ্ঠে বিদ্রোহীর রেকর্ড ।
এই জাতীয় ভণিতা বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব না । এটা এক জাতীয় সুখীয় ভণিতা । সুখ খুব বিরক্তির জিনিস । খোদা আমাদের একটানা দু:খ সহ্য করার শক্তি দিলেও একটানা সুখ সহ্য করার ক্ষমতা দেন নি । মনে হলো, লোকটাকে বলি—ভুলভাল কোরআন পড়ছেন কেনো? কিন্তু তাতে তিনি উল্টো খেপে ওঠার সম্ভাবনা ।
ধর্ম তো এমনই আমাদের কাছে । ধর্মের মূলপাঠ পড়ি চিহি সুরে, আর তর্জমা করি গলাফাটিয়ে । ধর্মের কথা বলি মিনমিনিয়ে, কিন্তু ধর্ম দেখাই ধুমধাম করে । ভক্তির চাপে ধর্মকে খুলতেই ভয় পাই, বারবার শার্টের হাতায় মুছি, পাছে না আবার গোস্তাখি হয়ে যায় । ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে তর্ক তো ভালো, প্রশ্ন করতেই পারি না—না আবার খেপে ওঠে ধর্মবেত্তারা । ধর্মগ্রন্থ খাবারের ব্যাগে বহন করতে পারি না তাই থ্রিলার-নোভেল ঢুকিয়ে রাখি ।
টুপিও খুলে যাচ্ছে আরামের ছলে ।
এইভাবে ধর্ম আমাদের পাবলিক স্ফেয়ার থেকে বের হয়ে গোপন কুঠুরিতে ঢুকে পড়ছে, বাকি আছে শুধু জাঁকজমক । মসজিদের মিনারের উঁচুতে উঠেছে চাঁদতারা, আর নীচে প্রদীপের অন্ধকার দিকের মতোই জৌলুসের স্বর্ণ-মার্কেট । চারপাশে কোলাহল, হকারের হাঁকডাক, ধর্মান্ধ রাজনীতিকদের গলাবাজি—মধ্যখানে পড়ে এবাদত অদৃশ্য হয়ে গেছে, শুস্ক মরুভূমির মাঝে শূন্য মরুদ্যানও ঢেকে গেছে ভুলভুলাইয়ার ছায়ায় ।
তবু আজও মসজিদের শহরে আজান হয়, এইভাবে ভুলভাল পাঠকে পুঁজি করেই নামাজ পড়ে মানুষ—এইটুকুই ভরসা ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:২৮