বহুদিন আগের একটা ঘটনা বলি ।
আমাদের গ্রামের বাজার থেকে মোবাইল ফোনের ব্যাটারি হারিয়ে গেছে আমার চাচাত ভাইয়ের । একটা ফটোস্টুডিওতে চার্জে দিয়েছিল ফোনটা, কে যেন শুধু ব্যাটারিটা খুলে নিয়ে গেছে ।
মাগরিবের আজান হয় হয়, এমন সময় একটা কাঠের ঘরের দোতলায় স্থাপিত সেই স্টুডিওর লোহার সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আব্দুর রহমান সংবাদটা আমাকে দিল । অবাক কাণ্ড । মোবাইল রেখে ব্যাটারি নিয়ে যাবে কে ?
দোকানের মালিককে নামাজের পরে চেপে ধরলাম । তিনি সন্দেহ করলেন কাউকে, যে তার দোকানে আধঘণ্টা আগে সামান্য কাজে এসেছিল । তিনি ছেলেটার একটা ছবিও বের করলেন, কিছুদিন আগের তোলা ।
আমরা আরও অনেক খোঁজখবর করে কোনো সূত্র মেলাতে না পেরে শেষে অনেকটা বাজি মেনেই ছেলেটার বাড়িতে পৌঁছলাম । সে-সময় একটা ব্যাটারির দাম ৩০০ টাকা । বয়সও বেশি নয় । সামর্থ্যের বিচারে সেই অর্থ তখন অনেক । রাত হয়ে গিয়েছিল । বাড়িও ছিল অন্তত দু-মাইল দূরে । ছেলেটাকে পেলাম, কিন্তু সে দোর খুলে বেরিয়ে এলো না । আমরা মুরব্বি গোছের একজনকে ছবিটা দেখালাম । বললাম— ব্যাটারিটা পেলেই আমরা চলে যাবো । হাঙ্গামা হবে না ।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, খুব অল্পক্ষণের মধ্যে পুরো বাড়িতে শোরগোল উঠল এবং নারী-পুরুষ, যুবক-তরুণী, এমনকি কিশোর ছোকরারা পর্যন্ত পড়া ছেড়ে বেরিয়ে এলো । আমরা তাদের বোঝাই যে, সে নাও নিতে পারে অথবা সে ভুলও করতে পারে । কিন্তু বেশ কয়েকজন বয়স্ক নারীর উচ্চৈ:স্বরের ফিসফাস শুনে বুঝলাম যে, তাদের একই বক্তব্য— ওই ছেলেই যদি ‘চুরি’ না করবে, তাহলে এই ছবি এলো কোত্থেকে ?
ফেঁসে গেছি, ফিরে আসার পথ নেই । একটা ছবি, শুধু নির্বাক সেই ছবিটা চিরদিনের জন্যে এলাকায় ছেলেটার বদনাম করে দিল ।
যদিও সে-সময় সেজন্যে আমাদের শীতের রাতে পাক্কা দু-দু মাইল করে চার মাইল হাঁটার কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল । তবে এখন এই সময়ে হলে তার আর দরকার হতো না—ফেসবুকে পোস্ট করে দিলেই কেল্লাফতে ।
কেননা, ফেবু-প্রজন্মের কাছে ঘটনার সত্যতা প্রমাণের সবচে’ বড় ডকুমেন্ট হলো— “মনযূরুল হক ছেলেটা কেমন?” টাইপের একটা সংশয়পূর্ণ পোস্ট, অথবা ক্যারিশম্যাটিক ছবি, তিনপয়সার নিউজ লিংক, ঠাট্টা ফুটিয়ে তোলা কমেন্ট, এমনকি কখনও কখনও কারও লাইক কিংবা হাসি-কান্নার ইমোজিও হতে পারে ।
শুধু অভিযোগ লিখে ঘুমিয়ে পড়ুন, সকালে জেগে দেখবেন— কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি চোর, মেয়েবাজ, বেনামাজি, নাস্তিক, কিংবা ইহুদি-খ্রিস্টানদের দালাল হয়ে গেছে—আইন-আদালত, যুক্তি, আপিল, বিচার, সাক্ষী, স্বীকারোক্তি এমনকি সামান্য জিডি-এফআইআরও প্রয়োজন হয় নি ।
কাউকে অপমান করে মানুষ যতখানি আনন্দ পায়, খুব সম্ভব ততখানি আনন্দ তার অন্যকিছুতে আর হয় না । দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা তো দূরের কথা মানুষের সম্মান রক্ষায় ধর্মের কঠোর বিধি-নিষেধও চোখে ছায়া ফেলে না ।
‘আজ এই হজের মাস, মক্কার পুণ্যভূমি যেমন সম্মানযোগ্য ও পবিত্র, তোমাদের পরস্পরের ইজ্জত-আব্রু, মান-সম্মান তেমনই পবিত্র’—নবীজির এই বক্তব্য, কিংবা কুরআনের আয়াত ‘ইন্না বাদায যন্নি ইসম’, অথবা ‘শোনাকথা বলা মিথ্যাবাদি হবার জন্যে যথেষ্ট’, কিংবা কাউকে অপবাদ দেওয়ার ভয়ংকর নরক-দণ্ড—স্ক্রিনে অবলীলায় ভেসে যায়, আমাদের দমাতে পারে না ।
আমার একটি একলাইনের পোস্ট, একটি ক্লিকের শেয়ার, মাউসের সামান্য প্রেস থেকে লাইক, কিংবা একটি বিদ্রুপাত্মক কমেন্ট যে, একজন মানুষের গোটা জীবন রোদনে ভরিয়ে দেয়, লেখক তার লিখনি চিরতরে থামিয়ে দেয়, সমাজ তাকে বহিষ্কারের শাস্তি দেয়, লজ্জায় গুটিয়ে শামুক হয় জ্যান্ত পাখি, প্রখর যুক্তিবাদিতার মৃত্যু ঘটে, ভালবাসায় বিচ্ছেদ নামে, আত্মহত্যার হলাহল ওঠে, কৃতিত্বের গতি হারায়....
তারপর তার শেষরাতের আহাজারিতে আমি হই খোদার কাঠগড়ায় দুর্বিনীত আসামী—আমি তার কিছুই জানি না ।
অজস্র অপবাদের ভাণ্ডার, আমাদের পাপের সবচে’ বড় সাক্ষী, আমাদের সকল অনৈক্য আর অগণিত সম্ভাবনার মারণাস্ত্র হলো কী করে ফেসবুক —
আমার কারণেই কি ?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১০:৫৬