somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভাত নেই

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গত প্রায় ৫ বছর বিএনপি মাঠে নেই । কয়েকবার মুমূর্ষুকালও পার হয়েছে । আমাদের আশা ছিল—এই সুযোগে ইসলামি দলগুলো বাজিমাৎ করতে পারে কি না । ইসলামি ঘরানার বেশ কয়েকজন সচেতন বুদ্ধিজীবী তাদের কলামেও এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন । একজন তো বলেছিলেন—ওলামায়ে কেরামের ঐক্য মাত্র ১০ মিনিটের ব্যাপার ।

একটা তিক্ত সত্য হলো, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভোট নেই—চাই তা ধর্মভিত্তিক হোক বা না হোক । যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে না—যেমন আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—তাদের ভোটই সবচে’ বেশি । কিন্তু তারপরও তারা একটা ঐক্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । জামায়াত পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক না, আবার অসাম্প্রদায়িকও না । ফলে তাদের ভোট আরেকটু বেশি । তারাও ঐক্য করছে । বামরাও আসলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই করে—ইসলামি দলগুলোর মতোই । কেননা, তারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে সাম্প্রদায়িকদের মতো করেই । ফলে তাদের অবস্থাও অনুরূপ । বামরাও একই আদর্শিক হওয়ার পরেও নিজেদের সমমনা দলগুলো নিয়ে ঐক্য করতে পারছে না, যেমন ইসলামি দলগুলো এক হচ্ছে না । বামরাও একইভাবে ভাঙছে এবং ‘অসাম্প্রদায়িক’ দলগুলোর ঐক্যে-অনৈক্যে তা দিচ্ছে ।

ইসলামপন্থীদের ভোট নেই, তার অনেক কারণ । এক নম্বর হলো— বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ । এখানে মানুষের কল্যাণ মেজরিটি ইসলামের কল্যাণই বটে । সেটার দিকে না গিয়ে নতুন করে ‘ইসলামপন্থী রাজনীতি’র মডেলটা ভোটের প্রশ্নে সাধারণ মানুষের কাছে এখনও বিতর্কিত জায়গায় থেকে গেছে । ভোট ছাড়া আপনি যত কূটনৈতিক পন্থায়ই আগান, ন্যায্যতার সংকটে পড়বেনই । ভোট থাকলে আপনি ক্ষমতায় কখনও না চড়লেও ন্যায্যতা আপনি পাবেন—গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এ-ই নিয়তি । এ-কারণে ইসলামি দলগুলো ফাঁকা মাঠ পেয়েও গোল দিতে পারে নি । এমনকি ইসলামি সবগুলো দলের ঐক্য হলেও বিএনপির শূন্যস্থান পূরণ হবে কি না—সন্দেহ । এখন যেখানে বিএনপির মতো দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা দলগুলোরই ভাত নেই, সেখানে ইসলামি দলগুলোর তো মিছিল-মিটিং ছাড়া পূর্ব-অভিজ্ঞতাও নেই, সুতরাং... ।

অনুমান করি— এইসব কথা সম্ভবত ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ জানেন । এবং জানেন বলেই নিজেদের মধ্যে জোট না করে বিএনপি-আওয়ামীলীগ-জাতীয় পার্টির মতো দলগুলোর পশ্চাতে পশ্চাতে নির্বাচনী আসনের বখেরা পেতে থালা বাড়িয়ে রাখছেন, রেখেছেন—হয়তো ভবিষ্যতেও রাখবেন । যোগফল কী দাঁড়াল ? আপনার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক থিউরি বাংলাদেশে ইসলামপন্থার বিকাশ ঘটাচ্ছে না, বরং প্রাক্টিসিং মুসলিমদের বহুক্ষেত্রে হাস্যকর, লাঞ্ছনাকর ও অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিচ্ছে ।

ইসলামি আন্দোলনের একজন তর্কবাগীশ রাজনীতিকের সঙ্গে একবার আলাপ হলো—তারা কেনো শতাধিক আসনে প্রার্থী দেন, অথচ কোনো আসনে জয়লাভ করেন না, বরং জমানতও হারানোর মতো অপমানিত হন । তিনি বললেন—তারা আসলে গণতন্ত্র করেন না; ইসলাম করেন । যার ফলে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা তাদের উদ্দেশ্য নয়, ইসলামের প্রতি মানুষের সমর্থন কতটা সেটা দেখাই উদ্দেশ্য ।
একটা ইসলামি দলকে ভোট না দেওয়া পাবলিক আসলে ইসলাম সমর্থন করে না—এই যুক্তি কতটা ন্যায্য ? এটাকে ন্যায্য ধরলে বাংলাদেশে ইসলামকে শতভাগে বিভক্ত করতে হবে । কারণ ইসলামি দল শতাধিক । কোনটায় ভোট দিলে কতটুকু ইসলামের প্রতি সমর্থন প্রকাশ পাবে—তার পরিমাপ কে ব্যাখ্যা করবে ?

আপনি যদি বলেন যে, আমাদের দলের অমুক নেতাকে ভোট দিলে আল্লাহর রসুলকে স. ভোট দেওয়া হবে—তাহলে এটা আপনার চরম ভুল হবে । কেননা, এর মাধ্যমে আপনি বোঝাতে চাইলেন যে, আপনি এমন একজনের পক্ষে ভোট চাইলেন, যিনি সর্বাংশে রসুলের স. প্রতিনিধিত্ব করেন । আসলে কি করেন ? তিনি যে-সব পাপ করেন, প্রকারন্তরে যেসবের দায়ও রসুলের ওপর চাপাচ্ছেন না তো ? দ্বিতীয়ত: এর মাধ্যমে কি আপনি বলতে চান, যারা তাকে ভোট দিচ্ছে না, তারা রসুলকে স. ভোট দিচ্ছে না ? তাহলে কি তা প্রকাশ্য কুফুরি হবে না ? রসুলকে ভোট না দেওয়া (সমর্থন না করা) কি কোনো মুমিনের পক্ষে সম্ভব ? বাকিরা কি তাহলে মুমিন নয় ?


জনভিত্তি কম, তবুও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে মাঠে নামে বাম সংগঠনগুলো।


এটা তো সত্য কথা যে, ইসলামি দলগুলো জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত খুব একটা নয় । অন্যান্য দলও ক্ষমতার বাইরে থাকলে জনকল্যাণমূলক কাজ করে না, করার সুযোগ পায় না । কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে তারা সেই সুযোগের মুখোমুখী হতে পারে । নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তাদের অনেকগুণ সামনে অগ্রসর করে দেয় । অর্থাৎ তারা বলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলে অমুক করবো, সমুক করবো । মানুষ খুশি হয় । যদি তাদের আশার প্রতিফলন ঘটে—ভোটও দেয় । জয় পেলে কিছু অংশ তারা করেনও বটে । যেহেতু ইসলামি দলগুলো ক্ষমতায়ই যেতে পারে না—তাই তারা আংশিকও করতে পারে না । এমনকি তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাও যেহেতু নাই, তাই তারা ভোটও পায় না । শুধু সুরা-কেরাত পড়ে তো আর ভোট কালেকশন করা যায় না ! আপনি তাদের বাড়ির পিছনের সাঁকোটা মেরামত করবেন কি না—তারা ভোট দেয় সেই প্রতিশ্রুতিতে । আপনার বর্ণিত ‘ইসলাম’ দিয়ে যেহেতু দুনিয়ার সাঁকো পার হওয়া যাবে না, তাই তারা ইসলামকে আখেরাতের সম্বল বিবেচনা করে এবং দুনিয়ার সাঁকো যিনি মেরামত করে দিতে পারবেন, তাকে ভোট দেয় । যদি ভোট দেওয়ার সুযোগ আসলেই তার হয় ।

দ্বিতীয় নম্বর হলো, ইসলামি দলগুলো আসলে রাজনীতির মাধ্যমে কী করে ? তাদের ব্যাখ্যা— তারা ইসলামের পক্ষে লড়ে । ইসলামের ওপর আঘাত এলে তারা মোকাবেলা করে । এভাবে তারা বোঝাতে চায়, বাংলাদেশে অন্যান্য দলগুলো নানান প্রক্রিয়ায় ইসলামের ওপর আঘাত হানতে চায় । তারা না থাকলে এই আঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব হতো না । দেখুন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে একটি মুসলিম দেশে যারা মেজরিটি ভোট পায়, তাদের আপনি প্রকারন্তরে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, যার প্রভাব সেই দলগুলির বাঁধা-ভোটার ও কর্মীদের মধ্যে পড়বেই । ফলত তারা ‘ইসলামি’ দলগুলোতে যোগদানের সম্ভাবনা কম । অথচ তাদের বাইরে নিরপেক্ষ এত বড় শ্রেণি নেই, যাদের আপনি নিজের দলে এই কথা বলে টেনে এনে মোক্ষলাভ করতে পারবেন ।

আবার হেফাজতের উত্থানের পর তাদের এই চিন্তা বহুলাংশে ভুল প্রমাণিত হয়েছে । বোঝা গেছে, ইসলামের ওপর আঘাত মোকাবেলা করার জন্যে রাজনীতির তরিকার দরকার নেই—অরাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমেও সম্ভব । বাংলাদেশের শতাধিক ইসলামি রাজনৈতিক দল যা করতে পারে নি, হেফাজত অরাজনৈতিক শিরোনামে এবং অরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ও নেতৃত্বের মাধ্যমে সেটা করেছে । যদিও হেফাজতের ব্যানারের ছায়াতলে বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতারাও ভিড়ে গেছেন, কিন্তু তাদের সেখানে পরিচয় ‘অরাজনৈতিক’ই বটে । উপরন্তু একই নেতারা যখন আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলেন, তা পূর্বের মতো জনগণকে হাস্যকর উপাদান উপহার দিয়েছে—গুণগত পরিবর্তন ঘটায় নি । যার উদাহরণ— ইসলামি আন্দোলন (চরমোনাই) বিষয়ক বিরোধ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ইসলামি ঐক্যজোটের স্ট্যান্ডবাজি, গত কয়েকটা স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের বেহাল সমীকরণ এবং এখন সংসদ নির্বাচনে আসন বণ্টন বিষয়ক চাটুকারিতা ।

একটা কথা মনে রাখা উচিত, একটি মুসলিম দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার বহুমাত্রিক সমস্যার প্রধানতম হলো—ভোট পাওয়ার সমস্যা । এমনকি এতে করে ইসলাম-প্রশ্নে জনগণ বিভিন্নভাবে বিভ্রান্তও হয় বটে । যার ফলেই বহুদিন ধরে এ-দেশে ‘গণতন্ত্র ইসলামে বৈধ কি না’—সেই প্রশ্নে বিতর্ক চলেছে খোদ ইসলামপন্থীদের ভেতরেই । পরিষ্কার সমাধান কি এসেছে ? তারপরে ভোটারদের মধ্যে ‘মাওলানা ও ইমামগণ কেন রাজনীতি করবে’—এই প্রশ্নও ছিল বহুদিন ।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সকল প্রশ্নের সমাধান করে যারা নির্বাচনে সফলতা পেয়েছেন, তারাও মেইনস্ট্রিম রাজনীতিকেই প্রধান থিউরি হিসেবে নিয়েছেন । এমনকি দলের নামগুলোও ‘জনবান্ধব’ করার চেষ্টা করেছেন । যেমন— ইখওয়ানের ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’, ফিলিস্তিনের ‘হামাস’ ও ‘ফাত্তাহ’, তুরস্কের ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ (একেপি), সুদানের ‘পপুলার কংগ্রেস পার্টি’, পাকিস্তানের ‘মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট’ ইত্যাদি । ‘ইসলামি আন্দোলন’, ‘খেলাফত মজলিস’, ‘ইসলামি মোর্চা’, ‘ইসলামি ঐক্যজোট’—এই টাইপের কিন্তু নয়—লক্ষ করুন ।

আবার সাংগঠনিক স্ট্রাকচারের দিক থেকেও অন্যান্য দেশের দলগুলো অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর কাঠামো অর্থাৎ প্রোপার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোই ফলো করে । ভোটের প্রচারও তাদের মূলধারার দলগুলোর মতোই অনেকটা— নির্বাচনী ইশতেহার, উন্নয়নের প্রচার, নারীদের মাঠে নামানো ইত্যাদি । এইসবকিছু করার পরেও তারা ক্ষমতার আসনে বসতে পেরেছে কমই । ব্যতিক্রম তুরস্ক । এবং তুরস্কের এরদোগান মডেল খাতা-কলমে আমাদের দেশের আওয়ামী বা বাম মডেলের চেয়েও ‘উদার’ । বাস্তবে তো আরও বেশি—সেটা আপনারা টেলিভিশনে একেপির বিভিন্ন প্রোগ্রামের পুটেজ দেখে বুঝতে পেরেছেন । রাজনৈতিক দলের ম্যানুয়াল, শাসনতন্ত্রের ম্যানুয়াল, অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের মডেলও তাদের রেডি । তারপর বিদেশিদের সাথে পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও তারা বেশ শাক্তিশালী । এতকিছুর পরেও বিশ্ব রাজনীতিতে তারা টালমাটাল অবস্থায় পড়েছে—ইসলাম মনোভাবের হওয়ায় । সেখানে আমাদের শতাচ্ছিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা যে কতটা করুণ এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক বিবেচনায় বয়ান করার মতোই না—তা না বললেও চলে ।

গত ১০ বছরে বিএনপির ওপর যে-পরিমাণে নিপীড়ন-নিগ্রহ চলেছে, জামায়াতকে যেভাবে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে, তার সিকিভাগও কি ইসলামি রাজনীতিকদের ওপর আপতিত হয়েছে ? তারপরও মাঠের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বিএনপির ভোট কমে নি, জামায়াতেরও না—সুতরাং ইসলামি দলগুলোর ভোটও বাড়ে নি মোটেই । পিছনে ফিরে দেখলে অনুমান করুন, গত দশ বছরে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি মোটেও কি বেড়েছে, সাংগঠনিকভাবে কি আগের চেয়ে পরিণত হয়েছে—নাকি আগের চেয়ে আরও ভঙ্গুর । কেনো ?

৫ মে’র পরে একটা বিস্ময়কর পরিবর্তন আমরা লক্ষ করেছি যে, ৫ টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে । একটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম ছিল— ‘জোট-মহাজোট নয়, খেলেছে হেফাজত ।’ অথচ লক্ষ করুন, সেখানে আওয়ামীলীগের বিকল্প হিসেবে কিন্তু কোনো ইসলামি রাজনৈতিক দলের সফলতা আসে নি—এসেছে বিএনপির । আবার এবারের সেই গাজীপুরে নির্বাচনে ইসলামি ঐক্যজোট ভোট পেয়েছে অপমানজনক । ঐক্যজোটের একজন সিনিয়র নেতা জানলেন— কারণ, প্রচারণা ছিল, আওয়ামীলীগের যিনি প্রার্থী, তাকে নাকি হেফাজতের পক্ষ থেকে সমর্থন জানানো হয়েছে । তা ছাড়া তিনি রমজানে প্রতিটি মাদরাসায় ২০ হাজার করে টাকাও দিয়েছেন ।


ইসলামি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে মাঠে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের তৎপরাই এখন বেশি।


সমীকরণ তাহলে কী বলে ? ইসলামের প্রতি আঘাত কিংবা ইসলাম অবমাননার মতো বিষয় সামনে এলে মানুষ হয়তো ‘অসাম্প্রদায়িক’ দলগুলোর একটির জায়গায় অন্যটি বেছে নিচ্ছে— কিন্তু ইসলামি রাজনীতিকদের নয় । যদিও সেই ভোটাররা ইসলামিক ইস্যুতে প্রভাবিত হচ্ছেন, মিছিল-সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন । কিন্তু ইসলামি দলকে ভোট দিচ্ছেন না । ‘কেনো’—সেটা এবার পূর্বের আলোচনা থেকে মিলিয়ে নিন । সুতরাং ইসলামের ওপর আঘাত কিংবা ইসলামের ওপর অবমাননার অজুহাতকে পুঁজি করে অন্তত ভোট আদায় বাংলাদেশে সম্ভব নয় । আসল কথা হলো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক দেশে ‘রাজনীতি ও ইসলাম’ কিংবা ‘ইসলামি রাজনীতি’র প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা দু:সাধ্য । সাধারণ জনগণ শাসনতন্ত্র বোঝে না, যতটা উন্নয়ন সহজে বোঝে । আর ইসলামপন্থীদের এটিচুড শাসতান্ত্রিক পরিবর্তনকে যতটা ফলাও করে—ততটা উন্নয়ন নয় । বরং ইসলামপন্থীরা জনকল্যাণমূলক কাজ করলেই সেটা প্রকারন্তরে ইসলামের খেদমত—এটা বিবেচনায় নিয়ে এগোনোও ভালো মনে হয় । যেটা এরদোগান মডেল ।

তবে একটা জরুরি কথা, দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ—আইন, প্রশাসন ও বিচার—এর মধ্যে রাজনৈতিকভাবে কেবল সংসদে আসন দখলের মাধ্যমে আইন বিভাগ (যেটার মাধ্যমে ইসলামি শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন করার টার্গেট করা হয়) হাত করা যায় বটে, বাকি দুটি বিভাগে প্রভাব খাটানো গেলেও ‘হাত’ করা সম্ভব হয় না । বরং এভাবে বলা ভালো, বাকি দুটি বিভাগে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকলে সংসদে টিকে থাকাও অসম্ভব । জামায়াত-বিএনপি একারণেই সার্ভাইভ করতে পারছে । সুতরাং সার্বিকভাবে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও তখন অধরাই থেকে যাবে । মিশরে তো ইখওয়ান ওইসব ট্যাকল দেওয়ার পরও পারে নি—সামরিক বাহিনীকে হাত করতে না পারায় । বিদেশি চাপের কথা বাদই দিলাম ।

আর কওমি মাদরাসাই যেহেতু ইসলামি দলগুলোর কর্মী তৈরির প্রধান উৎস এবং এখানে পড়ে ব্যারিস্টার হওয়া যায় না—অর্থাৎ বিচার বিভাগে যাওয়া যায় না । আবার সচিব ও উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হওয়া যায় না—অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ বা প্রশাসনে যাওয়া যায় না । একইভাবে সামরিক বাহিনীতেও যাওয়া যায় না, একইভাবে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোতেও নিয়োগ পাওয়া যায় না—সুতরাং ইসলামি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পাওয়ারফুল জনবল তৈরির বিষয়টি এখনও কোনো মাত্রাতেই আসতে পারে নি । তা ছাড়া, অন্যান্য দলের মতোই ইসলামি দলগুলোকেও অর্থব্যয় করতে গিয়ে ডোনেশন কালেক্ট করতে হয় । সে-ক্ষেত্রে ইসলামি রাজনীতিতে অর্থায়নকারী ব্যক্তিদের অর্থের পরিমাণ ও অর্থনৈতিক সেক্টরে অবস্থানও অতি দুর্বল— সেদিকটাও কিভাবে তারা কাটিয়ে উঠবেন, ভেবে দেখা দরকার আছে ।

এইসবই হলো চরম বাস্তবতা । একজন রাজনীতিক হিসেবে আপনি এগুলো এড়িয়ে যেতে পারবেন না, একজন ইসলামপন্থী হিসেবেও নয় । বরং বাগাড়ম্বরের আকাশ ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে নেমে না আসলে সকল বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধি অযথা খরচ হবে, কলাম হবে অরণ্যে রোদন এবং রাজনৈতিকভাবে ইসলামপন্থীদের সকল ইশতেহার কেবল দিবাস্বপ্নই রয়ে যাবে বৈকি । ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেও (তাদের মতে) অসাম্প্রদায়িক কাপালিকদের লেজুড়বৃত্তির বলয় থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না, চাই তাতে যত সুসময়ই তারা পাক— হলফ করেই বলা যায় ।

[বি.দ্র. ভারত বিভক্তির আগে ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ বলতে বুঝাতো, হিন্দু ও মুসলিমদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড । কিন্তু দেশভাগের পর এবং তারও পরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হবার পরে এখন আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বলতে সাধারণ মানুষের ‘মুসলিম রাজনৈতিক দল’ বোঝায় না—বরং মুসলিমদের মধ্যে আবার নির্দিষ্ট মতাদর্শিক শ্রেণির রাজনীতিকে বোঝায় ।]
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০৫
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×