somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পদ্মপুকুর

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সামনের সিটে বসা কম বয়সী ফর্সাকরে স্মার্ট সেলেটা তার মোবাইল ফোনে বার বার বলছে ‘আমি নিলেশ, আমি নিলেশ’। হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা তাই অপর পাশের মানুষটা বুঝতে পারছে না। আমাদের মধ্যে কিছু ব্যাপার নিজের অজান্তেই ঘটে যায়। এই যেমন আমরা সবাই জানি মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় আমরা স্বাভাবিক স্বরে কথা বললেই অপরপাশে শুনতে পাবে, কিন্তু যখন নেটওয়ার্ক সমস্যার কারনে শুনতে সমস্যা হয় অজান্তেই স্বর উঁচু করে কথা বলা শুরু করি, ব্যাপারটা এমন যেন উঁচু স্বরে বললে অপরপাশে স্পষ্ট শোনা যায়। ঠিক তেমন টাই ঘটছিল ছেলেটার বেলায়ও।

আমি জানালার বাইরে তাকালাম, অনেক পুরনো একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বাবার চাকরী বেশ কয়েকবার বদলী হওয়ার কারনে অনেক জায়গায় থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতাও আছে। আমার প্রাইমারী স্কুলের তিন বছর কেটেছে নানু বাড়ির এলাকায়। গ্রামের নামটা আমার খুব পছন্দের, পদ্মপুকুর। ছোটবেলায় অনেক উৎসাহ নিয়ে নানুর কাছে একই গল্প অনেক বার শুনেছি আবদার করে, এই পদ্মপুকুর নাম হওয়ার কাহিনী। নানুও খুব উৎসাহ নিয়ে গল্পটা বলতেন সেই রাজা, তার রাজ্য আর তার পদ্ম ফুলে ভরা পুকুরের গল্প। নানা, নানী নেই। মামারাও সবাই যে যার মত শহরে বা দেশের বাইরে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত। তাই আর পদ্মপুকুর নামের গ্রামে যাওয়া হয়ে ওঠে না। শেষবার গিয়েছিলাম প্রায় তিন বছর আগে। মেঝো মামা হটাত অ্যামেরিকা থেকে ফোনে বলল আমি আসতেছি আগামী মাসে। তার আব্বা আম্মার মৃত্যু বার্ষিকীটা আত্মীয় স্বজন নিয়ে অনুষ্ঠান করে পালন করবেন তিনি। বোঝাই যাচ্ছিলো মামার ব্যবসা ভালই যাচ্ছে। ওনার উদ্যোগের কারনে ঢাকার এই যান্ত্রিক জীবনের থেকে কিছুদিনের অবসর মিলেছিল, আবার সেই সাথে পুরনো অনেক স্মৃতি, অনেক আত্মীয় স্বজনদের সাথে আত্মীয়তা টাও সজাগ হয়ে উঠেছিলো। ভাই বোনদের মধ্যে আমি মেঝো মামার কাছের হওয়ার কারনে সমস্ত দায়িত্ব বলতে গেলে আমার কাঁধেই ছিল। সবার খাওয়া দাওয়া, থাকার সব ব্যবস্থা করা, মোট কথায় সবার আরাম নিশ্চিত করাটা আমার ডিউটি।

পদ্মপুকুর ছিল থানা সদর থেকে বেশ দূরে। গ্রাম এলাকা, এখানে চব্বিশ ঘণ্টায় অর্ধেক টাইমে বিদ্যুৎ থাকে না। বাসা ভর্তি মেহমান, তাও আবার মেঝো মামার ফ্যামিলি তো নব্য অ্যামেরিকান ফ্যামিলি। বড় মামার ঢাকার ফ্যামিলি। একমাত্র ছোট মামার কোন কিছুতে সমস্যা নেই। আমার কাঁধে দায়িত্ব এসে পড়ল চব্বিশ ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার। থানা সদর থেকে জেনারেটর আনার ব্যবস্থা করা হল। মিন্টু হল আমার দূরসম্পর্কের মামাতো ভাই, ওরাই এখন নানা বাড়ী দেখাশোনা করে রাখে। মিন্টুকে পাঠানো হয়েছিলো সদরে, তাকে নির্দেশনা দেয়াছিল যেন দরদাম করার আগে আমার সাথে ফোনে আলাপ করিয়ে দেয় জেনারেটর অপারেটরের সাথে। পিছে অ্যামেরিকান পার্টি দেখে দাম বেশি না রাখে তাই। মিন্টু ফোন দিয়ে বলে ‘অপারেটর তো আপনার সাথে কথা বলতে চায় না, সে আপনার সাথে সরাসরি দেখা করে কথা বলবে’। যা ভেবেছিলাম তাই, আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি যে বেশি ভাড়া রাখার একটা ফন্দী। আমি মিন্টুকে রেগে বললাম এসব ধান্ধাবাজী আমার সাথে চলবে না, টাকা বেশি রাখার ফন্দী এগুলো ভালই বুঝি। তিন দিনের জন্য নিলে কত টাকা দিতে হবে তাই শোন। মিন্টুর উত্তরে আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। বলে জেনারেটরের কোন ভাড়া লাগবে না, আর বিকালের মধ্যে বাড়ী জেনারেটর পৌঁছে যাবে। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি ঘটতে যাচ্ছে। যাইহোক বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই।

বিকালে নানুদের একতলা বাড়ির ছাদে টি টেবিল এবং চেয়ারের ব্যবস্থা করে চায়ের আসর বসানো হল। বাড়ীটা বেশ জমজমাট লাগছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো নানুরাও সবাই আছে সাথে, ছোট বেলায় যেমন জ্যৈষ্ঠ মাসে সব জামাই মেয়ে দাওয়াত করে খাওয়ানোর অনুষ্ঠান করা হত ঠিক সেরকম কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। শুধু মানুষ গুলোর চেহারা একটু পরিবর্তন হয়েছে আর পরিবারে মানুষের সংখ্যাটা বেড়েছে।

হটাত খেয়াল করে দেখলাম মাইন গেট দিয়ে একটা সাইকেল আসতেছে আর পিছে একটা ভ্যান গাড়িতে জেনারেটর, সাইকেলের সামনের রডে নরম কাপড় পেঁচিয়ে বসার জায়গায় করা, গ্রামে বাচ্চাদের সাইকেলে বসার জন্য মূলত এটা করা হয়। সেখানে বসা ফুটফুটে ছোট পরীর মত একটা মেয়ে। আর চালক ছোট খাটো দেখতে কিন্তু মজবুত চেহারার লুঙ্গি পরা ও গলায় তুলসি গাছের মালা পরা আমার সমবয়সী হবে কিংবা বড়ই হবে এমন একজন। উঠানের মাঝখানে এসে আমার দিকে হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। ভাবটা এমন যেন আমার সাথে আগে থেকেই দেখা করার কথা ছিল তাই চলে এসেছে। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। তারপর সে আমার নাম ধরে ডেকে বলে ‘কেমন আছো? এতদিন পর তাহলে পদ্মপুকুরের কথা মনে পড়ল’। আমি আরও অবাক হয়েছিলাম যে আমাকে সে ভালই চিনে, আমি মোটেও মনে করতে পারছি না উনি কে। আমার অবস্থা দেখে জোরে বলে উঠলো, ‘আমি নিলেশ, আরে আমি নিলেশ, প্রাইমারী স্কুলে আমরা বন্ধু ছিলাম’।

ওই মুহূর্তে আমার কেন জানি নিজেকে অনেক অপরাধী মনেহয়েছিলো। কারন একজন মানুষ বিশ বছর আগের একটা কাছের বন্ধুর কথা মনে রেখেছে আর তার সাথে দেখা করতে এসে যদি নিজেকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতেহয় তাহলে কষ্ট লাগারই কথা। আমি প্রথমে চিনতে পারিনি তাতে কিন্তু আমার বন্ধু নিলেশের মুখের হাসি মলিন হয়ে যায়নি, বরং সে মানিয়ে নিয়ে বলল ‘শুনলাম তুমি এখানে আর অনেকদিন দেখা হয়নি আবার আমার বিয়ের খবরও দিতে পারিনি তাই মেয়েকে নিয়ে সোজা তোমার সাথে দেখা করতে চলে এলাম’।

প্রাইমারী স্কুলে থাকা কালীন ঝগড়া বা মারামারি করলে কাশেম স্যার সবাইকে বলতেন প্রাইমারী স্কুলে যারা বন্ধুহয় তারা সারাজীবনের বন্ধু থাকে একেবারে নিঃস্বার্থ বন্ধু, সুতরং কোন ঝগড়া না শুধু বন্ধু বানাও। সেদিন নিলেশের কারনে বুঝেছিলাম কাশেম স্যার ঠিক কথাই বলতেন। কয়েকবছর পর আজ গ্রামের বাড়ী যাচ্ছি সাত দিনের ছুটিতে। ইচ্ছা আছে এর মধ্যে একদিন পদ্মপুকুর যাবো। সেইসাথে বন্ধু নিলেশের সঙ্গেও দেখা করে আসবো।

আমরা ভার্চুয়াল জগতে বা বাস্তব জীবনে নতুন নতুন বন্ধু বানাতে ব্যস্ত থাকি হয়ত তাদের বেশিরভাগ কারো সাথে কখনো দেখাই হবে না, টাইমলাইনে তাদের পোস্টে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার না করলে তাদের আর কোন খোজ হয়ত মিলবে না। কিন্তু ভুলে যাই সেইসব বন্ধুদের যারা বছরের পর বছর না দেখা হলেও বন্ধু থাকে, সেই কাছের মানুষই থাকে, কাছের মানুষ হিসাবে মনে রাখে।


সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৭:৩০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×