রাত সাড়ে ১২ টা, ১২ টা লেকচারশিট পড়া তখনো বাকি। ১২ টায় ১২ টা। আগামীকাল দুপুর ২ টায় সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। আজকে রাতটা আর ঘুমানো যাবেনা। অবশ্য এমন অভ্যাসে আমি অভ্যস্ত। গত ৫ সেমিস্টার এই করেই কাটিয়েছি। লক্ষ্য বন্দুকের গুলি যাতে আমায় বিদ্ধ করতে না পারে। প্রায় সব পরীক্ষায় গুলি কান ঘেঁষে যায়। কোনটাতে আবার আহত হই। সেই ক্ষত সারতে আবার পরবর্তী বছরে আবার একই বন্দুকের নলার মুখোমুখি হতে হয় আমায়। তবে এক বন্দুকের সামনে কখনো দুইবারের বেশি দাঁড়াতে হয়নি আমায়। এইটায় বা কম কিসে??
একটু আগেও মায়ার সাথে ফেসবুকে কথা হচ্ছিল। আমার পরীক্ষাজনিত কারণে আজ একটু তাড়াতাড়ি’ই ঘুমের বাড়ি গেছে মায়া। আর আমার এইদিকে পড়তে পড়তে মাথা খারাপ অবস্থা। কি সুন্দর দিব্যি ঘুমিয়ে আছে সে। মনে মনে ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া ছাড়া আমার আর কিইবা করার আছে? ইচ্ছা হচ্ছিল একটা ফোন দিয়ে বলতে- “ ও, তুমি ঘুমায়ে পড়ছ? আচ্ছা ঘুমাও আবার। হি হি হি”। কিন্তু মোবাইলে আছে ৫০ পয়সা। অর্থ সমস্যার কাছে তাই আমার মনের বিটলা সমস্যা হার মানলো। আবার পড়ায় মন দিলাম। মন দিলাম বললে ভুল হবে। লেকচারে চোখ দিলাম। ধূর এতো লেকচার মানুষে পড়ে? যাই একটু ফেসবুকে ঢুঁ মারি। ফেসবুকে দেখি মমিন বসে আছে।
-ঐ মমিন, পড়তাছস নাকি?
- নাহ, নাচি।
-অই, আমার কাছে লাস্ট ১২ টা লেকচার আছে। এর মধ্যে কোনটা বাদ দিলে পাশ করুমরে??
- তোর কপাল পুড়ছে দোস্ত। অইগুলান তো বেশি ইম্পর্ট্যাণ্ট না। ফার্স্ট ৯ টা লেকচার বেশি ইম্পর্ট্যাণ্ট। আগে খবর নিবিনা বেকুব?
মমিনের কথা শুনার মনে মনে একই সাথে সুখ এবং দুঃখ অনুভব করলাম। সুখানুভূতি এইজন্যই যে, “পড়েতো তাইলে লাভ নাই। হি হি হি। এখন ঘুম দিতে পারুম”।
দুঃখ অনুভূতির জন্য দায়ী অর্থ সমস্যা। এতো টাকা খরচ করে ফটোকপি না করালেই পারতাম।
ইস্ আগেই যদি জানতাম! মায়া কি এখন ঘুমিয়ে? আমার সুখ-দুঃখের কাহিনী ওকে জানাতে ইচ্ছা হচ্ছিল খুব। কালকে এক্সাম শেষ হতে হতে বিকাল ৫ টা। মায়ার সাথে আর কথা হবেনা এই সময়ের মধ্যে। এই ভেবে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম আমি।
সকাল ৬ টা। রাতে ঘুম ভালো হয়নি। কিসব হাবিজাবি স্বপ্ন দেখেছি রাতে। মায়া ফেসবুকে বলছে- “ তোমারে কি আমি সাধে বেকুব ডাকি? এই দেখো তুমি কতো বড় বেকুব। হি হি হি”। ঘুম ভেংগে বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। একবার ফেসবুকে ঢুকবো নাকি? মায়ার খোঁজে? নাহ থাক, এতো মায়াতে জড়নো ঠিক না।
দুপুর ২ টা। এক্সাম হলে বসে আছি। কম গুরুত্বপূর্ণ সেই ১২ টা লেকচারের উপরই কোনমতে চোখ বুলিয়ে এসেছি। “গুরুত্বহীন ১২ বাবারা আজকে আমার ১২টা বাজার হাত থেকে রক্ষা করো প্লিজ”। প্রশ্ন হাতে পেলাম। এবার আর সুখ-দুঃখ অনুভূতি হলোনা, বরং মমিনের উপর হিংস্রানুভূতি হলো। এক্সাম শেষ হোক, ওর পশ্চাৎদেশে দুইটা লাথি না কষলে আজকে আমার ঘুম সুখকর হবেনা। কেননা, প্রশ্নে গুরুত্বহীন লেকচার গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যাই হোক বিসমিল্লাহ বলে কিছুটা স্মৃতি কিছুটা বুদ্ধি আর কিছুটা মনের মাধুরীতে এক এক করে প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলাম। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক সূত্রের মতো ৩ ঘণ্টাকে মনে হতে লাগলো ৬ ঘন্টা বা তারো বেশি। আর কতো লিখা যায়? দুইবার বাথরুমে গেলাম। স্যার বলে –“এই ছেলে এতোবার বাথরুমে গিয়ে কি কর?” এর ওর খাতার দিকে উকি-ঝুকি মারলাম। বোনাস খুব কমই পেলাম। সবগুলা কিপটা। কাওরে যে একটু বোনাস মার্ক দিবে সেই হৃদয় নাই কারো। অবশেষে আপেক্ষিক ৬ ঘণ্টার অবসান ঘটলো এবং আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
দৌড়ে গিয়েও ভার্সিটির বাসটা মিস। মমিন ও মিস। আমার ভয়ে পালাইছে মনে হয়। মায়া নিশ্চয় এতোক্ষণে ফেসবুকে অনলাইন হয়ে বসে আছে আমার জন্য। মোবাইলে চার্জ নেই। ফেসবুকের ইনবক্সটা লাল হয়ে বসে আছে। মায়ার মেসেজ- “এক্সাম কেমন হইলো। আসবা কখন?” রিপ্লাই দিলাম – “তুমি থাকো প্লিজ। আমি আসতেছি। একটু দেরি হবে”।
বাসগুলাও যে কি? আজকে মনে হয় অন্য জায়গায় হাওয়া খেতে গেছে। বাসের দেখা নেই। মায়া নিশ্চয় আমার জন্য অনলাইনে অপেক্ষা করেই আছে। হয়তো একটু পর মেসেজ দিবে- “তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করো কেন? আমি কি দোষ করছি?”। মনটায় শান্তি পাচ্ছিলামনা। কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছিল। বারবার ওর মুখটা মনে পড়ছিল। মেয়েটার প্রতি দিন দিন মায়া বেড়েই যাচ্ছে। যতই মনকে নিষেধ করি, “যেওনা ওইদিকে, মন ততোই নিষেধ অমান্য করে”। নাহ্ মায়ার সাথে মায়ার বাঁধনে পড়া যাবেনা কিছুতেই।
মায়ার মায়া কাটাবো বলে প্রকৃতির মায়ায় ডুবিয়ে দিলাম নিজেকে। শেষবারের মতো চেষ্টা করেই দেখি পারি কিনা? খোলা আকাশের নিচে ক্যাম্পাস চত্বরে হাঁটতে লাগলাম। আজকে দেরি করেই বাসা ফিরবো। আকাশে রুপালী চাঁদটা তার রাজ্যের মায়া নিয়ে পৃথিবীটাকে আরো বেশি মায়াময় করে তুলেছে। পৃথিবীটা এতো মায়াময় কেন??......
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৩ রাত ১১:২৪